
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ধরুন আপনি খুব মন দিয়ে একটা বই পড়ছেন, হঠাৎ বুঝতে পারলেন আপনার ঘাড়ের কাছে গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। কেউ যেন পিছন দিক থেকে খুব ঝুঁকে পড়েছে আপনার দিকে। আচমকা ঘাবড়ে গিয়ে মাথা তুলে দেখলেন, ও মা! কেউ তো কোত্থাও নেই! কিংবা ধরুন, রোদ বাঁচিয়ে সিঁড়ির এক কোণে বসে বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছেন, আচমকা মনে হল করিডোরে কেউ হাঁটছে। তাও আবার যেমন তেমন হাঁটা নয়, একেবারে মিলিটারি কায়দায় জুতোয় শব্দ তুলে। অবাক হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকালেন। নাহ! কেউ কোত্থাও নেই! কিন্তু আপনি তো স্বকর্ণে স্পষ্ট শুনেছেন সেই আওয়াজ। নেহাত হাওয়ার কারসাজি নয়। ভাবছেন গাঁজাখুরি? না মশাই। কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে পড়তে এসে এ অভিজ্ঞতা হয়েছে এমন পড়ুয়ার সংখ্যাটা কিন্তু নয় নয় করে কম নয়।

দুশো বছরের কাছাকাছি বয়স হল ন্যাশনাল লাইব্রেরির। পুরোনো আমলের গথিক স্থাপত্যে মেশা এই বিখ্যাত লাইব্রেরিটি অনেক ইতিহাস আর অনেক অস্বাভাবিক ঘটনার সাক্ষী।
সেটা ১৮৩৬ সাল, ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী তখন কলকাতা। সেই ব্রিটিশ রাজত্বেই ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি নামে প্রথম এই গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়৷ সে সময় অবশ্য এটা একটা বেসরকারি উদ্যোগ ছিল। আর জানলে আশ্চর্য হবেন, সুবিশাল এই লাইব্রেরির প্রথম মালিক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর।

সেই সময় ভারতের গভর্নর-জেনারেল ছিলেন লর্ড মেটকাফ। তিনিই একদা ফোর্ট উইলিয়াম লাইব্রেরির বেশ কিছু বই দান করেন ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরিকে। সেই দান করা বইয়ের সংখ্যাই প্রায় ৫০০০… এই বিপুল সংখ্যক বই নিয়ে গোড়াপত্তন হয় এক নতুন নাগরিক লাইব্রেরির। হ্যাঁ, এই ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরিই ছিল শহরের প্রথম নাগরিক পাঠাগার, যা জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল।

এর প্রায় ৭০ বছর পর ১৯০৩ সাল নাগাদ লর্ড কার্জনের চেষ্টায় ‘ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি’ আর ‘ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি’কে একত্র করে জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এইসময় থেকেই আলিপুরের বেলভেডিয়ার রোড এলাকায় উঠে আসে লাইব্রেরিটি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫৩ সালে সেই ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি নাম বদলে হয় ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি’।
এসব অবশ্য নিছকই ইতিহাসের কচকচি। কিন্তু সেই ইতিহাসের সঙ্গেই তো জড়িয়ে আছে ন্যাশনাল লাইব্রেরির ভূত রহস্য। কীরকম? আসলে আলিপুরের যেখানে এখন ন্যাশনাল লাইব্রেরির পুরোনো বিল্ডিং, সেই বাড়িটাতে না কি একসময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস থাকতেন। লোকে বলে, অনেক প্রাচীন বইয়ের মতো সেই প্রাচীন শ্বেতাঙ্গ জেনারেলের প্রেতও না কি রয়ে গেছে ওই বাড়িটাতেই। সুযোগ পেলে মাঝেমাঝে নিজের উপস্থিতি জাহিরও করে যান। শুধু পড়ুয়ারাই নয়, ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে কর্মরত অনেক স্টাফই না কি ভরদুপুরে বা অন্ধকার নামার মুখে পুরোনো বিল্ডিংয়ে করিডোরে বা হলঘরে টের পেয়েছেন সেই অশরীরী উপস্থিতি।

