
দ্য ওয়াল ব্যুরো: মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তাঁর মাথায় উঠেছিল রাজমুকুট। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত রানিদের একজন তিনি। ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্রের সেই টালমাটাল দশায় শক্ত হাতে টেনে ধরেছিলেন রাশ। ফিরিয়ে এনেছিলেন রাজতন্ত্রের পুরোনো গরিমা। একের পর এক আধুনিক সংস্কার, জনকল্যাণমূলক কাজকর্ম তাঁকে করে তুলেছিল দেশের মানুষের নয়নের মণি। তিনি আর কেউ নন, ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের অন্যতম চর্চিত নাম রানি ভিক্টোরিয়া।

‘এক ঘণ্টা একা থাকতে দাও’
জন্মের মাত্র আটমাসের মাথায় বাবা’কে হারান ভিক্টোরিয়া। রাজপরিবারের ভিতরে একা মায়ের আদরে আর শাসনেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। অবশ্য নিন্দুকেরা বলেন মেয়ের উপর মায়ের আদরের চেয়ে শাসনের পরিমাণই বেশি ছিল। পরবর্তীকালে নিজের শৈশব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বারবার সেসব নৈরাশ্যের তিক্তস্মৃতি তুলে এনেছেন ভিক্টোরিয়া।

রাজপরিবারের মেয়ে, ইস্কুলে আর পাঁচটা সাধারণ পরিবারের ছেলেমেয়ের সঙ্গে পাছে মেলামেশা করে, সেই ভয়ে কোনওদিন স্কুলে পাঠানোই হয় নি ভিক্টোরিয়াকে। সমবয়সী কারও সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পায়নি সে। রাজবাড়িতেই একজন জার্মান গৃহশিক্ষিকা রাখা হয়েছিল ছোট্ট ভিক্টোরিয়ার জন্য। খুব অল্প বয়সেই জার্মান আর ইংরাজি, দুটো ভাষাতেই চৌকস হয়ে ওঠে ভিক্টোরিয়া। এমনকি ল্যাটিন আর ফ্রেঞ্চও তার পছন্দের ভাষা ছিল। কিন্তু তার কোনও বন্ধু ছিল না। কাছাকাছি বয়সের এমন কেউ ছিল না, যার সঙ্গে প্রাণখুলে গল্প করা যায়। তার উপর প্রাসাদের কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা আর মায়ের কড়া শাসন। এ ব্যাপারে রাজকর্মকর্তা জন কনরয়ও কম যেতেন না। ভিক্টোরিয়াকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতেন তিনিও। একদিকে রাজপরিবারের নিয়ম-কানুন, সহবতশিক্ষা, আর অন্যদিকে এই দুজনের প্রতিমুহূর্তের নজরদারি ভিক্টোরিয়ার শৈশবকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। প্রাসাদের এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানোরও অনুমতি ছিল না। মনখারাপ হলে এক কোণে বসে ছোট্ট মেয়েটি একা একাই খেলা করত ডল পুতুল আর পোষা কুকুরদের সঙ্গে।এভাবেই ধীরে ধীরে কেনসিংটন প্রাসাদের ভিতর বেড়ে ওঠেন ভিক্টোরিয়া। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তাঁর মাথায় ওঠে রানির মুকুট৷ সিংহাসন লাভের পর রানি ভিক্টোরিয়ার প্রথম হুকুম কী ছিল জানেন! “এক ঘণ্টা একা থাকতে দাও”… হ্যাঁ, সারাদিনের দুর্বিষহ ঘেরাটোপ থেকে একঘণ্টার মুক্তি, এটাই ছিল রানি ভিক্টোরিয়ার প্রথম ইচ্ছে।
রানি হওয়ার পর পরই আরও দুটো কাজ সেরে নিয়েছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকে এক ঘরে মায়ের খাটেই রাত কাটাতে হয়েছে তাঁকে। রানি হয়েই তিনি নিজের ঘর থেকে বেশ কিছুটা দূরে বাকিংহাম প্যালেসের একটি প্রত্যন্ত অ্যাপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মা’কে। আর নিজের কর্মচারী পদ থেকে বরখাস্ত করেছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ জন কনরয়কে। এভাবেই নিজের শৈশবকে হত্যা করার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া।
বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন নিজেই
১৮৩৬ সাল থেকেই ভিক্টোরিয়ার বিয়ে নিয়ে একটা চাপানউতোর শুরু হয়েছিল ইউরোপের রাজপরিবারগুলোতে। প্রস্তুত করা হয়েছিল রূপে-গুণে-বংশমর্যাদায় সেরা রাজকুমারদের নামের তালিকাও। সেসব নামের বেশ উপরের দিকেই ছিল নেদারল্যান্ডের যুবরাজ আলেকজান্ডারের নাম। কিন্তু প্রথম আলাপে আলেকজান্ডারকে তেমন মনে ধরল না ভিক্টোরিয়ার।
ভিক্টোরিয়ার ১৭ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে জার্মানি থেকে লন্ডনের রাজপ্রাসাদে বেড়াতে আসে রাজপরিবারের আত্মীয়রা। তাঁদের মধ্যে ভিক্টোরিয়ার মামাতো আর খুড়তুতো ভাই-বোনেরাও ছিল। তখন কৈশোর ছেড়ে সদ্য যৌবনে পা দিয়েছেন ভিক্টোরিয়া। ভালো লেগে গেল নিজেরই মামাতো ভাই রাজকুমার অ্যালবার্টকে। সেই ভালো লাগা থেকে প্রেম। আর তার ঠিক পরের বছরই ব্রিটেনের রানি হিসাবে শপথ নিলেন ভিক্টোরিয়া।রানি হওয়ার পরও বেশ কয়েকবার ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে অ্যালবার্টের। সমস্ত রাজপরিবারই তখন মুখিয়ে আছে আসন্ন শুভদিনের। কিন্তু গোলমাল বাধল অন্যত্র। রাজপরিবারের অনুশাসন মেনে রানিকে তো বিবাহপ্রস্তাব দেওয়া যায় না। অতঃকিম! এই প্রথম ব্রিটিশ এটিকেট ভাঙলেন ভিক্টোরিয়া। ইংরেজি আদবকায়দায় বিয়ের প্রস্তাব পুরুষেরাই দিয়ে থাকেন, মেয়েরা শুধু সম্মতি বা অসম্মতি জানায়। সেই প্রথমবার নিয়ম ভেঙে রানি নিজেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন ভালোলাগার পুরুষ অ্যালবার্টকে।

