
শাশ্বতী সান্যাল
বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার সদরদি গ্রামে ১৯১৭ সালের এক শীতের ভোরে জন্ম নিয়েছিল মহেন্দ্রনাথ মিত্র আর বিরাজবালা দেবী’র বড় ছেলে… দুধের দাঁত পড়েনি তখনও, মাত্র চার বছর বয়সেই চলে গেলেন মা বিরাজবালা। সদ্য মা হারানো সেই ছোট্ট অভিমানী ছেলেটাকে সেদিন কোলে তুলে নিয়েছিলেন ‘বড়মা’ জগৎমোহিনী। স্নেহে মমতায় ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মা না থাকার যন্ত্রণা। একান্নবর্তী পরিবারে পিসিমা, ঠাকুমাদের কোলেপিঠে বেড়ে ওঠা পল্টু নামের সেই বালকই অনেক পরে লিখবেন, “বাল্য কৈশোর পার হয়ে প্রথম যৌবনে, যখন মা নয়, নারীর মধ্যে মনোরমাদের আমি দেখতে পাচ্ছি, তখন আমার খেয়াল হয়েছিল আমার মা কেমন দেখতে ছিলেন সে কথা জানবার।”
হ্যাঁ, কথা হচ্ছে, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, কবি নরেন্দ্রনাথ মিত্রকে নিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে তারুণ্যের সবুজ বাতাস ফিরে এসেছিল যে ক’জন নতুন ধারার লেখকের হাত ধরে, তাঁদের অন্যতম, নরেন্দ্রনাথ মিত্র। বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের হৃদস্পন্দনকে তিনি অবলীলায় তুলে এনেছিলেন সাদা পাতায়। ৪০ থেকে ৬০ দশকে বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক তিনি। এরপর বাঙালি যত আধুনিক হয়েছে, যত আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়েছে ভুবনজোড়া অন্তর্জালের ফাঁদে, ততই সে ভুলে গেছে নিজেদের ঘরের সুখদুঃখের চেনা গল্পগুলো, ভুলে গেছে সেসব গল্পের রূপকার নরেন্দ্রনাথ মিত্রকেও। নরেন্দ্রনাথের বাবা ছিলেন বিচিত্রকর্মা পুরুষ। ক্ষুরধার বিষয়বুদ্ধি, সাংসারিক দক্ষতা- এসব তো ছিলই, আবার সেই মানুষই ভোরবেলা ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে শেখাতেন সংস্কৃত শ্লোক, ভক্তিগীতি। তবে বাবার মতো হন’নি বড়ছেলে, নরেন্দ্রনাথ ছিলেন একেবারে অন্য ধারার মানুষ। ছাত্র হিসাবে বরাবরই ভালো ছিলেন। প্রথমে বঙ্গা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন আর তারপর ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে প্রথম ডিভিশনে আই. এ পাশ করেন।
১৯৩৯ সাল নাগাদ স্নাতকের পড়া শেষ করে স্বাধীন রোজগারের চেষ্টায় ছাত্র পড়ানোর কাজে যোগ দিলেন। তবে গৃহশিক্ষকতা করতে গিয়ে বেশ নাজেহাল হয়েছেন আনমনা, লাজুক, কিছুটা বিষণ্ণ প্রকৃতির এই তরুণ। ছেলেরা তাঁকে ভয় পাওয়া তো দূর, গ্রাহ্যই করত না। শাসন করতে পারতেন না নরেন্দ্রনাথ, চাইতেনও না৷ অগত্যা বারবার জীবিকা বদল। কখনও অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির চেকার, কখনও বা ব্যাঙ্কে কেরানির চাকরি।
এভাবেই বারবার চাকরি বদল করতে করতে চলে এলেন খবরের কাগজে। একদিকে স্বাধীন লেখালিখি, আর অন্যদিকে ‘কৃষক’, ‘স্বরাজ’ বা সত্যযুগের মতো তখনকার দিনের একাধিক বিখ্যাত কাগজে সাংবাদিকের চাকরি। ধীরে ধীরে এই জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ। সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেওয়ার পর ১৯৫৯ সাল নাগাদ আনন্দবাজারে যোগ দিলেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র। চাকরিজীবনে এই প্রথম থিতু হলেন নরেন্দ্রনাথ।মা হারানো ছেলে, কিছুটা অভিমানীও। কমবয়েসে একা একা চলে যেতেন জেলে, কুমোর, নমশূদ্রদের পাড়ায়। কখনও গল্প জুড়তেন সেইসব দিন আনি দিন খাই মানুষগুলোর সঙ্গে, কখনও ঘুরে বেড়াতেন একা একা। সমাজের শেষতলার সেই শোষিত, অবহেলিত মানুষগুলোর জন্য মন কাঁদত নরেন্দ্রনাথের।
