
দ্য ওয়াল ব্যুরো: মানুষের চরম নিষ্ঠুরতায় একদিন পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেছিল ডোডো পাখির ঝাঁক। হারিয়ে গেছে সন্ন্যাসী সীল, লাল মাথা বানর, জেব্রার জাতভাই কোয়াগা বা আইরিশ হরিণের মতো প্রাণীরা। কিন্তু তারপরও কি হুঁশ ফিরেছে আমাদের! মহাভারতের যুধিষ্ঠিরের মতো এক আত্মধ্বংসী জুয়োখেলার আসরে মেতে আছে সমস্ত মানবসমাজ। একের পর এক দানে হারিয়ে যাচ্ছে চেনা প্রতিবেশীরা, ভেঙে পড়ছে বাস্তুতন্ত্র- তাও আমাদের নির্লজ্জ বণিকবৃত্তির শেষ নেই।

পৃথিবী জুড়েই যেন এক বিরাট খোলাবাজার। পাখি, কুকুরছানা থেকে গিরগিটি, প্যাঙ্গোলিন, অজগর থেকে অর্কিড- কী বিক্রি হয় না সেখানে! সোজাসাপটা জীবজন্তুর নিলাম, আর তা থেকে বেশ কয়েকহাজার বিদেশি মুদ্রার লেনদেন- বিশ্বের অনেক দেশেরই আমঘটনা এটা। প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন ডলারের জীবজন্তু কেনাবেচা চলে সারা পৃথিবীতে। আর আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশও তার থেকে আলাদা নয়।

করোনা পরবর্তী সময়ে, একটা বড়সড় মহামারী সামলে উঠে হয়তো লোকজন কিছুটা আড়ষ্ট। কিন্তু দুদিন পরই আবার খোলা বাজারে জীবজন্তু বিক্রি করা শুরু হয়ে যাবে। কোথাও কোথাও তো ইতিমধ্যে শুরু হয়েও গেছে৷ পরিবেশবিজ্ঞানীরা যতই চেঁচাক, আমাদের কাছাখোলা সমাজের হুঁশ ফিরছে না।
দিনকয়েক আগেই একটি বিখ্যাত নেচার পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়া একটা জার্নাল বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিল। কী বলা হয়েছিল সে লেখায়? বলা হয়েছিল, বন্যপ্রাণ নিয়ে আইনি বা অবৈধ যেসব ব্যবসা চলে, তার ফলে প্রকৃতিতে বিপদের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬২% প্রজাতি। বিপন্ন প্রজাতিগুলোর কথা নাহয় বাদই দিলাম। খোলাবাজারে বেচাকেনা করায় বহু আগেই খাদের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে তাদের অস্তিত্ব। দুদিন পর শুধু বিজ্ঞানবইয়ের পাতা ছাড়া আর কোথাও দেখা মিলবে না সেসব জীবজন্তুর।

