
তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
সালটা ১৯৩১। অল ইন্ডিয়া রেডিও-র বাংলা সম্প্রচারের দায়িত্বে তখন নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। শোনা যায়, নিছকই এক ঘরোয়া আড্ডায় কথা ওঠে, মহালয়ার ভোরে যদি কোনও এক প্রভাতী অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা যায়। সকলের সম্মতি এবং উৎসাহে, সে কথা বাস্তবে পরিণত হতে সময় লাগেনি খুব বেশি। মা দুর্গার অসুর নিধন পালার স্ক্রিপ্ট লিখে ফেললেন বাণীকুমার। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে নির্বাচন করা হয় সূত্রধরের ভূমিকায়। তিনিই চণ্ডীপাঠ করবেন বলে ঠিক হয়।
সে এক হৈ হৈ কাণ্ড। কিন্তু হৈ হৈ হলেই কি আর নিখুঁত হয়? তাই সমালোচকদের তরফে প্রশ্ন উঠলই। “কায়েতের ছেলে আবার চণ্ডীপাঠ করবে কি?” আজ থেকে প্রায় ন’দশক আগে এমন প্রশ্ন খুব যে অবান্তর ছিল, তা কিন্তু নয়! তত দিনে সম্পূর্ণ ভাবে তৈরি হয়েছে মহিষাসুরমর্দিনী। গান, বাজনা, আবহ– সমস্তটা প্রস্তুত।
পরবর্তী কালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, সে দিন সমালোচকদের তরফে ওঠা এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন, স্বয়ং নৃপেন্দ্রনাথবাবু। বলেছিলেন, “অনুষ্ঠান করবে, তার আবার বামুন-কায়েত কী হে? আমাদের এই অনুষ্ঠানে যাঁরা বাজাবেন তাঁরা তো অর্ধেকেরও বেশি মুসলমান! তা হলে তো তাঁদের সকলকে বাদ দিয়ে ব্রাহ্মণদের ডেকে আনতে হয়।”
তিনি সে দিন আরও মনে করিয়েছিলেন, বাঙালিদের সব চেয়ে বড় উৎসবের আগে ভূমিকা হিসেবে এই অনুষ্ঠান হবে। উৎসবের আবার ধর্ম কী! এর পরেই ছিল তাঁর কৌতুক। লেখক বাণীকুমারকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, “অনুষ্ঠান লিখছে তো এক বামুন, এতে হবে না বুঝি?” শোনা যায়, এই পর্বে লেখক বাণীকুমার স্মিত হেসে জানিয়েছিলেন, বীরেন ছাড়া আর কাউকে তিনি চণ্ডীপাঠ করতে দেবেন না।
ঠিক এমন সম্প্রীতির আবহেই জন্ম নিয়েছিল মহিষাসুরমর্দিনী।
বছর বছর মহালয়া শুনলেও, এই দিনটিতে ধর্মীয় আচার মেনে তর্পণ করলেও, চণ্ডীপাঠের বাজনায় তাল মিলিয়ে বুকের ভিতর হিন্দু ধর্মের সনাতনী আবেগ জাগ্রত হলেও, অনেকেই জানেন না, এই মহিষাসুরমর্দিনীর জনপ্রিয় সুরারোপের ব্যাপারে আকাশবাণী কলকাতার মুসলমান শিল্পীদের অবদান কতটা! অনুষ্ঠানে সারেঙ্গি বাজিয়েছিলেন মুনশি, চেলো বাজান তাঁর ভাই আলি, হারমোনিয়ামে ছিলেন খুশি মহম্মদ। এ ছাড়াও আকাশবাণীর আরও কয়েক জন নিয়মিত মুসলমান বাদক সে দিন মহিষাসুরমর্দিনীর নেপথ্য শিল্পী ছিলেন। জানা যায়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মহালয়ার দিন কাকভোরে স্নান করে, শুদ্ধ বসনে আকাশবাণীর আফিসে ঢুকতেন। এরপর শুরু হত অনুষ্ঠান। তাঁর মতোই, মুসলমান নেপথ্য শিল্পীরাও একই ভাবে স্নান সেরে, শুদ্ধ পোশাক পরে অনুষ্ঠান শুরু করতেন।