অবশ্য খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না রানি ভিক্টোরিয়ার। বরং তিনি চেয়েছিলেন অ্যালবার্টকে আরও কিছুটা উচ্চশিক্ষিত করে তুলতে, যাতে ভবিষ্যতে ব্রিটেনের রানির স্বামী হিসাবে তিনি নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য দক্ষতার সঙ্গে পালন করতে পারেন। পড়াশোনা শেষ করে বিদেশ থেকে ফেরার পর ১৮৪০ এর ১০ ফেব্রুয়ারি শুভদিন দেখে রানির সঙ্গে বিয়ে হয় প্রিন্স অ্যালবার্টের।

লর্ড মেলবোর্নের সঙ্গে সম্পর্কের গুঞ্জন
মাত্র ১৮ বছরের সদ্য তরুণী ভিক্টোরিয়ার মাথায় উঠল রাজমুকুট। বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে তখনও তাঁর অভিজ্ঞতা তেমন নেই বললেই চলে। সেসময় লর্ড মেলবোর্ন ছিলেন ইংল্যান্ডের মন্ত্রীসভার প্রধান। রাজনৈতিকভাবে অনভিজ্ঞ রানি প্রথমদিকে যেকোনও পরামর্শের জন্য মেলবোর্নের উপরই নির্ভর করতেন।

