
রূপাঞ্জন গোস্বামী
ম্যালোরি, মামেরি, মেসনার, কুকুজকা, বুক্রিভ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের উয়েলি স্টেক, কামি রিতা শেরপা, নির্মল পুর্জা সহ বহু দুঃসাহসী পর্বতারোহীকে দেখেছে পৃথিবী। পর্বতারোহণের ইতিহাসে পরতে পরতে নতুন অধ্যায় যোগ করেছেন তাঁরা। কিন্তু এই সৃষ্টিছাড়া পর্বতারোহীকে একডাকে সারা বিশ্ব না চিনলেও, তাঁকে বাদ দিলে পর্বতারোহণের ইতিহাসে দুঃসাহসীদের তালিকা হয়তো অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। প্রয়াত এই সুইডিশ মাউন্টেনিয়ার লার্স ওলফ গোরান ক্রপ মারা যান মাত্র ৩৫ বছর বয়সে। কিন্তু তিনি এমন কিছু পর্বতাভিযান করে গেছেন, যা তাঁকে পর্বতারোহণের ইতিহাসের নক্ষত্রদের পাশে ঠাঁই দিয়েছে।

১৯৬৬ সালে জনকোপিং-এ জন্ম নেওয়া এই চরম ডাকাবুকো অভিযাত্রী মাত্র ৬ বছর বয়েসে, ১৯৭২ সালে তাঁর আইনজীবী বাবার সঙ্গে আরোহণ করেছিলেন নরওয়ের উচ্চতম শৃঙ্গ গালদোপিগেন (Galdhøpiggen)। ৮১০০ ফুট উঁচু সে শৃঙ্গে আরোহণের জন্য পেরোতে হয়েছিল গ্লেসিয়ার। শিশু গোরানের শৃঙ্গ আরোহণকে তারিফ করেছিলেন অভিজ্ঞ পর্বতারোহীরাও। পর্বতারোহণের নেশা মাথায় চেপেছিল তখন থেকেই।
পড়াশোনার ফাঁকেই পর্বতারোহণের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন গোরান। ১৮ বছর বয়েসে যোগ দিয়েছিলেন সুইডিশ মিলিটারির প্যারাসুট রেঞ্জার্স টিমে। বিমান থেকে ঝাঁপ দিয়ে প্যারাসুট না খুলে, হাজার হাজার ফুট উল্কার গতিতে নেমে এসে মাটি থেকে মাত্র কয়েকশো ফুট ওপরে প্যারাসুট খুলতেন তিনি। আতঙ্কে সিঁটিয়ে থাকতেন তাঁর ট্রেনাররাও। রেঞ্জার্স টিমের সেরা স্টান্টম্যান গোরান ক্রপের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ভবিষ্যতের ক্লাইম্বিং পার্টনার ম্যাটস ডালিনের। তিনিও ছিলেন প্যারাসুট রেঞ্জার্স টিমে।
দু’জনের ইচ্ছে ছিল একই। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন শৃঙ্গগুলি ভিন্ন ভাবে আরোহণ করবেন। রুট নিয়ে বেশি পরিকল্পনা করবেন না। আরোহণের সময় যখন যেমন বাধা যেভাবে আসবে, সেই সময়ে সিদ্ধান্ত নিয়েই বাধা পেরিয়ে যাবেন। গাইড ছাড়াই নূন্যতম খাবার ও সরঞ্জাম নিয়ে আরোহণ করবেন। সঙ্গে নেবেন না কৃত্রিম অক্সিজেন। রোপ বাদ দিয়ে ব্যাকপ্যাকের মোট ওজন পাঁচ কেজির বেশি হবে না।

সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা মেনে নিজেদের প্রস্তুতির জন্য সময় বের করে নিতেন তাঁরা। ৩০ কেজি ওজন পিঠে নিয়ে ভোর চারটেয় বেরিয়ে পড়তেন। সাতটার মধ্যে ৪০ কিলোমিটার পথ হেঁটে ফিরে আসতেন। এর সঙ্গে ছিল পাহাড়ি রাস্তায় সাইকেল চালানো আর বরফ জমা নদীতে স্নান। কখনও কখনও সারাদিন না খেয়ে এই শিডিউল মানার চেষ্টা করতেন। শরীর চলবে তাঁর ইচ্ছায়– এটাই ছিল তাঁর নীতি।
হিমালয়ে আসার আগে ১৯৮২ সালে তাজিকিস্তান ও কিরগিজস্তানের সীমান্তে অবস্থিত লেনিন পিক (৭১৩৪ মি) রেকর্ড সময়ে আরোহণ করেছিলেন গোরান। সাত বছর ধরে নিজেকে তৈরি করে, ১৯৮৯ সালে পৃথিবীর ষষ্ঠ উচ্চতম শৃঙ্গ চো ইয়ু (৮২০১ মি) আরোহণের জন্য আবেদন করেছিলেন। অনুমতি না পেয়ে দুই বন্ধু চলে গিয়েছিলেন দক্ষিণ আমেরিকা। সেখানে একের পর এক আরোহণ করেছিলেন ইলিনিজা সার (৫২৬৬মি) কোটোপাক্সি (৫৮৯৭ মি), ইলিমানি (৬৩০০ মি), হুয়ায়না (৬০৯৫ মি) ও ইল্লামপু (৬৫২০ মি) শৃঙ্গ। প্রত্যেকটা শৃঙ্গ অভিযানের সময়ে বেসক্যাম্প থেকে শৃঙ্গ হয়ে বেসক্যাম্প ফেরার জন্য মাত্র ২ কেজি খাবার সঙ্গে রাখতেন।
১৯৯০ সালে পাকিস্তানে এলেন গোরান। আরোহণ করলেন পৃথিবীর অন্যতম কঠিন শৃঙ্গ মুজাতাঘ টাওয়ার (৭২৭৩ মি)। তিনিই বিশ্বের চতুর্থ আরোহী, যিনি এটা ক্লাইম্ব করেন। সঙ্গে ছিলেন ডেনিস ক্লাইম্বার রাফায়েল জেনসন। ১৯৯১ সালে কিরগিজস্তানের পিক পোবেডা (৭৪৩৯ মি) আরোহণ করতে এসেছিলেন বন্ধু ম্যাটস ডালিনের সঙ্গে। গোরান শৃঙ্গে আরোহণ করলেও ডালিন পারেননি।
১৯৯২ সাল, অবশেষে চো ইয়ু আরোহণের অনুমোদন পেলেন গোরান। আরোহণের প্রস্তুতিপর্বে ফ্রান্সের ইগুইল ভের্তে (৪১২২মি) আরোহণ করতে গিয়ে মাথায় পাথর পড়ে মারা গিয়েছিলেন সঙ্গী ডালিন। বন্ধুকে হারিয়ে শোকস্তব্ধ গোরান শপথ নিয়েছিলেন, বন্ধুর যেসব শৃঙ্গ আরোহণের ইচ্ছা ছিল, সেই সব ক’টি শৃঙ্গ আরোহণ করবেন বন্ধুর ছবি নিয়ে। বন্ধুকে কথা দিয়েছিলেন দু’জনে গাড়ি চালিয়ে নেপাল যাবেন।

সুইডেন থেকে ১৩ হাজার কিলোমিটার পথ রেঞ্জ রোভার চালিয়ে গোরান এসেছিলেন নেপালে। চো ওইয়ু আরোহণ শুরু করেছিলেন। বেসক্যাম্প থেকে সামিট, সারাটা পথ বন্ধু ডালিনের অশরীরী অস্তিত্বের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, হাসিমস্করা করতে করতে শৃঙ্গে আরোহণ করলেন। অন্য আরোহীরা তাঁকে দেখে বেসক্যাম্পে নাকি খবর পাঠিয়েছিলেন, এক পাগল একা একা চো ইয়ুর মাথায় উঠে পড়েছেন। শৃঙ্গে আরোহণ করে গোরান বরফে পুঁতে দিয়েছিলেন বন্ধু ডালিনের আইস অ্যাক্স। বন্ধুর ছবিটা এমন ভাবে রেখেছিলেন, যাতে বন্ধু এভারেস্টকে দেখতে পায়। সেটাই ছিল দু’জনের স্বপ্ন।
১৯৯৩ সালে মিলিটারির চাকরি ছেড়ে K2 ক্লাইম্ব করবেন বলে গিয়েছিলেন পাকিস্তানে। সুইডিশ অভিযানে অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ ছিল। কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন বাকি সুইডিশদের প্রচুর সময় লাগবে আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে। অন্যদিকে K2 ক্লাইম্ব করার জন্য তাঁর শরীর ও মন তৈরি। নুন্যতম রসদ নিয়ে একাই উঠে গেলেন শৃঙ্গে। প্রথম সুইডিশ হিসেবে আরোহণ করলেন বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ K2 ওরফে গডউইন অস্টিন(৮,৬১১ মি) , কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়াই।
১৯৯৪ সালে আবার ফিরে এসেছিলেন কারাকোরামে। পৃথিবীর দ্বাদশ উচ্চতম শৃঙ্গ ব্রড পিক (৮০৫১ মি) আরোহণের উদ্যেশ্যে। তখনও পর্যন্ত দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিম রুটটি দিয়ে কেউ ব্রড পিক আরোহণ করেননি। সেই দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা চালিয়ে বিফল হওয়ার পর নরম্যাল রুটে নন-স্টপ সোলো ক্লাইম্ব করে ব্রড পিকের শীর্ষ ছুঁলেন।
এভারেস্ট আরোহণের অদম্য ইচ্ছা, কিন্তু শয়ে শয়ে অভিযাত্রী এভারেস্ট আরোহণ করছেন, তাই এভারেস্টের প্রতি কৈশোরের আকর্ষণ কমে গিয়েছিল বড় হয়ে। এক দিন গোরানের মাথায় এসেছিল, বাসি রান্নাতেও মসলা মিশিয়ে স্বাদের পরিবর্তন আনা যায়। তাছাড়া এমনিতেই গোরান সব সময় সব বিষয়ে ছিলেন চরমপন্থী। যতরকম ভাবে সম্ভব নিজের শারীরিক সক্ষমতাকে পরীক্ষায় ফেলে দিতেন। গোরান এক অকল্পনীয় এভারেস্ট অভিযানের প্ল্যান করেছিলেন। সুইডেন থেকে ১৩ হাজার কিলোমিটার পথ সাইকেলে চড়ে যাবেন নেপাল, চড়বেন এভারেস্ট, আবার অতটা পথ ফিরবেন সাইকেলে।

