
দামাল পর্যটকদের হাতছানি দেয়, লেক সুপিরিয়রের বিপজ্জনক বরফ গুহা
বিশ্বের সর্ববৃহৎ মিষ্টি জলের হ্রদ লেক সুপিরিয়র।
দ্য ওয়াল ব্যুরো: উত্তরে কানাডার অন্টারিও, পশ্চিমে আমেরিকার মিনাসোটা, দক্ষিণে আমেরিকার উইসকনসিন ও মিশিগান, এর মাঝখানে শুয়ে আছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মিষ্টি জলের হ্রদ লেক সুপিরিয়র। ৫৬৩ কিমি লম্বা এবং ২৫৭ কিমি চওড়া লেকটির গড় গভীরতা ৪৮২ ফুট হলেও, সর্বোচ্চ গভীরতা প্রায় ১,৩৩২ ফুট।

সুপিরিয়র লেকে ভাসা দ্বীপগুলির উপকূল এলাকা ধরলে, লেক সুপিরিয়রের উপকূল এলাকার দৈর্ঘ্য প্রায় ৪,৩৮৭ কিলোমিটার। তাই ছোটখাটো সাগরই বলা চলে লেক সুপিরিয়ারকে। লেক সুপিরিয়রের তীরের কিছু অংশে, বেলেপাথরের পাহাড়গুলির গায়ে আছে কিছু আশ্চর্যজনক গুহা। গুহাগুলির ভেতর আছে অসংখ্য ছোট ও বড় প্রকোষ্ঠ।
কোটি কোটি বছর ধরে সুপিরিয়র লেকের ঢেউ, বেলে পাথরের দেওয়ালে আছড়ে পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই সৃষ্টি করে ফেলেছে কিছু প্রাকৃতিক গুহা। বছরের বিভিন্ন ঋতুতে গুহাগুলি রঙ বদলায়। গ্রীষ্মের সময় লেক সুপিরিয়রের ঘন নীল জলরাশি ও তীরের ঘন সবুজ জঙ্গলের মাঝে লুকিয়ে থাকা গুহাগুলির রঙ হয়ে যায় বাদামি।
গুহাগুলিকে আদর করে যায়, আশেপাশের পাহাড়গুলি থেকে লেকে নেমে আসা ঝরনার জল। বেশিরভাগ গুহার মেঝে সারা বছর লেকের জলের ডুবে থাকে। ঝোড়ো হাওয়ার দিনগুলিতে, গুহাগুলির ওপর ভেঙে পড়ে লেক সুপিরিয়রে ওঠা পঞ্চাশ ফুটের উত্তাল ঢেউ।
গ্রীষ্মকালে ডেভিলস আইল্যান্ড, স্যান্ড আইল্যন্ড ও অনান্য দ্বীপে থাকা গুহাগুলি দেখার জন্য ছোট জাহাজ চালায় ‘অ্যাপোস্টেল আইল্যান্ড ক্রুজ সার্ভিস’। গাইডদের সাথে কায়াক চেপে কয়েক কিলোমিটার লম্বা ও অসংখ্য প্রকোষ্ঠের গুহাগুলিতে, ঘুরে বেড়ান পর্যটকেরা। মোহিত হয়ে যান গুহাগুলির গা ছমছমে সৌন্দর্যে।
আসে শীতকাল। সম্পূর্ণ অচেনা রূপ ধরে ‘লেক সুপিরিয়র’। পুরু বরফের নীচে লুকিয়ে পড়ে লেক সুপিরিয়রের সুবিশাল জলরাশি। পৃথিবীর অন্যতম শীতল হ্রদ লেক সুপিরিয়র, অ্যান্টার্কটিকার মতোই হয়ে ওঠে বরফের মরুভূমি। জানুয়ারি থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত বরফে মুড়ে থাকে লেকটি।

লেক সুপিরিয়রে থাকা গুহাগুলি শীতকালে দেখায় এক অবিশ্বাস্য রূপ। গুহার ভেতর আছড়ে পড়া জল জমে বরফ হয়ে যায়। গুহার ভেতর জমে যায় পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার জলও। তৈরি হয় আইসিকল, ছুঁচের মতো তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ নিয়ে ঝুলতে থাকে গুহাগুলির ছাদ থেকে। মাঝে মাঝে খসে পড়ে গুহার মেঝেতে।
