
দ্য ওয়াল ব্যুরো: মাত্র ১৪ বছর বয়সে ‘হাত পিলে’ হয় তাঁর। বর তাঁর থেকে বছরখানেকের ছোটো। গুজরাটের উপকূলের শহর পোরবন্দরে বেড়ে ওঠা বছর ১৪র কিশোরী, বিয়ের কতটুকুই বা বোঝে সে। নতুন জামা পড়া, মিষ্টি খাওয়া, আর ‘বর’ নামক প্রায় সমবয়সী এক কিশোরের সঙ্গে খেলাধুলো করা- সবমিলিয়ে বিয়ে ব্যাপারটা বেশ মজার মনে হয়েছিল সেদিন। দাম্পত্যজীবন বলতে আমরা যা বুঝি, সে অধ্যায় শুরু হতে তখনও অনেক দেরি।

কেমন ছিল, এই দুই নারীপুরুষের দাম্পত্য? মনের মিল হত? দাম্পত্যকলহ? ছেলেবেলায় পড়াশুনা করার সুযোগ মেলেনি। ছিল না অক্ষরজ্ঞানটুকুও- অথচ বিশ্বজুড়ে মানুষের আগ্রহ ও চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে দীর্ঘদিন ছিলেন তিনি। তাঁর অকথিত জীবন আর দাম্পত্য নিয়ে বিশ্বের নানা ভাষায় লেখা হয়েছে কত না গবেষণার বই। আর হবে না-ই বা কেন! স্বাধীনতা- পূর্ববর্তী ভারতের অঘোষিত ‘ফার্স্ট লেডি’ তো তিনিই। তিনি, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম পথিকৃৎ মহাত্মা গান্ধী’র সহধর্মিণী কস্তুরবা গান্ধী।
বাবা মায়ের পছন্দে মোহনদাসের সঙ্গে তথাকথিত ‘অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ’ হয়েছিল কস্তুরবা’র। জামাকাপড়ের বড় ব্যবসায়ী গোকুলদাস কাপাডিয়ার মেয়ে ( মতপার্থক্যে গোকুলদাস মাখাঞ্জী) বিয়ে হয়ে এলেন পোরবন্দরের দেওয়ান করমচাঁদ আর পুতলিবাইয়ের সংসারে। তখনকারের দিনের রীতি মেনে বিয়ের পরের কয়েকটা বছর বাবা-মা’র কাছেই কাটে কিশোরী কস্তুর’বার। প্রাপ্তবয়স্ক হলে তবেই তাঁকে স্বামীর ঘর করতে পাঠানো হয়। কিশোরী স্ত্রী’কে নিয়ে তাঁর এইসময়কার প্রেম, বিরহ, এমনকি ‘নাইটফল’এর প্রসঙ্গও জায়গা পেয়েছে গান্ধীর আত্মজীবনীতে।
ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ তাঁর বইতে গান্ধী সম্পর্কে বেশ কিছু বিস্ফোরক তথ্য জানিয়েছেন। সেখানে দাম্পত্যজীবন নিয়ে, নারী-পুরুষের কামনাবাসনা নিয়ে গান্ধীজীর মনোভাব সম্পর্কে অনেককিছুই জানা যায়। গান্ধী-আশ্রমে বসেই মার্গারেট স্যাংগার নামের এক আমেরিকান এক্টিভিষ্টের সঙ্গে একটি আলোচনায় গান্ধী বলেছিলেন, “পুরুষদের উচিৎ তার ‘জান্তব কামনা’কে সংযত করা, আর নারীদের উচিৎ শুধু আনন্দের জন্য স্বামী মিলিত হতে চাইলে সেইসব স্বামীদের বাধা দেয়া।” নারীর নিজস্ব কামনাকেও বিশেষ পাত্তা দিতে চাননি তিনি।