এই বুড়ো প্রধানমন্ত্রী জানতেন রানির হাতে দেশের অধিকাংশ ক্ষমতা। ক্ষমতার লোভে তিনি সবসময় চাইতেন রানি ভিক্টোরিয়াকে তাঁর নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে। অল্পবয়সী ভিক্টোরিয়াকে নানারকম প্ররোচনাও দিতেন এই প্রৌঢ় মন্ত্রী। প্রথম প্রথম বিশ্বাসের বশে মন্ত্রীর ফাঁদে পা-ও দেন রানি। এইসময় বিপত্নীক প্রধানমন্ত্রী লর্ড মেলবোর্নকে ঘিরে সারাদেশে গুজব রটে যায় যে ভিক্টোরিয়া এই বৃদ্ধকেই বিয়ে করতে চলেছেন। রাজপরিবারের অন্দরে তো বটেই, এমনকি ইংল্যান্ডের মানুষের মধ্যেও সেসময় জোর গুঞ্জন শুরু হয়েছিল ভিক্টোরিয়া আর প্রধানমন্ত্রী মেলবোর্নের সম্পর্ক নিয়ে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রানীকে ‘মিসেস মেলবোর্ন’ বলে কটাক্ষও করা হত।

এইসব ঘটনায় ভয়ানক রেগে যান ভিক্টোরিয়া। তাঁর মানসিক শান্তিও নষ্ট হচ্ছিল। তাছাড়া মেলবোর্নের রাজনৈতিক দীক্ষা ভিক্টোরিয়ার খুব বেশি কাজেও লাগেনি। বহু টালবাহানার পর ১৮৪১ সাল নাগাদ প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় লর্ড মেলবোর্নকে। খুব অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন ভিক্টোরিয়া, মায়ের সঙ্গেও খুব মধুর সম্পর্ক ছিল না। এ অবস্থায় ‘ফাদার ফিগার’ লর্ড মেলবোর্নের মধ্যে হয়তো রানি সেই আস্থা আর বিশ্বাসই খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন, অন্তত এমনটাই ধারণা অনেক ইতিহাসবিদের।
সারাজীবন পরলেন কালো পোশাক, কেন?
অ্যালবার্টের সঙ্গে বৈবাহিক জীবনে বেশ সুখী ছিলেন ভিক্টোরিয়া। যৌথ দাম্পত্যে এক এক করে ৯ সন্তানের জন্ম দেন তাঁরা। রানির তৎকালীন ডায়েরি আর চিঠিপত্র পড়লেই বোঝা যায় স্বামী অ্যালবার্টকে তিনি কতটা ভালোবাসতেন! সেসময় রানি ভিক্টোরিয়ার প্রধান উপদেষ্টাও ছিলেন প্রিন্স এলবার্ট। তবে ইংল্যান্ডের রাজনীতিতে খুব বেশি জনপ্রিয় হতে পারেননি অ্যালবার্ট। লন্ডনের মানুষ তাঁকে বিশেষ পছন্দও করত না। শারীরিকভাবেও খুব একটা সুস্থ ছিলেন না তিনি। নানা অসুখে প্রায়ই শয্যা নিতেন।

