
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’…আজ থেকে ৬৯ বছর আগে আজকের তারিখেই মাতৃভাষার সম্মানে ঢাকার রাস্তায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিল কিছু ছটফটে তরতাজা তরুণ প্রাণ। বাংলার ৮ই ফাল্গুন সেদিন। মাতৃভাষার সম্মান বাঁচাতে ১৪৪ ধারার পরোয়া না করে সিংহ-বিক্রমে সেদিন ঢাকার পথে নেমেছিল মানুষের দল। রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্মম মারে বসন্তের ছিন্ন পলাশের মতো ঢাকার রাস্তা ভেসে গিয়েছিল তরুণ বুকের রক্তে।

ভাষা আন্দোলনকে শুধু মাতৃভাষার প্রতি আবেগ থেকে করা যুব আন্দোলন হিসাবে দেখা যায় না। বয়স, ধর্ম, জাতি নির্বিশেষে সেদিন পূর্ব পাকিস্থানের সমস্ত বাংলাভাষী মানুষ জড়িয়ে পড়েছি্ল আন্দোলনে। স্বতস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসা মানুষের ঢলে মিশে সর্বাত্মক এক সামাজিক বিপ্লবের চেহারা নিয়েছিল ২১শে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন। কিন্তু শুধুই সামাজিক প্রেক্ষিত? না, সমসাময়িক প্রেক্ষিতে ভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতাও কম নয়।
দেশভাগের পর, বা বলা ভালো স্বাধীন পাকিস্থান রাষ্ট্র গড়ে ওঠার পর তখন একের পর এক জনসভায় ভাষণ দিয়ে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ আলি জিন্না। তাঁর ভাষণে কিছু কথা পুনরাবৃত্ত হচ্ছিল, যার অন্যতম হল, উর্দুকে জাতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথাও। ১৯৪৮ সাল নাগাদ তিনি অনেকটা সেই উদ্দেশ্য নিয়েই বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। ৯ দিনের সেই সফরে তিনি ঢাকা আর চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটা সভায় বক্তৃতা দেন। ঢাকায় তাঁর প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ২১শে মার্চ, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে – যা এখন সোহরাওয়ার্দি উদ্যান নামে পরিচিত।
সেদিন ঢাকার বক্তৃতায় ঠিক কী বলেছিলেন জিন্না সাহেব? ইংরেজিতে দেয়া সেই বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, “আমি খুব স্পষ্ট করেই আপনাদের বলছি যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, আর অন্য কোনও ভাষা নয়। কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রু।”
এই ঘটনার প্রায় একবছর আগে ১৯৪৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেছিলেন। উর্দু বনাম বাংলাভাষা নিয়ে বিতর্ক জেগেছিল তখন থেকেই। এরপরের ঘটনা তো বলা হয়ে গেছে আগেই। মাতৃভাষা নিয়ে বাঙালির যে চিরন্তন আবেগ, তাতেই যেন ঘি ঢালে সেদিন ঢাকায় জিন্নার বক্তৃতা। ফুঁসে ওঠে বাঙালি যুব সমাজ।
সেসময় পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই বাংলা ভাষাভাষি মানুষ। পরিসংখ্যানের হিসেবে তারপর এগিয়ে আছে পাঞ্জাবি ভাষা। উর্দুতে কথা বলতেন দেশের মাত্র ৭% মানুষ। উর্দুকে জাতীয় ভাষা হিসাবে ঘোষণা করার এই চেষ্টার পিছনে তাহলে কী ছিল?
ইতিহাস বলে, মহম্মদ আলি জিন্না নিজেও উর্দুতে তেমন দড় ছিলেন না৷ কিন্তু সেসময় পাকিস্তানের প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর মাথায় যারা বসেছিল, তাঁদের অধিকাংশই খানদানি মুসলিম বংশের মানুষ। এঁরাই ছিলেন মূলত উর্দু ভাষার পৃষ্ঠপোষক। প্রশাসনের একটা বড় অংশ, এবং সমাজের উচ্চকোটির কিছু মুষ্ঠিমেয় মানুষকে প্রাধান্য দিতে গিয়েই কি তাহলে উর্দুকে জাতীয় ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার এই প্রয়াস করেছিলেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল এবং মুসলিম লিগের সর্বেসর্বা মহম্মদ আলি জিন্না? সেই সম্ভাবনার দিকে আঙুল তুলেছেন ইতিহাসবিদদের অনেকেই।
অর্থনৈতিক কারণও কম ছিল না, রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দুকে প্রাধান্য দিলে চাকরির বাজারে উর্দুভাষীদের দর যেমন বাড়বে, তেমনই কমে আসবে বাঙালির গুরুত্ব। সরকারি পদ তো দূরস্থান, স্কুল কলেজেও বাংলাভাষার প্রয়োজন কমবে- বাড়বে বেকারত্ব। এ নিয়ে বিভিন্ন কাগজে লেখালিখি শুরু হয়েছিল আগেই। এমনকি বাঙালিকে অশিক্ষিত বলে টোন করতেও ছাড়েনি উর্দুভাষীরা।
১৯৪৮ থেকেই জমতে শুরু করেছিল বারুদ। তাতে আগুন লাগে ১৯৫২তে। আওয়ামি লিগের প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে ততদিনে। ২৬শে জানুয়ারি পাকিস্তান এসেম্বলিতে উর্দুকে জাতীয় ভাষা করার পথে আরও একধাপ এগিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরের দিন, অর্থাৎ ২৭শে সেই একই ঘোষণা শোনা যায় খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যে।

