
দ্য ওয়াল ব্যুরো: হাই বেঞ্চ- লো বেঞ্চের বদলে একটা ছেঁড়া, ফাটা, তাপ্পি মারা শতরঞ্চি, চারদেওয়াল আর ছাদের বদলে মাথার উপর দ্রুতগতি মেট্রোব্রিজের শেড, ব্ল্যাকবোর্ডের বদলে দেওয়ালের এদিকে-ওদিকে চার-চৌকো আলকাতরার পোচ, আর শিক্ষকের বদলে দোকানদার – শুনে অবাক হচ্ছেন! ভাবছেন এ আবার কোন ‘স্ল্যামডগ মিলিওনিয়ার’ এর গল্প! কিন্তু না, সিনেমার মতো শোনালেও এটা কোনও রুপোলি পর্দার গল্প নয়। যমুনা-তীরের বস্তি এলাকায় দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী জনা চল্লিশেক কিশোর-কিশোরীর জীবনের এটাই ঘোর বাস্তব।
উপরে দ্রুতিগতিতে ছুটে চলা মেট্রো, আর নীচে জীবনের যুদ্ধে দৌড়নোর প্রস্তুতি নেওয়া কিছু সরল কচিকাঁচা মুখ, দিল্লির যমুনাব্যাঙ্ক মেট্রোস্টেশনের ফ্লাইওভারের নীচে এটাই রোজকার ছবি। এভাবেই প্রতিদিন সকালে উড়ালপুলের নীচে শুরু হয় একদল ছোট্ট নাগরিকের অক্ষরশিক্ষার ক্লাস।
বছর কয়েক আগে উড়ালপুলের নীচে গরীব বাচ্চাদের জন্য এই অস্থায়ী স্কুলটি শুরু করেছিলেন রাজেশ কুমার শর্মা। বছর পঞ্চাশের রাজেশবাবুর নিজের জীবনেও রয়েছে লড়াই করে উঠে আসার গল্প। এখন অবশ্য তিনি একটা মুদির দোকান চালান। কিন্তু সপ্তাহে পাঁচদিন, মানে সোম থেকে শুক্র, সেই দোকানদারির জগৎ থেকে ঘণ্টাদুয়েকের ছুটি নেন ভদ্রলোক। সে সময় দোকান সামলান তাঁর ছোটভাই। সারা দিনের মধ্যে সেই দুটো ঘণ্টাই রাজেশবাবুর জীবনের তাজা অক্সিজেন। সেসময় ভূমিকা বদলে যায় রাজেশ কুমার জি’র। লেনদেনের কারবারি দোকানদার নয়, তখন তিনি একদল কচিকাঁচার ইংরিজির মাস্টারমশাই।
যমুনাব্যাঙ্ক মেট্রোরেলের উড়ালপুলের নীচে এই আশ্চর্য স্কুলের হেডমাস্টারও তিনি। অবৈতনিক এই স্কুলের সুনাম ক্রমশই ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। স্কুলের ছাত্ররা সকলেই আসে দিন আনি দিন খাই পরিবার থেকে। কেউ হয়তো ঠেলাওয়ালা বা রিকশাওয়ালার ছেলে, আবার কেউ আসে কলকারখানার মজুরদের বাড়ি থেকে। দিনে দুঘণ্টা রোজকার জীবনের ধুলো-কাদা থেকে এই ছেলেমেয়েরাও কিছুটা মুক্ত বাতাস খুঁজে পায় এই ইস্কুলে।
পড়াশোনার গুরুত্ব রাজেশ কুমার শর্মার চেয়ে ভালো কে জানে! টাকার অভাবে একসময় কলেজে ফি দিতে পারতেন না, এর ওর থেকে চেয়েচিন্তে বই এনে পড়াশোনা, সেও বন্ধ হয়ে যায় থার্ড ইয়ারে। হাজার চেষ্টা করেও শুধুমাত্র টাকার অভাবে বিএসসি’র শেষ বছরে এসে তাঁকে ছেড়ে দিতে হয় স্নাতক স্তরের পড়াশোনা। নিজের জীবনের সেই দুঃখজনক অধ্যায় ভোলেননি রাজেশবাবু। পড়াশোনা করতে পারেননি বলেই হয়তো, শিক্ষার মূল্য খুব ভালো বোঝেন তিনি। বর্তমানে মধ্য চল্লিশ পেরোনো রাজেশবাবুর তিন ছেলেমেয়েই ‘ময়ূর বিহার’এর স্কুলে পড়ে। কিন্তু শুধু নিজের ছেলেমেয়েকে স্বশিক্ষিত করে তোলার মধ্যেই থেমে থাকেননি রাজেশবাবু। আর সেখানেই আর পাঁচজনের থেকে আলাদা তাঁর জীবন।
