
রফিকুল জামাদার
গত রবিবার সকালে ঘুম ভাঙার আগেই দেখা যায়, মজলিস ই ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি ফুরফুরা শরিফে অজু করছেন। পরে নমাজ, হাল্কা প্রাতঃরাশ সেরে বেলা বেলা বেরিয়ে যান তিনি। তার আগে ফুরফুরার ‘চশমে চিরাগ’ আব্বাসউদ্দিন সিদ্দিকিকে পাশে নিয়ে বলেন, “বাংলায় আমরা লড়ব। আব্বাসের নেতৃত্বেই লড়ব। তাঁর নির্দেশেই চলব। বাকিটা উনিই বলবেন।”
আব্বাস সে দিন বিশেষ কিছু আর জানাননি। আজ বৃহস্পতিবার ‘দ্য ওয়াল’কে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে বলেন, “হ্যাঁ আমি পৃথক রাজনৈতিক দল গঠন করছি। নির্বাচন কমিশনে নাম নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। পার্টির কী নাম দিয়েছি তা খুব শিগগির সাংবাদিক বৈঠক করে জানাব।”
আব্বাসের একটি সংগঠন রয়েছে। নাম সুন্নাতুল জামাত। তিনি অবশ্য বলেন, “সুন্নাত জামাত অরাজনৈতিক সংগঠন। দলের নাম হবে ভিন্ন।” তাঁর কথায়, “এই যাত্রাপথে আমি থাকব না। আসাদউদ্দিন ওয়াইসি ভাই আমার উপর আস্থা রেখেছেন। বলেছেন, আমার নির্দেশে বাংলায় মিম চলবে। আমি আজ বলছি, আরও অন্তত ১০টি সংগঠন থাকবে আমার সঙ্গে। অর্থাৎ একটা ফ্রন্ট তৈরি হবে। এ বার সংখ্যালঘু মহাজোট হবে বাংলায়।”
ধর্মের আধারে অতীতে বাংলায় যে রাজনীতি হয়নি তা নয়। ‘৬৯ সালের নির্বাচনে বিধানসভায় তিনটি আসনে জিতেছিল মুসলিম লিগ। কিন্তু যে ভাবে ধর্মীয় মঞ্চ থেকে উঠে এসে আব্বাস রাজনীতির ময়দানে নামতে চাইছে, তা নিয়ে প্রশ্নও উঠছে।
সে কথা শুনে আব্বাস একবার হেসে ফেলেন। বলেন, “কী বলছেন! পুরনো কথা সব ভুলে গেলেন নাকি!” ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা পরক্ষণেই সিরিয়াস গলায় বলেন, “ভারতের সংবিধান ধর্মের ভিত্তি রাজনৈতিক দল গঠনে অনুমতি দেয় না। আমার উদ্দেশ্যও তাই নয়। আমি গরিব হিন্দু অধিকারের জন্যও লড়ব। আদিবাসীদের জন্যও লড়ব। কিন্তু ভাই, বামফ্রন্ট জমানায় আমিই তো দেখেছি, কোনও না কোনও পীরজাদা ধর্মীয় মঞ্চ থেকেই মুসলিম ভাইদের ঠেলে বামপন্থী গঙ্গার জলে ফেলেছেন। আবার তৃণমূল ক্ষমতায় এলে দেখেছি, মঞ্চে তাঁদের হাত ধরে সেই পীরজাদা বলছেন, ইনিই আমাদের ক্যান্ডিডেট!”
