'যত বার দেখি মা গো তোমায় আমি', লতার সেই অপাপবিদ্ধ মায়ের গানে আজও সমৃদ্ধ বাংলা
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
'ভয় পেলে ব্যথা পেলে মুখে আসে মা,
সুখেতে দুঃখেতে মুখে আসে মা।
তোমার আঁচলতলে স্বর্গেও সুখ মেলে,
তার চেয়ে আনন্দ মা ডেকে
যত বার দেখি মা গো তোমায় আমি...'
১৯৮৯ সালের মাল্টিস্টারার বাংলা ছবি 'তুফান'। চিরঞ্জিত, তাপস পাল, অভিষ
'ভয় পেলে ব্যথা পেলে মুখে আসে মা,সুখেতে দুঃখেতে মুখে আসে মা।তোমার আঁচলতলে স্বর্গেও সুখ মেলে,তার চেয়ে আনন্দ মা ডেকেযত বার দেখি মা গো তোমায় আমি...'
১৯৮৯ সালের মাল্টিস্টারার বাংলা ছবি 'তুফান'। চিরঞ্জিত, তাপস পাল, অভিষেক চট্টোপাধ্যায়, নয়না দাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, ইন্দ্রাণী দত্ত, শকুন্তলা বড়ুয়া ও দিলীপ রায় অভিনীত ছবি। অ্যাকশনধর্মী ছবিটিতে ছিল টানটান চিত্রনাট্য এবং দমদার অভিনয়। কিন্তু 'তুফান' এই মেনস্ট্রিম ছবিটিকে স্বর্গীয় উচ্চতায় তুলে দিল লতা মঙ্গেশকরের গান। 'যত বার দেখি মা গো তোমায় আমি'।
আশি নব্বই দশকে 'মাদারস ডে' পালন বাঙালির ইভেন্ট হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এই লতাজির গান যেন মায়েদের আইকনিক গান হয়ে উঠল। আজও এই গানের অপাপবিদ্ধতা এতটুকু ম্লান হয়নি। কিছু গান আছে যে গানগুলো লতা মঙ্গেশকরকে ছাড়া ভাবাই যায় না এই গানটি তেমনই। আশির দশকের শেষে তখন লতা মঙ্গেশকর বাংলা ছবিতে গান করা কমিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু 'তুফান' ছবিতে গাইলেন দুটি গান। সংগীত পরিচালক স্বপন চক্রবর্তীর অনুরোধে।
'যত বার দেখি মা গো তোমায় আমি' আর 'ঝড়ের হাওয়ায় ছিন্ন পাতায়', দুটো গানই সুপারহিট।আদর্শ বম্বের ছবির ফর্মুলা মেনেই তৈরি হয়েছিল 'তুফান'। দুর্ঘটনায় তিন ভাইয়ের ছোটবেলায় হারিয়ে যাবার গল্প। তিনজন অনাথ হয়ে গেলেও তাঁরা নতুন করে বাবা-মা খুঁজে পেল, যাঁদের সঙ্গে তাদের ধর্মও আলাদা। সত্যি কি 'তুফান' কোনও হিন্দি ছবি থেকে প্রভাবিত হয়েই বানানো? 'তুফান' দেখতে গিয়ে আজীবন এ প্রশ্নই মাথায় খেলেছে দর্শকদের।
'তুফান' ছবির পরিচালক বীরেশ চট্টোপাধ্যায় 'দ্য ওয়াল' কে এক্সক্লুসিভলি বললেন, "লতাজিকে স্বচক্ষে গান রেকর্ডিং করতে আমি দেখেছি অনেক আগেই। তখন আমি বম্বেতে হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের সহকারী পরিচালক। 'অভিমান' ছবিতে জয়াজির (বচ্চন) লিপে লতাজি গান গাইতে এলেন। সংগীত পরিচালক শচীন দেব বর্মণ। শচীন দেব আর রাহুল দেব দুজনেই সেখানে উপস্থিত। লতাজি গানে যত মুড়কি করছেন শচীনদা মুখটা খুব বিকৃত করে 'ইশশশশ ইশশশশ' করছেন। অর্থাৎ শচীনদার সুরের অতিরিক্ত লতাজি নিজের স্টাইলে অসাধারণ গাইছেন।
https://youtu.be/DLmmjJbl90k
কিশোর কুমার, লতাজি, শচীন দেব বর্মণের গান শোনা শুধু নয়, তাঁরা ব্যক্তিগত যেসব মজাগুলো করতেন, সেগুলোও সম্পদ হয়ে আছে আমার মনে। 'অভিমান'-এর প্রত্যেকটা গান হিট, যে ছবির গান আজও সেরা। অমিতজি আর জয়াজির জুটি পূর্ণতা পেল এই ছবিতে।