এই যে বিশাল সংখ্যক বন্যপ্রাণী লেনদেন, কী হয় তাতে! জীবনদায়ী ওষুধের প্রয়োজনে তো বটেই, এছাড়াও শুনলে আশ্চর্য হবেন, আমাদের দামি পোশাক, জুতো, একসেসরিজ, কিংবা দামি বিলাসবহুল খাবারের প্লেট ভরাতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে এই পৃথিবীর অর্ধেক বাসিন্দা। অথচ তারাও আমাদেরই মতো প্রকৃতির সন্তান। পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার অধিকার যতটা আমাদের, তার থেকে কোনও অংশে কম নয় তাদেরও।
আমেরিকার শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কনজারভেশন সায়েন্ডের প্রফেসর এবং লেখক ডেভিড এডওয়ার্ডস কিছুদিন আগেই এ বিষয়ে একটি দীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছেন। তাতেও তিনি এই জীবজন্তু কেনাবেচার খারাপ দিকগুলো আর আগামী বিশ্বে তার পরিণাম যে কী ভয়াবহ হতে চলেছে- সে বিষয়টি তুলে ধরেন।
আরেকটা গবেষণা বলছে, এসব ক্ষেত্রে দুটো প্রবণতা খুব বেশি করে দেখা যায়। প্রথমত, ‘বাজার কী চাইছে?’ মানে সোজাসাপটা বললে কোন প্রাণীজ জিনিস ভালো বিকোচ্ছে। আর, কোথায় সেটা সবথেকে ভালো পাওয়া যায়! বন্যপ্রাণীদের যে স্বাভাবিক বাসভূমি, যেখানে অনুকূল পরিবেশে তারা বেড়ে উঠছে, ভালো থাকছে, সংখ্যায় বাড়ছে- সেই জায়গাগুলোর দখল নিতে লোভের হাত বাড়াচ্ছে মানুষ।
মজার কথা, এই মানুষ অশিক্ষিত বর্বর জনজাতি নয়, শিক্ষিত, আধুনিক, আর্বান মানুষ। জনজাতিরা শিকারের জন্য পশু মারে ঠিকই, কিন্তু বছরের পর বছর একই মাটিতে বেড়ে ওঠার দরুন পশু সংরক্ষণ নিয়েও তাঁরা আমার- আপনার থেকে অনেক বেশি সচেতন। প্রকৃতিপাঠের জন্য তাদের কখনও ইস্কুল-কলেজে প্রথাগত ডিগ্রিশিক্ষা করতে হয়নি।
বন্যপ্রাণ ব্যবসা নিয়ে এখন অব্দি যা গবেষণা হয়েছে তার সিংহভাগটাই হয়েছে দক্ষিণ আমেরিকা আর আফ্রিকার গ্রীষ্মমণ্ডলে। এশিয়ার সমস্যা নিয়ে হাতেগোনা মাত্র চারটে সমীক্ষা হয়েছে এখন পর্যন্ত৷ আরও হতাশাজনক ইউরোপের অবস্থা। মূলত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের অবলুপ্তি নিয়েই এসব গবেষণা হয়েছে। এর সঙ্গে ব্যাঙ, গিরগিটি প্রভৃতি উভচর প্রাণী, মৌমাছি-প্রজাপতি, কীটপতঙ্গ, গাছপালা- এদের কথাও যদি ভাবতে হয় বিষয়টা কতটা ভয়ংকর আর এলার্মিং হয়ে উঠতে পারে, আন্দাজ করতে পারছেন নিশ্চয়ই। একই ভয় পাচ্ছেন প্রকৃতিবিজ্ঞানীরাও ।
স্থানীয় বাজারে লেনদেন ব্যাপারটা বেশ ভয়াবহ, কিন্তু তার চেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় আন্তর্জাতিক বাজারের আগ্রাসন। একটা প্রজাতিকে তার স্বাভাবিক বাসভূমি ছেড়ে দূরদেশে পাঠিয়ে দিলে অজানা অচেনা পরিবেশে তার জীবনসংগ্রাম কী মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে পারে, তা অনুমান করাও মুশকিল। অথচ বিদেশি মুদ্রার লোভে সেই জিনিসটাই অহরহ ঘটছে চারপাশে৷ উদাহরণের খোঁজে বেশি দূর যেতেও হবে না। পোষ্যপ্রেমের নামে আমার-আপনার ঘরেই বিদেশি কুকুর ব্রিডিংয়ের যে রমরমা, তা দেখেও কপালে ভাঁজ পড়েছে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের। সোজা নিয়ম বলছে, যত অচেনা পরিবেশে, অচেনা খাদ্যাভ্যাসে একটা প্রজাতিকে ঠেলে দেওয়া হবে, তত বিপদ বাড়বে তার।
চিনের কথাই ধরা যাক। বিরাট জনসংখ্যার অত বড় দেশ, যত দিন গেছে নতুন নতুন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে যোগাযোগ ব্যবস্থার কী উন্নতিটাই না তারা করেছে! একমুহূর্তে ৬২℅ মানুষের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগাযোগ তৈরি করে পুরোনো ঐতিহ্যবাহী চিনা ওষুধের নতুন বাজার তৈরির চেষ্টা করছে তারা৷ জীববৈচিত্র্যের জন্য এই সম্প্রসারণ একটা বড় হুমকি। এর ফলে বাদামি ভাল্লুক বা তুষার চিতার মতো বিপন্নপ্রায় প্রাণীদের বাজারি চাহিদা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা৷ অর্থাৎ উন্নত সমাজব্যবস্থায়, ব্যবসার উন্নতির নামে এই অবলা প্রাণীগুলোকে অবলুপ্তির পথে আরও একধাপ ঠেলে দেওয়া হল।

সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলোতে তাও পশুরা কিছুটা ভালো থাকে, কিন্তু অসংরক্ষিত এলাকা, বিশেষত মানুষ নামক জন্তুটির সান্নিধ্য বাকি জীবজগতের জন্য যে একেবারেও স্বাস্থ্যকর নয়, বিশ্ব জুড়ে করা একাধিক সমীক্ষার ফলাফল দেখলেই তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে যায়।
এ তো গেল প্রাণীদের কথা৷ কিন্তু তার বাইরের জীবজগৎ? অস্বীকার করার উপায় নেই, তারাও একটা বড় থ্রেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।৷ পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন গাছপালা আর প্রাণী আন্তর্জাতিকভাবে পাচার হয়, যা থেকে প্রতিবছর আনুমানিক ৪-২০ বিলিয়ন ডলার আমদানি করে বিভিন্ন দেশ।
চাষের জন্য ব্যাপকভাবে জঙ্গল কাটা পড়েছে বিভিন্ন দেশে। তার ফলে হারিয়ে গেছে গুল্মের বহু প্রজাতি। যেসব ঘাস-লতা বছর ২০ আগেও দিব্যি দেখা যেত গ্রামে-মফসসলে, এখন তারা একেবারে নিশ্চিহ্ন পৃথিবীর বুক থেকে৷ চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতিও এর জন্য কম দায়ি নয়। কিছু বিশেষ প্রজাতির গাছপালা তার ওষধিগুণের জন্য এত বেশি পরিমাণে বিদেশে চালান হয়েছে, যে স্বাভাবিক পরিবেশে তাদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়েছে৷ এর’ম চললে অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলব আমরা।

তাহলে উপায়? বিজ্ঞানীরা সরাসরিই বলছেন উপায় একটাই। খোলা বাজারে জন্তু বিক্রি আইন করে বন্ধ করা হোক। বেআইনি ব্যবসা নিয়ে কড়া হোক পুলিশ প্রশাসন। আর আরও বেশি বেশি সুরক্ষিত সংরক্ষিত অঞ্চল তৈরি হোক পশুপাখিদের জন্য। বিজ্ঞানীরা বলছেন বটে, তবে সাধারণ মানুষের কবে টনক নড়বে কে জানে! সে দোটানার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের প্রিয় সবুজ এই গ্রহের ভবিষ্যৎ।