
শাশ্বতী সান্যাল
ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র- সবাই একদিন খারিজ করেছিল তাঁকে। কিন্তু সাহিত্যিকের কাজ শুধু সময়ের কাছে একনিষ্ঠ থাকা। সেই সময়ের জীবন্ত বাস্তব দলিল তুলে ধরা। সে বাস্তব যদি খারাপ হয়, অশোভন হয়, অশ্লীল হয়, তবু সেই বাস্তবকে নগ্নভাবে লিখে রাখাই সাহিত্যিকের একমাত্র সত্যি। মান্টো আজীবন বিশ্বাস রেখেছেন সেই সত্যে। এই বাইরের সমাজ, সংসার তার গলায় ফুলের মালা দিল, না জুতোর মালা- তাতে কিছু আসে যায় নি সাদত হাসান মান্টোর।



এভাবেই একটু একটু করে বিশ্বসাহিত্যের কাছাকাছি চলে এসেছিলেন মান্টো। এর পরেই তিনি ইন্ডিয়ান প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশনের সদস্য হয়ে ওঠেন। আলাপ হয় লেখক আলি সর্দার জাফরির সাথে। উর্দুভাষাতেই শুরু হয় নিজের লেখালিখি৷ ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি থেকেই গল্পকার হিসাবে পায়ের তলার মাটি শক্ত করছিলেন মান্টো। ১৯৪১-১৯৪৩ সালের মধ্যে লিখে ফেললেন বেশ কয়েকটি রেডিও নাটকও। তারপর দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে সপরিবারে লাহোর চলে যান মান্টো। সেখানে বন্ধু হিসাবে পাশে পেয়েছিলেন পাকিস্তানের কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, নাসির কাজমি, আহমেফ রহি’দের।

বিতর্কে জড়িয়েছেন বারবার
বিতর্ক ছায়ার মতো আজীবন তাড়া করেছে বেড়িয়েছে মান্টোকে। অবিশ্বাস্য লাগলেও সত্যি, শুধুমাত্র গল্প লেখার অপরাধে একবার নয়, ছয় ছয়বার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে তাঁকে। বিশেষ ধরণের একদল পাঠক-সমালোচক বারবার আঙুল তুলেছে তাঁর গল্পের দিকে, অভিযোগ এনেছে অশ্লীলতার। ১৯৪৭ এর আগে পরাধীন অবিভক্ত ভারতে বার তিনেক, আর স্বাধীনতার পর নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের মাটিতেও তিনবার একই অভিযোগে আদালতে দাঁড়াতে হয়েছে মান্টোকে। এই সূত্রেই মনে প্রশ্ন জাগে, সত্যিই কি অশ্লীল ছিল মান্টোর গল্প? সাহিত্যে কাকে বলে অশ্লীলতা?

প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক চিন্তার এই উর্দু ছোটোগল্পকারকে তার মুক্তচিন্তার কারণে অপমানিত, লাঞ্ছিত হতে হয়েছে ভারত পাকিস্তান দুই দেশেই। তাঁর লেখা ছোটোগল্পগুলো যেন এক একটি বাস্তবনিষ্ঠ অ্যান্টিরোম্যান্টিক ছবির এলবাম। তাতে ঘুরেফিরে এসেছে দেশভাগ, দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িকতার ছবি। মানুষের ভিতরের জান্তব পাশব আক্রোশকেই খুঁড়ে তুলে এনেছেন গল্পের শরীরে। কম সমালোচনা হয়নি মান্টোর গল্প নিয়ে। তার কাহিনি, ভাষা, চিত্রকল্প, চরিত্রের মনস্তত্ত্ব- সবকিছুর মধ্যেই যে আগুন,তাকে গ্রহণ করার মতো পাঠক বরাবরই কম এই পোড়া দেশে।
আজীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা সাদত হাসান মান্টো’র ক্ষমতা ছিল না আদালতে নিজের সপক্ষে ঠিকঠাক উকিল দাঁড় করানোর। তরুণ-তুর্কি সাহিত্যিকেরা ছাড়া তাঁর পক্ষ নিয়ে কথা বলার লোকও ছিল না বিশেষ৷ থাকবেই না কী করে, বাম বা দক্ষিণ কোনও পন্থাকেই যে রেয়াত করেনি তাঁর কলম। নৈতিক কারণে যখন দক্ষিণপন্থীরা তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, তখনই বামপন্থীরাও মান্টোকে তাঁর নিজস্ব আইডিয়োলজির জন্য দুষতে ছাড়েনি। ‘বু’, ‘কালি সালোয়ার’ বা ‘ঠান্ডি গোস্ত’ এর মতো আধুনিক দৃষ্টিকোণের বিশ্বমানের গল্পকে কাঠগড়ায় তোলা যে একটা জাতির সাহিত্য প্রবণতাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় সেকথা সেই ক্রান্তিকালেও বোঝেননি দেশের নীতিপুলিশেরা। আজও কি বোঝেন!
কেচ্ছা হয়েছে, তবু পাশেই ছিলেন বন্ধু ইসমত চুঘতাই
“আমি ইসমতকে পছন্দ করতাম। সেও আমাকে পছন্দ করত। কিন্তু কেউ যদি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে তোমাদের মধ্যেকার রসায়নটা সঠিকভাবে কীরকম? তোমরা কি একে অন্যকে পছন্দ কর? তাহলে আমি নিশ্চিত নৈঃশব্দ্য ছাড়া আর কিছুই থাকবেনা বলার মতো, অন্তত আমাদের দুজনের কাছে।” — ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইসমত চুঘতাই’কে নিয়ে লিখতে গিয়ে একদা ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলেন সাদত হাসান মান্টো৷ চুঘতাই আর মান্টো’কে নিয়ে গুঞ্জন, ফিসফিস, হাসাহাসি, কথা চালাচালি কম হয়নি সেসময়। শুধু সাধারণ মানুষ বা পাঠকরাই নয়, লেখক-কবিরাও সেই রসিকতায় সমানভাবে অংশ নিয়েছিলেন সেদিন। শোনা যায় হায়দ্রাবাদে প্রগতিশীল লেখকদের একটি সম্মেলনে উপস্থিত মহিলাদের অনেকেই ইসমত চুঘতাই’কে প্রশ্ন করেছিল, মান্টোকে এখনও তিনি বিয়ে করছেন না কেন! প্রশ্নবাণে জর্জরিত হলেও এসব ঠুনকো কথা সচরাচর হেসে উড়িয়ে দিতেই পছন্দ করতেন চুঘতাই। তিনি জানতেন মান্টো আর তাঁর বন্ধুত্ব যে উঁচু তারে বাঁধা তার নাগাল পাওয়া সবার সাধ্য নয়। মান্টো নিজেও স্বীকার করেছেন সে কথা৷ ইসমত চুঘতাই’য়ের আরেক প্রাণের বন্ধু ছিল মান্টোর স্ত্রী সাফিয়া। হায়দ্রাবাদের সম্মেলন শেষে বম্বে ফিরে এসে মান্টোর স্ত্রীকে নিজের অভিজ্ঞতার গল্প শুনিয়েছিলেন চুঘতাই।