খুব একটা ভ্রমণপিপাসু ছিলেন না, প্রায় ঘরকুনোই বলা চলে তাঁকে। তবে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন বাঙালি মধ্যবিত্তদের সুখ আর অসুখ দুইই। তাঁর সাহিত্যের জগতেও ছড়িয়ে আছে মধ্যবিত্ত গার্হস্থ্যজীবন আর তার চারপাশের মানুষজনের ‘চেনামহল’। ব্যক্তিগতভাবেও বয়ে বেড়াতেন একটা আটপৌরে জীবন। বাজারের মুচি- মেথরেরা ছিল তাঁর বন্ধু। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের মেয়ের স্মৃতিচারণে একজন পোস্টমাস্টারের কথাও জানা যায়, যিনি প্রায়ই আসতেন নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে। বই পড়তে ভালোবাসেন জেনে এই লোকটাকে সাহিত্য বিষয়ক নানান বই পড়তে দিতেন নরেন্দ্রনাথ। নানারকম আড্ডাও চলত সাহিত্য নিয়ে।

গল্পকার নরেন্দ্রনাথ, ঔপন্যাসিক নরেন্দ্রনাথ, সাংবাদিক নরেন্দ্রনাথ- এই নানা রূপের আড়ালে কোথাও কি ঢাকা পড়ে গেছেন কবি নরেন্দ্রনাথ! অথচ সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর হাত পাকানোর শুরু কিন্তু কবিতা দিয়েই। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতায় নিজের স্বতন্ত্র উচ্চারণে নজর কেড়েছিলেন তিনি। তখন বউবাজারের দ্বিতল মাঠকোঠায় রাধা নামের এক কিশোরীকে পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছেন উনিশ বছরের নরেন্দ্রনাথ। পড়াশোনায় অমনযোগী এই ছাত্রীটি সম্পর্কে কোনও বিশেষ অনুভূতি হয়তো থেকে থাকবে তরুণ গৃহশিক্ষকের। ১৯৩৬ এর ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশ পেল প্রথম কবিতা ‘মূক’। কবিতাটির ছত্রে ছত্রেই সেই নীরব অনুরাগের ছবি। এখানেই থেমে থাকেননি নরেন্দ্রনাথ। বছর তিনেকের মধ্যেই বন্ধু নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় আর বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্যের সঙ্গে মিলে ‘জোনাকি’ নামের এক যৌথ কবিতার বইও প্রকাশ করে ফেললেন। নরেন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত ছিলেন বুদ্ধদেব বসুও। কিন্তু কালক্রমে কবিতার জগতের মায়াবি হাতছানি থেকে সরে এসে তিনি পাকাপাকিভাবে ঘর বাঁধলেন গদ্যের কঠিন মাটিতে। বাঙালি জীবনের কথাকার হিসাবে সেসময় শরৎচন্দ্রের পরই উঠে আসত নরেন্দ্রনাথের নাম।
জীবদ্দশাতেই জনপ্রিয়তার চরমে উঠেছিলেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র৷ ১৯৪৯ সালে দেশ পত্রিকায় নরেন্দ্রনাথের একটি গল্প প্রকাশ পেয়েছিল। ‘অবতরণিকা’ নামের সেই ছোটগল্পটি পড়েই সত্যজিৎ রায়ের মাথায় একটা ছবি করার ইচ্ছে জাগে। তারপর ১৯৬৩ সাল নাগাদ মুক্তি পায় ‘মহানগর’। এই ছবির জন্য সত্যজিৎ রায় বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সিলভার বিয়ার ফর বেস্ট ডিরেক্টর’ পুরস্কার পেয়েছিলেন।
সিনেমাটি যে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের কাহিনি অবলম্বনে রচিত, সে কথা জানেন না অনেক বাঙালিই। শুধু ‘মহানগর’ই নয়, গরীব ‘শিউলি’দের জীবন নিয়ে লেখা তাঁর বিখ্যাত গল্প ‘রস’ অবলম্বনেও তৈরি হয়েছে একাধিক বাংলা ও চলচ্চিত্র। ‘সওদাগর’ ছবির অমিভাভ বচ্চনকে মনে আছে অনেকেরই। শুধু বিস্মৃতির অন্ধকারে চলে গেছেন গল্পের রচয়িতা… সেই অভিমানী, চির-একা মানুষটির নাম নরেন্দ্রনাথ মিত্র।