তাঁর কথায়, “ও ধোঁকাবাজি আমার স্বভাবে নেই। ইমানের সঙ্গে কাজ করি। মানবতার সঙ্গে কাজ করি। পষ্টাপষ্টি বলি, এমন কিছু করবে না যাতে দেশের ক্ষতি হয়। হজ, জাকাত যেমন ইসলামের শিক্ষা তেমনই দেশকে ভালবাসাও ইসলামের শিক্ষা। দেশবিরোধী যারা কাজ করবে তারা ইসলাম বিরোধী। আমি বলি, ন্যায়ের জন্য লড়াই করতে। সৎ মানুষের পাশে থাকতে।”
আব্বাসকে বাংলায় নেতা মেনেছেন ওয়াইসি। তার পরই শাসক দলের তরফে বলা হয়েছে, কৌশলে বাঙালি মুসলিম মুখকে সামনে রাখতে চাইছেন ওঁরা। এসবে মানুষ ভুলবে না। ওয়াইসি বহিরাগত। এ অভিযোগে গুরুত্ব দিতে চাননি আব্বাস। তিনি বলেন, “বাংলার সংখ্যালঘুরাই তো লড়বেন। নিজেদের অধিকারের বিরুদ্ধে লড়বেন। বেকুব বানানোর চেষ্টার বিরুদ্ধে লড়বেন।” তাঁর কথায়, “ওয়াইসি সাহেব যে আচরণ দেখিয়েছেন তা আমার অত্যন্ত ভাল লেগেছে। উনি সত্যনিষ্ঠ। উনি ঠিক কথাই বলেছেন। ভোট ভাগাভাগি যাতে না হয় সে জন্য ফ্রন্ট তথা মহাজোট গঠন করতেই হবে। তা সকলেরই স্বার্থ সিদ্ধ করবে।”
অতীতে বাম জমানায় বাংলায় বামেদের সংখ্যালঘু জনভিত্তি ছিল দুর্জয়। রাজনৈতিক পালাবদলের পর সেই সংখ্যালঘু সমাজেই এখন শাসক জনভিত্তি মজবুত বলে ধারণা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায়ই দাবি করেন, সংখ্যালঘুদের জন্য ২০০ শতাংশ কাজ করে দিয়েছেন। আড়াই কোটি সংখ্যালঘু ছেলেমেয়ে স্কলারশিপ পায়। ইমামরা ভাতা পান। ফলে এখন যে প্রশ্নটা অনিবার্য, তা হল— এত কিছুর পরেও কোন অধিকারের জন্য লড়তে চান আব্বাস সিদ্দিকি।
ফুরফুরা শরিফের হুজুর এ বার সোজা সাপটা। তাঁর কথায়, “স্কলারশিপ তো অরাজনৈতিক সংগঠন থেকে আমরাও দিই। কিন্তু সরকার সংখ্যালঘু ছেলেমেয়েদের পঠনপাঠনে উৎকর্ষ বাড়ানোর জন্য কী করেছে। কটা ছেলেমেয়েকে এগিয়ে দিয়েছে? যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, তা কি সব পালন করেছেন? মুসলিমদের ১৫ শতাংশ সংরক্ষণ দেবেন বলেছিলেন, কোথায় হয়েছে তা? ফুরফুরা শরিফকে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র বানাব বলেছিলেন, তাও কি হয়েছে? সংখ্যালঘুদের পঠনপাঠন ও সাংস্কৃতিক মেলেমেশার জন্য কটা প্রতিষ্ঠান হয়েছে বাংলায়? মাদ্রাসা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে?”
আব্বাস আরও বলেন, “উনি বলেছেন, ইমামদের ভাতা দেওয়া হবে। তা যে ওয়াকফের সম্পত্তি থেকে দিচ্ছেন সে কথা বলেননি কেন? তাতে বরং উল্টে সমাজের সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। কেউ পেয়েছে, কেউ পাননি। হিন্দু ভাইয়েরা ভুল বুঝেছেন।”
পীরজাদা বলেন, “ফুরফুরা শরীফের তাবিজ দেখিয়ে দেখিয়ে রাজনীতি করেছেন নেত্রী। এখনও মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছেন। এত কোটি টাকা দিয়েছি, উন্নয়ন পর্ষদ থেকে করে দিয়েছি, এই দিয়েছি, ওই দিয়েছি, আর কত দেব! যেন মনে হচ্ছে গুঁজে গুঁজে খাওয়ানো হচ্ছে। আমি বলছি, ওসব গোল গোল কথা বললে চলবে না। হিসাব দিন কী কী দিয়েছেন, কোথায় দিয়েছেন? আমি তো তিন বছর ধরে খুঁজে পেলাম না।”
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এসব অভাব অভিযোগ থাকবেই। কিন্তু আব্বাস বা ওয়াইসির বিরুদ্ধে শাসক দলের মূল অভিযোগ, তাঁরা বিজেপির হয়ে ভোট কাটতে নেমেছেন। এ প্রশ্নের জবাবে আব্বাসউদ্দিন বলেন, “এ সব শুনলে খারাপ লাগে। কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপির কেউ পার্টি করলে কেউ বলে না কোন ধর্মের পার্টি। আর একজন মানুষ মাথায় সাদা টুপি পরে মানুষের জন্য ন্যায় বিচারের কথা বললে বলা হয় ধর্মীয় পার্টি। এটা ঠিক নয়।” তাঁর কথায়, যাঁরা বলছেন আমরা ভেদাভেদ করতে নেমেছি, তাঁরা ভুল বলছেন। বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যদি কেউ ভেদাভেদ তৈরি করে থাকেন তিনি হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।”
আব্বাসউদ্দিন অবশ্য জানিয়েছেন, রাজ্যে ২৯৪টি আসনেই হয়তো তাঁরা এবার প্রার্থী দিতে পারবেন না। তবে যেখানে যেখানে তাঁদের জনভিত্তি রয়েছে ও শরিকরা রয়েছেন সেখানেই অবশ্য লড়বেন। “খুব শিগগির দেখা হবে রাজনীতির ময়দানে।”