
ইতিহাসের সেরা এগারো যুদ্ধবিমান, বিপক্ষের কাছে যেগুলি ছিল মূর্তিমান বিভীষিকা
বিভিন্ন যুদ্ধ জয়ের প্রধান কারিগর ছিল এই বিমানগুলি।
দ্য ওয়াল ব্যুরো: যেকোনও যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি কদর এদেরই। কারণ সমর বিশেষজ্ঞরা বলেন, আকাশ যার, যুদ্ধে জয় তার। অর্থাৎ রণক্ষেত্রের আকাশ যে পক্ষের দখলে থাকবে, যুদ্ধে সেই হবে বিজয়ী। তাই আধুনিক পৃথিবীতে যুদ্ধ জয়ের প্রধান কারিগর এরা। যাদের আমরা চিনি, ফাইটার জেট কিংবা যুদ্ধবিমান নামে। আজ চিনে নিন ইতিহাসের কিছু বিখ্যাত ফ্লাইং-কিলারকে।
হকার হ্যারিকেন (গ্রেট ব্রিটেন)
হকার এয়ারক্রাফট সংস্থা, তিরিশের দশকে এক আসন বিশিষ্ট যুদ্ধবিমানটি বানালেও, বিমানটি যুদ্ধে নেমেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর সময়ে। ১২০০ হর্স পাওয়ারের রোলস রয়েস ইঞ্জিনযুক্ত বিমানটিতে বসানো থাকতো ৭.৭ এম.এম. মেশিন গান। ব্যাটল অফ ব্রিটেন (১৯৪০-৪১) ও মাল্টা রক্ষায় ব্রিটিশবাহিনীকে বিমানটি বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল।
ইউ-টু ‘ড্রাগন লেডি’ (আমেরিকা)
এটি হলো এক আসন বিশিষ্ট যুদ্ধ বিমান। যেটিকে মূলত ব্যবহার করা হতো গোয়েন্দা বিমান হিসেবে। আকাশে প্রথম উড়েছিল ১৯৫৬ সালে। শেষবারের মতো বানানো হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। শত্রুপক্ষের খবর নজরদারিতে বিমানটির জুড়ি ছিল না।
মূলত রাশিয়া আর কিউবার ওপর গোয়ন্দাগিরি করার জন্য ইউ-টু বিমানটিকে তৈরি করেছিল আমেরিকা। তবে বিমানটিকে দেখা গিয়েছিল ভিয়েতনামের আকাশেও। আমেরিকার নাসা ইউ-টু বিমানকে আরও একটু উন্নত করে, পৃথিবীর আবহাওয়া ও অনান্য তথ্য জানতে ১৯৮২ সাল থেকে ব্যবহার করে আসছে।
বি-ফিফটিটু স্ট্র্যাটোফর্ট্রেস (আমেরিকা)
১৯৪৮ সালে এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধবিমানটির নকশা করেছিল বোয়িং কোম্পানি। বিমানটি আকাশে প্রথম উড়েছিল ১৯৫২ সালে। সোভিয়েত ইউনিয়নে অ্যাটম বোমা ফেলার উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছিল বিমানটি। এই বিমান আজও সক্রিয় আছে আমেরিকার বিমানবাহিনীতে।
আটটি জেট ইঞ্জিন বিশিষ্ট বিমানটি উড়তে পারে পঞ্চান্ন হাজার ফুট উচ্চতায়। সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ৯৬০ কিলোমিটার। ঘন্টায় ৬০০ কিলোমিটার গতিবেগে, মাটি থেকে মাত্র কয়েকশো ফুট ওপর দিয়ে উড়তে সক্ষম। বিমানটি ছুঁড়তে পারে ক্রুজ মিসাইল ও স্বল্পদূরত্বের বিভিন্ন শ্রেণির মিসাইল। এর ডাক নাম, ‘বিগ আগলি ফ্যাট ফেলো‘।
এফ-সিক্সটিন ফ্যালকন (আমেরিকা)
এক আসন ও একটি ইঞ্জিন বিশিষ্ট এফ-সিক্সটিন বোমারু বিমানটি তৈরি করেছিল লকহেড মার্টিন করপোরেশন। বিমানটি আকাশে প্রথম উড়েছিল ১৯৭২ সালে। তবে আমেরিকার মিলিটারি হাতে পেয়েছিল ১৯৭৮ সালে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন বন্ধু দেশকে বিমানটি বিক্রি করেছিল আমেরিকা।