এরপর আমার 'মোহনার দিকে', 'একান্ত আপন', 'আশীর্বাদ'-- এসব সুপারহিট ছবি রিলিজ করে গেছে। আজ এটা স্বীকার করতে অসুবিধে নেই, আমার এক বন্ধু বললেন, 'ইয়াদো কি বরাত ছবিটার উপর একটা বাংলা ছবি করলে কেমন হয়?' সেখানে উপস্থিত ছিলেন আমাদের প্রযোজক রথীন মজুমদার। তিনি শুনেই বললেন 'হ্যাঁ, বীরু লিখে ফেলো। এটা বাংলায় করলে কর্মাশিয়ালি ভালো সাকসেস হবে কিন্তু।'তাই 'ইয়াদো কি বরাত'-এর কিছুটা প্রভাব তো অবশ্যই আছে। এখই ফর্মুলার গল্প, কিন্তু বাংলা মোড়কে। তিন ভাই ছোটবেলায় আলাদা হয়ে গেল। তারপর বড়বেলায় তাদের দেখা হলেও কেউ কাউকে চিনতে পারে না। পরে সব একত্রিত হল। মা-বাবাকেও ফিরে পেল। মায়েরও স্ট্রাগলের গল্প। হারানো সম্পর্ক ফিরে পাওয়ার গল্প এবং যে ভিলেনের জন্য তারা আলাদা হয়েছিল তাঁকে জব্দ করার গল্প।
লতাজি 'তুফান' ছবিতে গেয়েছিলেন, সেটা আমার বড় প্রাপ্তি। আশাজি ভোঁসলে আমার ছবিতে প্রচুর হিট গান গেয়েছেন। আশাজিকে পাওয়া অনেক সহজতর ছিল লতাজির চেয়ে। লতাজি গাইতে রাজি হয়েছিলেন সংগীত পরিচালক স্বপন চক্রবর্তীর কথায়। স্বপন চক্রবর্তী ছিলেন রাহুল দেব বর্মণের সহকারী। পরে নিজে সুরকার গীতিকার হন। বাংলা ছবিতে স্বপন চক্রবর্তীর সব হিট গান আমার ছবিতেই।
https://youtu.be/y9EiNUNotYs
ওঁর সঙ্গে লতাজি, আশাজি সবার হৃদ্যতা ছিল। লতাজি 'যত বার দেখি মা গো তোমায় আমি' আর 'ঝড়ের হাওয়ায় ছিন্ন পাতায়' দুটো গানই বম্বেতে রেকর্ড করেন। লতাজি ছবিতে গাইলে সেই ছবির ব্র্যান্ড ভ্যালু অনেক বেড়ে যায়। লতাজির পারিশ্রমিক অনেক হলেও উনি বাংলা ছবিকে ভালবেসে কম পারিশ্রমিকেও কিছু ক্ষেত্রে গেয়ে দিতেন। একসময় যেমন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথাতে লতাজি প্রচুর বাংলা ছবিতে গেয়েছেন। পরে আর ডি বর্মণ।'তুফান' ছবিতে অভিনেত্রী ইন্দ্রাণী দত্তর রোলটায় খুব কিছু একটা করার ছিল না। কিন্তু লতাজির গান ওঁর লিপে থাকায় ইন্দ্রাণীর সারা জীবনের আইকনিক গান হয়ে গেল।"
যে মাকে এই গানের দৃশ্যায়নে দেখানো হয় সেই চরিত্রে অভিনয় করেন শকুন্তলা বড়ুয়া। তিনি বললেন, "গানটা ছিল আমার জন্য ইন্দ্রাণী দত্ত গাইছেন। আজ সকাল থেকে যতবার লতাজির প্রয়াণের খবর শুনছি, টিভিতে দেখছি ওঁর শেষবিদায়, ততবারই মনে আসছে 'যত বার দেখি মা গো তোমায় আমি' গানটা। মনের মধ্যে এই গানটাই ঘুরছে। সত্যি সত্যি তো আমার লতা মঙ্গেশকরকে মায়ের জ্ঞানেই দেখেছি। সরস্বতী মা। যতই শুনি সাধ মেটে না।'তুফান' ছবিতে আমার মায়ের রোলটাও খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। দর্শকদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তবে মায়ের রোল হিট করায় বেশিরভাগই মায়ের পার্ট আসত আমার কাছে। যদিও আমি কোনও দিন মায়ের চরিত্র বা নায়িকার চরিত্র ওভাবে ভাবিনি। চরিত্রটা কী বলছে, তার কতখানি গুরত্ব, সেটা ভেবেই চিরকাল করেছি। বীরেশ চ্যাটার্জীর 'একান্ত আপন'-এ আমার করা অপর্ণা সেনের বান্ধবীর চরিত্রও খুব হিট করেছিল। তরুণ মজুমদার 'আপন আমার আপন'-এ আমার মায়ের রোল দেখে বলেছিলেন, 'এই রোল আপনার জীবনে সারা জীবন আইকনিক হয়ে থাকবে লিখে দিলাম।' বদ্ধ উন্মাদিনীর চরিত্র ছিল। সেটাও মানুষের মনে রয়ে গেছে।
তবে সিনেমায় আমার জন্য রাখা গানে লতাজির কণ্ঠ, এ প্রাপ্তির কোনও তুলনা হয় না।"