বোঝা যায় নারী স্বাধীনতা নিয়ে ভারতের সর্বকালের সেরা এই রাজনীতিবিদের বেশ অন্যরকম ভাবনাচিন্তা ছিল। আর এখানেই প্রশ্ন জাগে, দাম্পত্যজীবন নিয়ে গান্ধীপত্নী কস্তুরবাও কি স্বামীর সঙ্গে সহমত ছিলেন? না কি, সম্পূর্ণ অন্যপথের পথিক হয়েও ‘জোর করে ঢেঁকি গেলা’র মতো স্বামীর মতাদর্শকে আজীবন বয়ে বেরিয়েছেন তিনি, বাধ্য হয়েছেন বয়ে বেড়াতে!
শোনা যায়, স্বামী হিসাবে বেশ আধিপত্যকামী ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। কিছুটা মনুবাদের ধারণাও কি শিকড় ছড়িয়েছিল তাঁর ভিতরে? সেটা জানা না গেলেও, তিনি যে কর্তব্যনিষ্ঠ অনুগামী স্ত্রী পছন্দ করতেন, সেটা নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন।
কিন্তু কস্তুরবা ছিলেন একেবারে অন্য ধাতুতে গড়া। স্বামী বলেই তাঁর কর্তৃত্ব সবসময় মেনে নিতে হবে না কি? প্রশ্নও তোলা যাবে না? আত্মজীবনীর সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, প্রথম জীবনে মতবিভেদ, তর্কবিতর্ক এসব লেগেই থাকত দুজনের মধ্যে। স্ত্রী’কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোনও চেষ্টারই কসুর করেছেন মোহনদাস। এমনকি, স্ত্রী’র চলাফেরায় নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করতেও ছাড়েননি সেসময়।
গান্ধী’র আত্মজীবনী এবং কস্তুরবা গান্ধীর স্মৃতিকথা থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট, দাম্পত্যে যৌনসুখ থাকলেও প্রথম যৌবনে তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি লেগে থাকত প্রায়ই। গান্ধীর প্রভুত্বের উল্টোদিকে কস্তুরবা’র ঐ নরম চেহারার মধ্যে প্রায়ই জেগে উঠত একগুঁয়ে একটা বৈপ্লবিক তেজ।
হরিলাল আর মণিলালের জন্মের পরই ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত পাড়ি দেন মোহনদাস। সদ্যপ্রসূতি যুবতী বউ’কে দেশেই রেখে যান। প্রথম সন্তানের মৃত্যুর শোক তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি কস্তুরবা। স্বামী বিদেশে, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ বলতে চিঠি। কিন্তু লিখতে -পড়তে না জানা কস্তুরবা’র পক্ষে চিঠি লেখাও সম্ভব নয়। বাড়ির অন্যান্য সদস্যকে লেখা মোহনচাঁদের চিঠি পড়ে যেটুকু জানা যায়, সংযোগ সেটুকুই।
এরপর ১৮৯৬ নাগাদ দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি পাড়ি জমান স্বামীর কর্মক্ষেত্রে, দক্ষিণ আফ্রিকায়। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরুও এই দক্ষিণ আফ্রিকাতে। শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গ বিরোধের জেরে বিদেশ-বিভূঁইতে এসে বেশ কিছুদিন কারাবাসও করতে হয় কস্তুর’বাকে। আর পাঁচজন ভারতীয় নারীর থেকে তিনি যে ঠিক কতটা অন্যরকম, জেলের দিনগুলোতেই তা অনেকখানি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

গান্ধীর ব্রহ্মচর্যের সিদ্ধান্তে ভয়ানক চটেছিলেন কস্তুরবা৷ সবচেয়ে মজার কথা, এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সেভাবে কোনও আলোচনাই হয় নি সেদিন। সঙ্গীর মতামত ছাড়াই এমন একটা দাম্পত্য সিদ্ধান্ত একা একা নেওয়া যায় কী না, তা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। প্রশ্নটা যে কস্তুর’বাকেও ভাবিয়ে তুলেছিল, দুজনের আত্মকথা থেকেই জানা যাচ্ছে সেটা। সংসারধর্ম, স্ত্রীর কর্তব্য- এসব নিয়ে ভারতীয় নারীর যে স্বাভাবিক মনের গতি, বলাই বাহুল্য, এই ব্রহ্মচর্য তার পরিপন্থী ছিল। মন থেকে সহমত না হয়েও পরিবারের কথায়, সমাজের চাপে, ‘পতি পরমেশ্বর’এর সিদ্ধান্ত সেদিন মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন কস্তুরবা। সেটা ১৯০৬ এর ঘটনা৷ ততদিনে জন্মে গেছেন ছোট দুই ছেলে, রামদাস আর দেবদাস।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে ১৯১৪ থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে নিজেকে তুলে ধরেন গান্ধীজী। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও এইসময় প্রতিটি ক্ষেত্রে উপযুক্ত সহধর্মিণীর মতো তিনিও স্বামীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে স্বামীর বহু সিদ্ধান্তেই দ্বিমত ছিল তাঁর। কিন্তু তারপরও সমাজ আর সংসারের প্রতি কর্তব্যপালনে দুবার ভাবেননি কস্তুরবা। তাঁর ব্যক্তিত্বের দ্বিধা কখনও মহাত্মার চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং বিপদে আপদে সবার আগে স্বামীর হাত ধরে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন স্ত্রী কস্তুরবা’ই।
অক্ষরজ্ঞান ছিল না, তবু মানবিক শিক্ষার আসল মডেল ছিলেন তিনি। তাঁর ধর্মবিশ্বাস কখনও তাঁর স্নেহের রাস্তায় প্রতিবন্ধক হয়নি। একনিষ্ঠ বৈষ্ণব হয়েও অনায়াসে কোলে টেনে নিতে পারতেন গরীব হরিজনের মেয়েকে। সত্যি কথা বললে, প্রেম আর স্নেহ এই দুই গুণেই তিনি ছিলেন অনন্য আর একক। ব্যক্তিজীবনের দ্বন্দ্ব ছাপিয়ে তাঁর এই চারিত্রিক মাধূর্য্যই তাঁকে করে তুলেছিল আসমুদ্রহিমাচল ভারতবাসীর ‘সকলের মা’।