এই অতিমারি সময়ে অর্ধেক দর্শক নিয়েও ভালো ব্যবসা করছে 'টনিক'। কী করে?স্বপ্নপূরণের স্বপ্ন দেখালেন পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। 'টনিক' দেব দেখালেন পথ। কেমন সে পথ? পর্দার চরিত্রদের সঙ্গে পথ হেঁটে সেই সাফল্যের চাবিকাঠি খুঁজলেন সোমা লাহিড়ী।সেদিন হল থেকে বেরনোর সময় নিজের অজান্তেই গুনগুন করছিলেন একজন প্রবীণ দর্শক 'ও টনিক তুমি জিতে যাও লটারি, ও টনিক...', পেছনে এক দল কলেজ পড়ুয়া হইহই করছিল 'নো প্যনিক ওনলি টনিক'। এতটাই একাত্মতা! ইদানীংকালের কোনও বাংলা ছবি এভাবে আকৃষ্ট করেছে কি মানুষকে? টনিকের ভরসায় পরাণদা যত রোমাঞ্চকর অভিযানে পা বাড়িয়েছেন, দর্শক তত উত্তেজিত হয়ে হাততালি দিয়েছে। যেন ছবি নয়, চোখের সামনে ঘটছে সব কিছু। যেকোনও বিনোদন মাধ্যমের সাফল্যর প্রথম কথা হল দর্শকের সঙ্গে এই সংযোগ। এখানেই 'টনিক' ফার্স্ট-ক্লাস মার্কস পেয়ে গেছে।
হাসতে হাসতে টনিক সুধা পান !!হাসতে হাসতে যে এমন গভীর কথা বলা যায়, হাসতে হাসতে যে এমন মাঝ-হৃদয় ছোঁয়া যায়, হাসতে হাসতে যে নিজেকে এমন কাটাছেঁড়া করা যায়, তা দেখিয়ে দিল 'টনিক'। একটা আদ্যোপান্ত পারিবারিক ছবি। ঘরোয়া মেজাজে গল্পের বুনন। ছোট বড় সবাই মিলে একসঙ্গে উপভোগ করার ছবি 'টনিক'। মুক্তি পেয়েছে ২৪ ডিসেম্বর। অতিমারী-পরবর্তী সময়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ধুঁকছে। 'টনিক' যেন মৃতসঞ্জীবনী সুধার কাজ করল। কোভিড-বিধি মেনে হাউসফুল প্রতিটা শো। এই আতঙ্কের দিনেও হাসতে হাসতে টনিক-সুধা পান করছেন দর্শক। কিন্তু কেন?
মজার মোড়কে এগিয়েছে সহজ সরল গল্পকাহিনির সরল বুনন তরতর করে এগিয়ে নিয়ে চলে দর্শককে। ছেলে, বউমা, নাতনি আর স্ত্রীকে নিয়ে ভরপুর সংসার জলধর সেনের। কিন্তু মনের কোথায় যেন একটা চাপা অভিমান গুমরে আছে। বন্ধুর বিবাহবার্ষিকীতে মাঝগঙ্গায় স্টিমার পার্টি। পার্টি থেকে ফিরে জলধরবাবুর মনে সাধ তাঁদের বিবাহবার্ষিকীটা যেন আরও জম্পেশ করে হয়। যখন তিনি বিদেশে ডেস্টিনেশন অ্যানিভার্সারির স্বপ্ন দেখছেন, ঠিক তখনই ছেলে ঘোষণা করে ছাদে প্যান্ডেল খাটিয়ে বাবা -মা'র বিবাহবার্ষিকী পালন করবে। ব্যাস, জলধরবাবুর আত্মসম্মানে আঘাত। তখনই ছেলে-বউমাকে না জানিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে প্যারিস যাত্রার প্ল্যান, পাসপোর্ট তৈরি নিয়ে সমস্যা, শেষে ডেস্টিনেশন বদল। দার্জিলিং। পাহাড়ি শহরে যত্ন করে সব আমোদ আয়োজনের ব্যবস্থা করে দেন পর্যটন সংস্থার কর্মী 'টনিক'।খরস্রোতা নদীতে রাফটিং থেকে শুরু করে রক ক্লাইম্বিং, প্যারাগ্লাইডিং থেকে সুরা পান, হোটেলে অ্যানিভার্সারির পার্টিতে নাচগান- কিচ্ছু বাদ নেই টনিকের ব্যবস্থাপনায়। ওদিকে বাড়িতে ছেলে-বউমার চিন্তা, কান্নাকাটি, থানা-পুলিশ, টেনশন। তারপর? জানতে গেলে দেখতে হবে টনিক। পরিচালক অভিজিৎ সেনের হাত ধরে খুব সহজ ছন্দে এগিয়েছে গল্প। সবটাই মজার মোড়কে। বেঙ্গল টকিজের কর্ণধার অতনু রায়চৌধুরীর সঙ্গে ছবির গল্প লিখেছেন পরিচালক।
অভিনয়, যেন অভিনয় নয়পরাণদাকে দিয়েই শুরু করি। কারণ এ ছবির প্রাণপুরুষ তিনি। তিনিই হিরো। তাঁর সুখ দুঃখ, মান অভিমান, হাসি-কান্না ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে সব চরিত্র। আশি বছর বয়সে কোনও মানুষ যে এতটা রিস্ক নিতে পারেন শুধু অভিনয়ের জন্য তা ভাবা যায় না। উত্তরবঙ্গের খরস্রোতা নদীতে রাফটিং, প্যারাগ্লাইডিং এবং রক ক্লাইম্বিংয়ের মতো কঠিন স্পোর্টস কী অবলীলায় করলেন পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তা না দেখলে বিশ্বাস হবে না। কোথাও কৌতুক সংলাপ, কোথাও শুধু অভিব্যক্তি, কোথাও জেদ, আবার কোথাও পিতার অভিমান অশ্রু হয়ে ঝরেছে ঝরঝর করে। একে অভিনয় ভাবতে কষ্ট হয়। আমাদের সবার বাড়িতেই যে এমন বাবা আছেন। ছেলের ওপর অভিমানে যাঁদের বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না।