১০৮ কেজি সরঞ্জাম ও খাবার বোঝাই করা বস্তা সাইকেলে চাপিয়ে ১৯৯৫ সালের ১৬ অক্টোবরে বিশেষভাবে ডিজাইন করা ক্রিসেন্ট আলটিমা বাইসাইকেল চেপে দেশ ছেড়েছিলেন গোরান। ১৩ হাজার কিলোমিটার পথ উজিয়ে ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে এসে পৌঁছলেন এভারেস্ট বেসক্যাম্পে। তাঁর শৃঙ্গ আরোহণ করার কথা ছিল ৩ মে। সেবার এভারেস্টের বরফ তেমন গলেনি। তবুও পৌঁছে গেছিলেন এভারেস্টের সাউথ সামিটে। এভারেস্ট শৃঙ্গ বেশি দূর ছিল না। কিন্তু গোরানের ঘড়ি বলছিল সময় পেরিয়ে গেছে। এর পর এভারেস্ট শৃঙ্গের দিকে গেলে বিপদ ঘটবে। তাই ফিরে এলেন বেসক্যাম্পে।
মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে, ১০-১১ মে, এভারেস্টে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এক ভয়ঙ্কর তুষার ঝড়। লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল এভারেস্টের আঙিনা। আরোহণ করে ফেরার পথে প্রাণ হারিয়েছিলেন আট পর্বতারোহী। বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকে পড়েছিলেন প্রচুর পর্বতারোহী। চুলোয় যাক নিজের আরোহণ, গোরান ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন উদ্ধারকার্যে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্যাম্পে ক্যাম্পে ওষুধ পৌঁছে দিয়েছিলেন। অভিযাত্রীদের নামিয়ে নিয়ে এসেছিলেন রেসকিউ টিমের শেরপাদের সঙ্গে। এর পরেও ২৩ মে একা আরোহণ করেছিলেন এভারেস্ট শৃঙ্গে, সাপ্লিমেন্টরি অক্সিজেন ছাড়াই। তারপর ফিরে গিয়েছিলেন সুইডেন। সেই ১৩ হাজার কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে।

যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কেন সাইকেলে এলেন?
বলেছিলেন, “আমি এমনই অ্যাডভেঞ্চার চেয়েছিলাম যেটা আগে কেউ করেনি।”
এহেন দামাল পর্বতারোহী প্রাণ হারালেন পাহাড়েই। ২০০২ সালে সেন্ট্রাল ওয়াশিংটন স্টেটের Frenchman Coulee নামে একটি গিরিখাতের Air Guitar রুট আরোহণ করতে গিয়েছিলেন। এর আগে এখানেই অজস্র কঠিন রুটে নিয়মিত ওঠানামা করেছেন। কিন্তু ৩০ সেপ্টেম্বর দিনটি গোরানের সঙ্গে ছিল না। ক্যারাবিনার ভেঙে, পিটন উপড়ে ৬০ ফুট নীচে পড়ে যান গোরান। প্রাণ হারান ঘটনাস্থলেই। ৩৫ বছরের এক রুদ্ধশ্বাস জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে অকল্পনীয় ভাবেই।

গোরান বাঁচলে হয়তো আরও অনেক অবিশ্বাস্য অভিযান দেখত পৃথিবী। লোকে তাঁকে বলত ‘খ্যাপা সুইডিশ‘, তবুও তাঁর এই খ্যাপাটেপনাই যুগ যুগ ধরে বর্তমানের অভিযাত্রীদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। কারণ গোরান ক্রপ পৃথিবীকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, খ্যাপারাই স্বাদহীন পৃথিবীতে বৈচিত্র আনেন শতাব্দীর পর শতাব্দী। তার সাক্ষী ইতিহাস।