বেশ কিছু বছর আগে পুরোনো বিল্ডিং সারানোর কাজ শুরু হয়েছিল ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। তাতে না কি বেজায় চটেছিলেন হেস্টিংস সাহেব। কালোচামড়ার নেটিভ ইন্ডিয়ানদের উপর লালমুখো সাহেবদের রাগ কেমন, তা তো আর নতুন করে বলতে হবে না। প্রাচীন ভবনটি পুনরুদ্ধারের কাজ চলাকালীন এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ১২ জন শ্রমিক। তা নিয়েও নানা কথা ঘুরে বেড়ায় লাইব্রেরির আনাচেকানাচে।
এই পুনরুদ্ধারের কাজ চলাকালীন পুরোনো লাইব্রেরির ভিতর একটা গোপন চেম্বার আবিষ্কার হয়। এই আবিষ্কার নিয়েও কম হইচই হয়নি সেসময়। প্রায় একটা ছোটোখাটো ঘরের আকারের লুকোনো চেম্বারটিতে কোনও দরজা জানালা ছিল না। কী উদ্দেশ্যে এটা তৈরি করা হয়েছিল তাও স্পষ্ট নয়। আগেকার দিনে পুরোনো দুর্গগুলোতে এরকম এক একটা গোপন ঘর থাকত, যাতে বিশেষ কিছু মূল্যবান জিনিস লুকিয়ে রাখা হত। ইংরেজ আমলে তৈরি এই লাইব্রেরি ভবনে কী জন্য এমন আশ্চর্য চেম্বার লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, সেটা আজও বোঝা যায়নি।

এই লাইব্রেরিতে না কি নাইট ডিউটি করতে ভয় পান প্রহরীরা। পুরোনো লাইব্রেরির স্টাফেদের জিজ্ঞাসা করলেই শোনা যায় তেমনই কিছু গা ছমছমে অভিজ্ঞতার কথা। রাত্তিরে পুরোনো বিল্ডিংয়ের ভিতরে না কি মেয়েদের গলার স্বর শোনা যায়। ইংরিজিতে কারা যেন কথা বলে বেড়ায়, বাতাসে ভেসে আসে হাসি আর বিদেশি মদের গন্ধ। লাইব্রেরির পুরোনো বল ডান্সের ফ্লোর থেকে এখনও নাকি ভেসে আসে কনসার্টের সুর। অনেকেই মনে করেন লর্ড মেটকাফ, যাঁর হাতে এই লাইব্রেরির গোড়াপত্তন তাঁর স্ত্রী’র বিদেহী আত্মা না কি এখনও ঘুরে বেড়ায় ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। এইসব অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ আর অস্তিত্ব টের পেয়েছেন অনেকেই। রাতের দিকে তাই লাইব্রেরির পুরোনো ভবনের দিকটায় পা রাখেন না কেউ।
আপনি কি ভুতে বিশ্বাস করেন? এই প্রশ্নটা কাউকে করলে বুকে হাত দিয়ে ‘না’ বলা বেশ মুশকিল। হ্যাঁ, কম-বেশি ভয় প্রায় আমরা সব্বাই পেয়ে থাকি। অশরীরী থাকুক আর নাই থাকুক, ‘ভূত’ শব্দটার সঙ্গেই যে জড়িয়ে আছে একটা গা ছমছমে রহস্যময়তা। অবশ্য ভূত নিয়ে আগ্রহ থাকলেও সরাসরি ভূতুড়ে পাল্লায় পড়তে চাই না আমরা অনেকেই। আবার অনেকেই আছেন, যাঁরা ভূত দেখবেন বলে আসমুদ্রহিমাচল চষে ফেললেও তেঁনার দেখা পাচ্ছেন না। তেমন কেউ চাইলে একবার ঢুঁ মেরে আসতেই পারেন রাতের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। কলকাতার মোস্ট ওয়ান্টেড হন্টেড প্লেসের তালিকায় কিন্তু জ্বলজ্বল করছে এই গ্রন্থাগারের নাম।
আসলে কংক্রিটের এই জঙ্গলে একটু নিরিবিলি শান্তির জায়গা পাওয়া দিন দিন যেমন দুর্লভ হয়ে যাচ্ছে, তেমনই ফুরিয়ে আসছে ভূতেদের কাল। আর সেখানের উজ্জ্বল ব্যতিক্রম কলকাতার ন্যাশালাল লাইব্রেরি। সেখানে এখনও অন্ধকার নামলেই ফিরে আসে প্রাগৈতিহাসিক কিছু ছায়া, কোলকাতার মায়ায় যারা আটকে আছে আজও।