গ্রীষ্মের চেয়ে শীতকালেই বেশি পর্যটক দেখতে আসেন গুহাগুলি। কিন্তু ইচ্ছা করলেই গুহায় যাওয়া যায় না। তীর থেকে গুহা পর্যন্ত রুটে জমা বরফ, পরীক্ষা করেন অ্যাপোস্টেল আইল্যান্ড ন্যাশনাল লেক-শোরের কর্মীরা। বেশ কয়েকদিন ধরে পরীক্ষা চালিয়ে, বরফের স্থায়ীত্ব ও ভারবহন ক্ষমতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া পর গুহাগুলিতে যাওয়া দিন ঘোষণা করা হয়।
তবুও গুহাগুলির কাছে যাওয়া সবসময়ই বিপজ্জনক। কারণ, প্রবল বাতাসের ধাক্কায়, বরফের নীচের জলেও ঢেউ উঠতে পারে। ফেটে যেতে পারে বরফের স্তর। বিপদে পড়তে পারেন পর্যটকেরা। তাই রোজই বরফ পরীক্ষা করা হয়। পর্যটকদের জন্য প্রস্তুত থাকে উদ্ধারকারী দল ও হেলিকপ্টার।
লেক সুপিরিয়রের বরফমোড়া গুহাগুলিতে যাওয়ার আদর্শ জায়গা হলো, আমেরিকার বেফিল্ড কাউন্টির মেয়ারস বিচ। এই মেয়ারস বিচের গায়ে লেগে থাকা মেয়ারস রোডের শেষপ্রান্ত থে্কে, প্রথম গুহাটির দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়। কিন্তু শক্ত ও এবড়ো খেবড়ো বরফের ওপর থেকে হাঁটার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।
পরতে হবে গরম পোশাক, কালো কাঁচের গগলস ও স্নো বুট। বুটের তলায় পরতে হবে কাঁটামারা ধাতব ফ্রেম বা ক্রাম্পন। হাতে নিতে হবে আইস স্টিক। গুহাগুলিতে যাওয়ার সব সরঞ্জাম ভাড়া পাওয়া যায় স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্সিতে। গুহাগুলিতে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হলো ‘স্কিয়িং’। কিন্তু যাঁরা স্কি করতে পারেন না, তাঁদের হেঁটেই যেতে হবে। সঙ্গে নিতে হবে পর্যাপ্ত জল,খাবার ও ওষুধ। কারণ বরফে থাকতে হবে ঘন্টা সাতেক।
গুহা দেখতে যাওয়ার আগে পাঁচ ডলার প্রবেশমূল্য দিয়ে যেতে হয়। যে সব পর্যটকেরা গাইড ছাড়া যান, তাঁদের বার বার অনুরোধ করা হয়, অতিউৎসাহী না হওয়ার জন্য। রুটে থাকা বরফের ফাটল সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বলা হয়। জানিয়ে দেওয়া হয়, গুহার ছাদ থেকে যখন তখন খসে পড়তে পারে বরফের চাঁই।
গুহামুখগুলি দিয়ে হিমশীতল ঝোড়ো হাওয়া প্রবেশ করে, আইসিকল বা বরফের চাঁই খসিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে অনেক। বেপরোয়া কিছু পর্যটকও দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসেন প্রতিবছরেই। তবুও পর্যটকের সংখ্যা কমে না, প্রতিবছর বেড়েই চলে। কারণ, দুর্ঘটনা ও মৃত্যু সারা বিশ্বের অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় পর্যটকদের ভয় দেখিয়েছে। কিন্তু পায়ে আতঙ্কের বেড়ি পরিয়ে, ঘরে বেঁধে রাখতে পারেনি।