একসময় নিজের প্রয়োজনে তাঁকে প্রায়ই যমুনাব্যাঙ্ক এলাকায় যাতায়াত করতে হত। যাওয়া আসার পথে বেশ কিছু কমবয়সী ছেলেমেয়েকে পথের ধারে খেলা করতে দেখতেন তিনি। স্কুলে যাওয়ার বয়সে পড়াশোনা না করে খেলে বেড়ানোর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি বুঝলেন এই গরীব বাচ্চাগুলোর পরিবারের লোকজন চায় না ছেলেরা পড়াশোনা শিখুক। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো, বা বই কিনে দেওয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতিও তাদের নেই। তাই পড়াশোনার ঝামেলায় না গিয়ে তারা চায় বাড়ির ছেলে বা মেয়েটিকে ওই কমবয়সেই কোথাও ছোটোখাটো কাজে ঢুকিয়ে দিতে। তাতে অন্তত একটা পেট বাঁচে, আর দুটো টাকাও আসে ঘরে। ছোটো ছোটো বাচ্চাগুলোর মুখ দেখে ভারি মায়া হয়েছিল সেদিন। প্রথমে ভেবেছিলেন কিছু টফি তুলে দেবেন বাচ্চাগুলোর হাতে। কিংবা কিছু জামাকাপড় কিনে আনবেন। পরে সে ইচ্ছে বদলে যায়। তিনি বুঝেছিলেন,এই শিশুগুলোর খাবার বা জামাকাপড়ের থেকেও বেশি দরকার একটু স্নেহ-মমতার উত্তাপ আর শিক্ষা৷ তাই নিজের রোজকার জীবন থেকে প্রতিদিন একঘণ্টা বের করে এনে এই হতদরিদ্র শিশুগুলোকে কিছুটা সঙ্গ দেবেন বলে স্থির করলেন রাজেশ শর্মা। শুরু হল কাজ।
প্রথমে বাড়ি বাড়ি ঘুরে লেখাপড়া শেখার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এইসব শিশুদের বাবা-মা বোঝাতে শুরু করলেন। এইভাবেই কয়েকজন রাজি হলেন ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে। কিন্তু স্কুল খোলার জায়গা কই! অগত্যা মেট্রোব্রিজের নীচেই শুরু হল ক্লাস। সেখানেই আড্ডা, গল্প, খেলার ছলে শুরু হল একটু একটু করে এই বাচ্চাদের পড়াশোনায় হাতেখড়ি।
প্রথম প্রথম যা হয়, আশেপাশের সবাই হাসাহাসি করেছিল। এভাবে রাস্তার উপর ব্রিজের নীচে স্কুল! রাজেশবাবুকে প্রায় পাগল ভেবে নিয়েছিল লোকজন। কিন্তু বিশ্বাস আর ধৈর্য থাকলে কোনও সৎ প্রচেষ্টাই যে নষ্ট হতে পারে না, সেকথা আরেকবার প্রমাণ করে দিয়েছেন রাজেশ কুমার শর্মা। এই অবৈতনিক ক্লাসরুমে মূলত সরকারি স্কুলে ভর্তির জন্য ছেলেমেলেদের তৈরি করেন তিনি। প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করেছিলেন ১৪০ জন কিশোর-কিশোরীকে নিয়ে। তাদের ভিতরে জনা ৭০ ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সরকারি স্কুলে ভর্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। অন্য স্কুলে চলে গেলেও শর্মাস্যারকে ভোলেনি তারা। পড়া বুঝে নেওয়ার দরকার পড়লেই এখনও ছুটে আসে প্রিয় মাস্টারমশাইয়ের কাছে, ব্রিজের নীচের ক্লাসরুমে।