মায়ের চরিত্রে শকুন্তলা বড়ুয়া। মোটাসোটা গিন্নিবান্নি চেহারা, আদরের নাতনি, ছেলে বউমা, স্বামী-সংসার নিয়ে দিন চলে যায়। আলাদা করে নিজের কথা ভাবেন না। স্বামীর সঙ্গে প্রথম পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে তিনিই আবার অন্য মানুষ। চরিত্রের প্রতিটা রং অভিনয়ের গুণে রামধনুর মতো আবিষ্ট করেছে দর্শককে।
এবার টনিক দেবের কথা। নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে যে কতো দূর নিয়ে যাওয়া যায়, কতটা পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় যে পাহাড় চুড়োয় পৌঁছে দিতে পারে একজন অভিনেতাকে, তা করে দেখিয়েছেন দেব। 'পাগলু' থেকে 'টনিক'-এ উত্তরণ এক লাফে হয়নি। 'বুনো হাঁস' থেকে দেবের অভিনয় নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট শুরু। এরপর তথাকথিত কমার্শিয়াল নয় এমন বেশ কয়েকটা ছবিতে কাজ করেছেন দেব। তবে এ পর্যন্ত তাঁর করা চরিত্রদের মধ্যে সেরা টনিক। সরল, সাদাসিধে, প্রাণবন্ত, ভালোবাসায় ভরপুর টনিক শুধু জলধর সেনেরই নয়, দর্শকেরও কাছের মানুষ হয়ে উঠেছে। টনিক যেন 'গল্প হলেও সত্যি'র সেই মুশকিল-আসান রবি ঘোষ অভিনীত চরিত্রটি। সে স্বপ্নপূরণ করিয়ে নিতে জানে।
প্রকৃতির অসামান্য রূপ দেখিয়েছে ক্যামেরাদার্জিলিং, উত্তরবঙ্গ ভ্রমণপিপাসু মানুষকে হাতছানি দিয়েছে বারবার। পাহাড়ের রানি এখন সেজেছে আরও সুন্দর করে। টনিকে সুপ্রিয় দত্তর ক্যামেরা উত্তরবঙ্গ আর দার্জিলিংকে এতো সুন্দর করে দেখিয়েছে যে মনে হয় এ যেন বিদেশের কোনও পাহাড়ি শহর। টানটান উত্তেজনার মুহূর্তগুলোও ক্যামেরায় জীবন্ত করে তুলেছেন সুপ্রিয়।
সুরের জাদুতে মুগ্ধ আট থেকে আশি
অতিমারির আবহে মন যখন নিস্তেজ, তখন জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সুর দর্শকের প্রাণে এনেছে খুশির জোয়ার। সব নেগেটিভিটি নিমেষে উধাও হয়ে যায় কথা ও সুরের ম্যাজিকে। অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, অনুপম রায়, ইমন চক্রবর্তীর গান সত্যিই ছোট থেকে বড় সবার মন ছুঁয়েছে। ছবিটি দেখে বেরনোর সময় গানের গুনগুনানি অন্তর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে আকাশে।
কমার্শিয়াল ছবির চরিত্র আমূল বদলেছে টনিক
কমার্শিয়াল ফিল্ম আর অন্য ধারার ছবির মধ্যে একটা বিশাল ফারাক ছিল বহুদিন। কমার্শিয়াল ফিল্ম মানেই মাচো হিরো আর ঝিনচ্যাক হিরোইন চাই। নাচাগানা, ধুন্ধুমার লড়াই, ভিলেনের চোখরাঙানি, আরও নানান হাবিজাবি মশলায় ভরপুর প্যাকেজ। আর অন্য ধারার ছবি মানে জীবনের গল্পের রূপায়ণ। বেশ কিছুদিন ধরেই এই দুটো স্ট্রিমের দূরত্ব কমছিল। তবে 'টনিক' আমূল বদলে দিল কমার্শিয়াল ছবির চরিত্র। এ ছবির নায়ক কে? পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় না সুপারস্টার দেব? নাকি দুজনেই? নায়ক নায়িকার জুটি নয়, পরাণ-দেব জুটিই বাংলা ছবির দুনিয়ায় নতুন জুটি। এ ছবিতে একজন ছাড়া অন্যজন অসম্পূর্ণ। তাঁদের হাসিকান্না ঘিরেই দর্শক হেসেছেন, কষ্ট পেয়েছেন, তাঁদের জিতেই হাততালি দিয়ে হলে ঝড় তুলেছেন। এ জুটিকে আবার চান দর্শক অন্য গল্পে অন্য আঙ্গিকে।