১৮৬১ সালে মাত্র ৪২ বছর বয়সেই মারা যান প্রিন্স অ্যালবার্ট। এই অপ্রত্যাশিত শোক রানিকে ভেঙে ফেলেছিল। দীর্ঘদিন তিনি প্রাসাদের বাইরে বেরোতেন না। সরকারি কাজকর্মেও মন ছিল না। শোকের প্রতীক হিসাবে পরতেন কালো পোশাক। সেসময় রানির শোকের সমব্যথী হয়ে দেশের লোকজনও বেশ কিছুদিন কালো পোশাক পরেছিলেন। পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেও রানি কখনও ভোলেননি অ্যালবার্টকে। একাধিক সম্পর্কের গুঞ্জন তৈরি হলেও আর কখনও বিয়ে করেননি রানি। একইরকমভাবে সাজিয়ে রাখতেন তাঁর প্রিয় অ্যালবার্টের ঘর। রোজ নতুন নতুন পোশাক উপহার দিতেন মৃত স্বামীকে। অ্যালবার্টকে যে তিনি ভোলেননি, সে কথা স্মরণে রেখেই আজীবন পরেছেন কালো পোশাক।
বারবার খুনের চেষ্টা
যেকোনও রোমহষর্ক গল্পের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে রানি ভিক্টোরিয়ার জীবন। রানিকে খুন করার চেষ্টা হয়েছে একবার নয়, ছ’ছবার। প্রতিবারই আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে ফেরেন রানি। এইসব খুনের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে রাজপরিবারের কাউকে সরাসরি জড়িত থাকতে দেখা না গেলেও, ধারণা করা হয় সিংহাসনের উত্তরসূরিরাই পথের কাঁটা সরাতে গোপনে এসব করাতেন।

১৮৪০ সালে এডওয়ার্ড অক্সফোর্ড নামে এক ১৮ বছরের এক তরুণ লন্ডনের রাস্তায় রানিকে লক্ষ্য করে দু’টি গুলি ছোঁড়ে। অল্পের জন্য রক্ষা পান গর্ভবতী রানি। পরে তদন্তে জানা যায় মাথার গন্ডগোল আছে ওই তরুণের। বিনা সাজায় ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে। ১৮৪২ সালে জন উইলিয়াম নামে আরেক তরুণ দু’বার রানিকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। শাস্তি হয়নি তারও। আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় অপরাধী।
১৮৪৯ সালে এক ক্ষুব্ধ আইরিশ নাগরিক আবার হামলা করে রানির ঘোড়ার গাড়িতে। পরের বছর রবার্ট পেট নামে এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা রানির মাথায় বেত দিয়ে আঘাত করেন। রানি তখন একাই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। বেতের ওজন কম হওয়ায় সে যাত্রাও গুরুতর বিপদের হাত থেকে বেঁচে যান ভিক্টোরিয়া। ১৮৮২ সালে স্কটল্যান্ডের এক বিখ্যাত কবি রানির ঘোড়ার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়েন। এটি ছিল রানিকে হত্যার লক্ষ্যে তার তৃতীয় প্রচেষ্টা। তাকেও পাগল আখ্যা দিয়ে শাস্তির হাত থেকে নিষ্কৃতি দেন রানি নিজেই। এসব খুনের চেষ্টা জনসাধারণের মধ্যে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল রানির জনপ্রিয়তা। এছাড়াও ‘দ্য বয় জোনস’ নামে এক তরুণকে একবার রানির খাসকামরা থেকে গ্রেফতার করা হয়। রানির বেশ কিছু ব্যক্তিগত জিনিস সে হাতিয়েছিল বলে অভিযোগ৷
১৯০১ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রায় ৬৪ বছর একা হাতে যুক্তরাজ্য ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজত্বভার সামলেছেন রানি ভিক্টোরিয়া। পৃথিবীর ইতিহাসে যে ক’জন নারী শাসক দীর্ঘ সময় শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত-সমালোচিত নাম সম্ভবত রানি ভিক্টোরিয়ার। শ্বেতাঙ্গ সমাজের গণ্ডি ছাড়িয়ে তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতীয় উপনিবেশ থেকে সুদূর আফ্রিকা মহাদেশেও। ব্যক্তিগত জীবনেও ভারি বর্ণময় ছিলেন ভিক্টোরিয়া। ভারতীয় ভৃত্য আবদুলের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্কের কথা বহুচর্চিত। তবু সবকিছুর ঊর্ধ্বে আজীবন এক আশ্চর্য নিঃসঙ্গতা আর বিষাদ বয়ে বেড়িয়েছেন নিজের ভিতরে। আজও তাঁর হৃদয়ের সেই আলোআঁধারির নাগাল পায়নি কোনও তাত্ত্বিক, গবেষক, ইতিহাসবিদ।