ইজরায়েল-সিরিয়া যুদ্ধ (১৯৮২), উপসাগরীয় যুদ্ধে (১৯৯০-৯১) বাজিমাত করেছিল এই বিমান। আজ কুড়িটি দেশের বিমানবাহিনী ব্যবহার করে থাকে এফ-সিক্সটিন বিমানটি। বিমানটি বহন করতে পারে একটি ২০০০ পাউন্ডের Mark-84 বোমা ও AIM-9 ও AIM-9J সাইডউইন্ডার মিসাইল। বিমানটিতে বসানো আছে ২০ এম.এম. কামান। বিমানটির দুটি ডানাতে আছে একটি করে অতিরিক্ত ফুয়েল ট্যাঙ্ক।
মিগ-টোয়েন্টি ওয়ান ( সোভিয়েত ইউনিয়ন)
এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট হালকা এই যুদ্ধবিমানটি তৈরি করেছিল, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘এরোস্পেস ডিজাইন ব্যুরো’। বিমানটি শব্দের দ্বিগুণ গতিতে উড়তে সক্ষম। প্রথম আকাশে উড়েছিল ১৯৫৫ সালে, কিন্তু যুদ্ধে নেমেছিল ১৯৫৮ সালে। অল্প জায়গায় ঘুরপাক খেতে সক্ষম বিমানটির দাম ও রক্ষণবেক্ষণের খরচ অত্যন্ত কম হওয়ায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল মিগ-টোয়েন্টি ওয়ান।
আজ প্রায় চল্লিশটির বেশি দেশ ‘মিগ-টোয়েন্টি ওয়ান’ ব্যবহার করে। প্রায় ৯০০০ মিগ-টোয়েন্টি ওয়ান বানিয়েছে এরোস্পেস ডিজাইন ব্যুরো সংস্থাটি। সত্তরের দশকের আরব যুদ্ধে, সৌদি আরব ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছিল এই বিমানটি। ব্যবহার করেছিল ভিয়েতনামও।
টুপোলেভ টু-নাইন্টি ফাইভ বোম্বার ( সোভিয়েত ইউনিয়ন)
বিমানটি প্রথম আকাশে উড়েছিল ১৯৫২ সালে। সোভিয়েত মিলিটারি প্রথম ব্যবহার করেছিল ১৯৫৪ সালে। এটিই একমাত্র বিমান যেটি দীর্ঘকাল ধরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পরবর্তীকালে রাশিয়ার মিলিটারিকে সাহায্য করে যাচ্ছে। এখনও প্রায় পঞ্চাশটির বেশি টুপোলেভ টু-নাইন্টি ফাইভ বিমান, রাশিয়ার বিমান বাহিনীতে সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। সাধারণত ক্রুজ মিসাইল ছুঁড়ে থাকে এই বিমানটি।
বিএফ-হান্ড্রেড নাইন ফাইটার (জার্মানি)
নাৎসি জার্মানির প্রধান ঘাতক যুদ্ধবিমান ছিল বিএফ-হান্ড্রেড নাইন। যেটি যুদ্ধ শুরু করেছিল ১৯৩৭ সালে। ব্যবহার করা হয়েছিল স্পেনের গৃহযুদ্ধ দমনে। সোভিয়েত ইউনিয়নের আই- ফিফটিন ও আই-সিক্সটিন বিমানের প্রধান শত্রু ছিল এই বিমানটি।
বিমানটিতে প্রথম দিকে লাগানো ছিল, ৭.৯২ এম.এম. মেশিনগান। পরবর্তীকালে বসানো হয়েছিল স্বয়ংক্রিয় কামান ও দু’টি মেশিনগান। সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ৫৭০ কিলোমিটার। উড়তে পারতো মাটি থেকে ৩৬০০০ ফুট ওপরে। ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে (১৯৪০-৪১), বিমানটি ব্যবহার করেছিল জার্মানি।
পি-ফিফটি ওয়ান মুস্তাং (আমেরিকা)