বাঙালি হয়েও রাজনৈতিক কারণে নাজিমুদ্দিনের সেই উলটো অবস্থান সেদিন ছাত্র-যুব সমাজের ঘেন্নার কারণ হয়ে ওঠে। এইসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বক্তৃতা দিতে এসে ছাত্র-শিক্ষকদের তুমুল বিক্ষোভের মুখে পড়েন জিন্না।
এরপরই আসে সেই লেলিহান সকাল। পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৪৪ ধারা ভেঙে মাতৃভাষার মর্যাদা বাঁচাতে, অধিকারের দাবিতে ২১শে ফেব্রুয়ারি সকালে ছাত্র, শিক্ষক, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষের ঢল নামে ঢাকার পথে। রাজশাহী, মৈমনসিংহ, চট্টগ্রাম সহ নানা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভের সেই আগুন। সারা দেশ কাঁপিয়ে বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে তারা আওয়াজ তোলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।
১৪৪ ধারার ভয় উপেক্ষা করে, আইন ভেঙে পথে নামেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা। আন্দোলন দমন করতে ছুটে আসে শাসকের আশ্রিত পুলিশ দল। চলে বেধড়ক লাঠি, গুলি, বুটের গুঁতো৷ পুলিশের গুলিবর্ষণে শহীদ হন রফিক, জব্বার, শফিউল, সালাম, বরকত। শহীদ হন অনেক নাম না জানা বঙ্গসন্তান৷ বাংলাভাষার দাবিতে বাঙালির রক্তে ধুয়ে যায় ঢাকার রাজপথ।

পরবর্তীকালে ২১ ফেব্রুয়ারির সেই কালাদিবসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ভাষা সংগ্রামের অন্যতম শরীক আহমদ রফিক বলেছিলেন, ‘সরকার এতটা নির্মম এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিল, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলনকারীদের মধ্যে যারা লাঠিপেটায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধেও খুব তাড়াতাড়ি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।” গণতন্ত্রের নামে পাকিস্তানের সরকারী সেনাদল, পুলিশ প্রশাসন সেদিন যে নির্মম পাশব মানসিকতার প্রকাশ করেছিল, সেই ক্ষত দীর্ঘদিন রক্ত শুকিয়ে যাওয়া কালো আঘাতের মতো দগদগ করেছে বাঙালি জাতির পিঠে। মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয়েছে সেই দুটো লাইন-