লেখক হিসাবে সিরিয়াস হলেও অন্তর্ধর্মে ভারি সরস প্রকৃতির মহিলা ছিলেন চুঘতাই। হায়দ্রাবাদে একজন মহিলা যখন তাকে জিজ্ঞাসা করে মান্টো অকৃতদার কিনা, সে ততক্ষণাৎ জবাব দেয় ‘মোটেও না।’ সে কথা শুনে প্রশ্নকর্তা মহিলাটি না কি একেবারে ভেঙে পড়েন আর চুপ করে যান। এই ঘটনাটার কথা তিনি যে কতবার মজার ছলে মান্টোকে শুনিয়েছেন তার ঠিক নেই। আবার লেখালিখি নিয়ে, জীবনদৃষ্টি নিয়ে, সাহিত্যিকের কর্তব্যবোধ নিয়ে এই মান্টোর সঙ্গেই দিনের পর দিন নানারকম তর্ক হয়েছে চুঘতাইয়ের। পরের দিকে না কি তর্কাতর্কি এড়াতে তাঁরা দিনের পর দিন বাক্যবিনিময়ও বন্ধ রাখতেন। একথা স্বীকার করতেই হবে, নিজে বড়মাপের সাহিত্যিক হয়েও শুরু থেকেই মান্টোর লেখালিখির অন্যতম বড় সমঝদার ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ইসমত চুঘতাই। দুজনেই আজীবন লড়ে গেছেন প্রচলিত সমাজের রক্ষণশীল কাঠামোর বিরুদ্ধে, বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে। বাইরে বাইরে যতই ঝগড়া মনকষাকষি থাকুক না কেন, বোধ আর বোধির পথে তাঁরা অনেকাংশেই ছিলেন একে অন্যের পরিপূরক।
মৃত্যুর এক বছর আগে আচমকা কী খেয়াল হল, লিখে রাখলেন নিজের এপিটাফ। কী লিখেছিলেন সেদিন মান্টো তাঁর নিজের এপিটাফে? লিখেছিলেন, ‘এখানে সমাধিতলে শুয়ে আছে মান্টো, আর তাঁর বুকে সমাহিত হয়ে আছে গল্প বলার সব রহস্য-কৌশল।’ হ্যাঁ, গল্প লেখার কৌশল সত্যিই জানতেন লোকটা। তাঁর সেই ছো্টো ছোটো বারুদভরা গল্পগুলো আপাত নির্লিপ্ত পাঠককেও অপরাধের ভাগীদার করে তোলে। আয়নায় নিজের দিকে চোখ তুলে তাকাতেও ভয় করে তখন। এতটাই বাস্তব, রক্তমাংসের তাঁর প্রতিটি গল্পের চরিত্র। এতটাই প্রাসঙ্গিক। প্রখ্যাত উর্দু লেখক আলি সর্দার জাফরি একবার মান্টোর লেখা প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, মধ্যবিত্ত মানুষের বুকের ভিতর লুকিয়ে থাকা অপরাধীদের কথা বলে মান্টোর গল্প। কথাটা যে কত সত্যি সাদত হাসান মান্টোর পাঠকমাত্রেই জানেন তা। আজও যখন পাকিস্থানে হিন্দুদের উপর নির্যাতন চলে, আজও যখন ভারতের বুকে সংখ্যালঘুদের জ্যান্ত পোড়ানো হয় ‘হর হর মহাদেও’ ধ্বনি সহকারে, ভিনধর্মের নারীকে সদলবলে ধর্ষণ করা হয় যখন, যখন ধর্মের নামে ‘লাভ জিহাদ’এর ট্যাগ দিয়ে ভেঙে টুকরো করা হয় দুটি সম্প্রদায়ের মানুষের প্রেম – তখন বারবার প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েন, অবশ্যপাঠ্য হয়ে পড়েন, অনস্বীকার্য হয়ে পড়েন সেই ঋজু কলমধারী মানুষটি, যার নাম সাদত হাসান মান্টো।