এক আসন ও একটি ইঞ্জিন বিশিষ্ট এই বোমারু বিমানটি, নর্থ আমেরিকান অ্যাভিয়েশন সংস্থা তৈরি করেছিল, ব্রিটিশ রয়াল এয়ারফোর্সের জন্য। দিনের বেলায় সারা ইউরোপ জুড়ে নজরদারি চালাতো বিমানটি। পরবর্তীকালে বিমানটি স্থান পেয়েছিল আমেরিকার বিমানবাহিনীতে। লড়াই করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে, লাইসেন্স নিয়ে বিমানটি উৎপাদন করতে শুরু করেছিল অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে বেশ কিছু বিমান কিনেছিল চিন। বি-ফিফটি ওয়ান বিমানটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ৭০০ কিলোমিটার, উড়তে পারে ৪৪০০০ ফুট উঁচুতে। বিমানটিতে বসানো ছিল ১২.৭ এম.এম. মেশিনগান।
ডাসো-ব্রেগে মিরাজ (ফ্রান্স)
ফ্রান্সের ডাসো-ব্রেগে ফার্মের তৈরি যেকোনও যুদ্ধবিমানকেই বলা হয় মিরাজ। দামে কম ও বহুদিন কার্যক্ষম হওয়ায়, মিরাজ গ্রুপের বিমানগুলি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। প্রথম মিরাজ বিমানের নাম ছিল মিরাজ-থ্রি। এটি ছিল এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট বিমান।
প্রথম আকাশে উড়েছিল ১৯৫৬ সালে। ষাটের দশকে ইজরায়েলের এয়ারফোর্সের অন্যতম শক্তি ছিল এই মিরাজ-থ্রি। দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, লেবানন, আর্জেন্টিনা, পাকিস্তান, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া ও সুইটজারল্যান্ড ছিল ডাসো-ব্রেগে ফার্মের প্রথম দিকের ক্রেতা।
মিটসুবিসি জিরো (জাপান)
এক আসনের এই জাপানি বিমানটি আমেরিকা ও তার সঙ্গীদের অতিষ্ঠ করে তুলেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। মিটসুবিসি জিরো বিমানটির নকশা তৈরি করা হয়েছিল ১৯৩৭ সালে। বিমানটি প্রথম আকাশে উড়েছিল ১৯৩৯ সালে। ১৯৪০ সালে চিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রথমবার ব্যবহার করা হয়েছিল বিমানটিকে।
প্রায় এগারো হাজার ‘মিটসুবিসি জিরো’ বানিয়েছিল জাপান। বিমানটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ৫০০ কিলোমিটার। উড়তে পারতো ১৩০০০ ফুট উচ্চতাতে। দু’টি ২০ এম.এম. কামান, দু’টি ৭.৭ এম.এম. মেশিনগান এবং দু’টি ৬০ কেজি ওজনের বোমা নিয়ে আকাশে উড়ত মূর্তিমান বিভীষিকা ‘মিটসুবিসি জিরো’।
থান্ডারবোল্ট-টু (আমেরিকা)
দুটি আসন এবং দুটি ইঞ্জিন বিশিষ্ট থান্ডারবোল্ট-টু যুদ্ধবিমানটি প্রথম আকাশে উড়েছিল ১৯৭২ সালে। আমেরিকার বিমানবাহিনীর অন্যতম শক্তি ছিল যুদ্ধবিমানটি। এই ঘাতক যুদ্ধবিমানটিকে আমেরিকা ব্যবহার করেছিল উপসাগরীয় যুদ্ধ এবং বলকান যুদ্ধে। বিমানটি ব্যবহার করা হয়েছিল লিবিয়া, আফগানিস্তান, এমনকি আইসিসের বিরুদ্ধেও।
বিমানটিতে আছে, সাতটি ব্যারেল যুক্ত ৩০× ১৭৩ এম.এম. স্বয়ংক্রিয় ‘অ্যাভেঞ্জার’ কামান। যেটি মিনিটে প্রায় ২৪০০ থেকে ৪২০০ টি ট্যাঙ্ক বিধংসী গুলি ছুঁড়তে পারে। তাই এর নাম ‘ট্যাঙ্ক কিলার’। এছাড়াও বিমানটি বহন করে AGM-65 মাভেরিক মিসাইল, ক্লাস্টার বোমা, রকেট, লেজার গাইডেড বোমা।