তখন তো রেকর্ডিং নয়, ‘লাইভ’ পাঠ হতো অনুষ্ঠান। প্রথম বারের জন্য পাঠ শুরু হবে। মহড়া চলেছে তার আগে। কিন্তু তাতে রয়ে গিয়েছে সমন্বয়ের ফাঁক। তাই অনিচ্ছাকৃত এক ভুল হয়ে গেল, যন্ত্রশিল্পীদের তরফে। তবে নৃপেন্দ্রনাথবাবু পরে বলেছিলেন, ওই ভুলই নাকি অনুষ্ঠানকে এক আলাদা মাত্রা দিয়েছিল।
অনুষ্ঠানের সেই মুসলমান যন্ত্রীদের বেশির ভাগই ছিলেন অবাঙালি, উর্দুভাষী। তাঁরা বাংলা বা সংস্কৃত কোনওটাই তেমন ভালো ভাবে জানতেন না। মহড়ার সময়ে কথা হয়েছিল, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ যখন শ্লোক আবৃত্তি করবেন, তখন তাঁকে যন্ত্রীরা সুরের ধরতাই জোগান দেবেন। কিন্তু বাংলা গদ্য আবৃত্তির সময়ে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আলাদা কোনও সুর নয়, আবহ থেকে কেবলমাত্র নির্দিষ্ট রাগের আলাপ বাজাবেন। আসল অনুষ্ঠান অর্থাৎ লাইভ সম্প্রচার শুরুর আগেও অনুষ্ঠানের সূত্রধর রাইচাঁদ বড়াল মশাই সেটা মুসলমান যন্ত্রীদের খুব ভালো করে বুঝিয়ে দেন।
যথারীতি প্রোগ্রাম শুরু হল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ শ্লোক আবৃত্তি করে, একটু থেমে বাংলা গদ্য আবৃত্তি শুরু করলেন– ‘আজ শুভ শারদোৎসব, জলে স্থলে প্রকৃতিতে আনন্দের বার্তা’…। এ দিকে সংস্কৃত শ্লোক থেকে বাংলায় প্রবেশ করে ফেললেও, সংস্কৃত ও বাংলার পার্থক্য বুঝতে না পেরেই হোক বা একটু ঘাবড়ে গিয়েই হোক, অবাঙালি মুসলমান বাদকরা বাংলা কথার সুরে সুরেও এক রকম নিজেদের মতো করেই ধরতাই শুরু করে দিলেন। আর সবাই অবাক হয়ে দেখলেন, প্রস্তুতি না-থাকা সত্ত্বেও সেই গদ্যের সুরের সঙ্গে তাঁদের বাজনা কী চমৎকার ভাবে মিলে যাচ্ছে!
বাঙালি যন্ত্রীরা তখনও থেমেছিলেন। আতঙ্কিত হয়ে দেখছিলেন, কী কাণ্ড ঘটছে। কী ভাবে ভুল করে ফেলেছেন তাঁদের সহ-যন্ত্রীরা। কিন্তু যখন দেখলেন সেই কথা আর সুরের মেলবন্ধন এক অপূর্ব মাত্রা নিচ্ছে, তখন তাঁরাও সুর মিলিয়ে বাজাতে শুরু করলেন।
পরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বলেছিলেন, একটা ছোট্ট ভুলে পুরো অনুষ্ঠানটাই ‘অখণ্ড সুরের প্রবাহে’ পরিণত হয়। সব মিলিয়ে দিকে দিকে ধন্য ধন্য রব উঠল। মুগ্ধতার প্রকাশ আর অভিনন্দনের উষ্ণতায় উপচে পড়ল আকাশবাণীর দফতর। ১৯৬৬ সালে রেকর্ডিং করা হয় এই অনুষ্ঠান। তার আগে পর্যন্ত লাইভ-ই উপভোগ করেছেন শ্রোতারা। শোনা যায়, দেবী দুর্গার অসুরবধের দৃশ্য বর্ণনা করতে করতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের দু’চোখ বেয়ে গড়াত অশ্রু। আর সে সময় শুকনো থাকত না ওই মুসলমান শিল্পীদের চোখও। পাঠের অর্থ না বুঝেও, আবেগের ধারা সঞ্চারিত হতো সুরে সুরে।
যে আবেগে ধর্ম নেই, ভেদ নেই। আছে কেবল আগমনীর উদযাপন।
তথ্যসূত্র: বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সাক্ষাৎকার, আকাশবাণীর আর্কাইভ।