
বয়সের মার্জিন কমছে, বাড়ছে মৃত্যুহার! এদেশে মেয়েদের ক্যানসারে ঝুঁকি অনেক বেশি
তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
আন্তর্জাতিক নারীদিবস প্রতি বছরই আসে আর যায়। নারীশক্তির আলোকে সামনে আসে নানা কাহিনি। বঞ্চনার ইতিহাসকে সরিয়ে গৌরবের দৃষ্টান্তরা মাথাচারা দেয়, অন্তত এই একটি দিনের তরে। এই দিনেই যে আরও একটি বিশেষ দিকে নজর দেওয়া যায়, তা হল ক্যানসারের মতো একটা মারণ অসুখের সঙ্গে নারীদের লড়াইটা ঠিক কোনখানে দাঁড়িয়ে।
না, এ লড়াই কখনওই এক দিনের নয়। তবে একটি বিশেষ দিন যদি বেছে নেওয়া যায় এ নিয়ে আলোচনার জন্য, তবে তাতে কোনও ক্ষতি অন্তত নেই। সর্বোপরি, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারী অধিকারের পাশাপাশিই, স্বাস্থ্যের কথা সামনে আসা কম জরুরি নয়। এমনটাই মনে করেন সার্জিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট ডক্টর শুভদীপ চক্রবর্তী। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তিনিই দ্য ওয়ালের মুখোমুখি।
দ্য ওয়াল: এদেশের মেয়েদের ক্ষেত্রে কোন কোন ক্যানসার সবচেয়ে ক্ষতিকর?
ডক্টর: গ্লোবোকন ২০২০ সমীক্ষা বলছে, ভারতের মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় স্তন ক্যানসার। তার পরেই আসে জরায়ু ও জরায়ুমুখের ক্যানসার। তার পরে রয়েছে ওভারি বা ডিম্বাশয়ের ক্যানসার, মুখের ক্যানসার ও কোলোরেকটাম ক্যানসার।
দ্য ওয়াল: বাকি পৃথিবীর নিরিখে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে ভারতীয় মহিলাদের ক্যানসারের ঝুঁকি?
ডক্টর: ল্যানসেট অঙ্কোলজির স্টাডি বলছে, ভারতে ৪৫ থেকে ৫০ বছরের মহিলাদের মধ্যে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাকি বিশ্বের তুলনায় অনেকটাই বেশি। অন্যান্য দেশে এই বয়সটা হয় গড়ে ৬০ বা তার বেশি।
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি আট মিনিটে এক জন করে ভারতীয় নারী জরায়ুমুখের ক্যানসারে মারা যাচ্ছেন। আবার স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়া প্রতি দু’জন ভারতীয় নারীর মধ্যেও মারা যাচ্ছেন এক জন করে।
দ্য ওয়াল: স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে বয়সের এই ফারাকটা হওয়ার কারণ কী?
ডক্টর: এটা স্পষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে কয়েকটা তথ্য সামনে রাখা যেতে পারে, যাতে এ অসুখের সম্যক চেহারা স্পষ্ট হবে।
প্রথমত, সারা বিশ্বের তুলনায় অনেক বেশি কমবয়সি মহিলা স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন ভারতে।
দ্বিতীয়ত, কুড়ির কোঠায় স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়া মহিলার সংখ্যা বাড়ছে দেশে।
তৃতীয়ত, প্রায় ৫০ শতাংশ রোগীই ডাক্তারের কাছে এসে পৌঁছচ্ছেন স্টেজ থ্রি-তে পৌঁছে যাওয়ার পরে, ২৫ থেকে ২০ শতাংশ আসছেন স্টেজ ফোরে। অর্থাৎ তখন আর চিকিৎসার বিশেষ সুযোগই মেলে না।
দ্য ওয়াল: কেন এতটা বেশি ঝুঁকি!
ডক্টর: এর একটা মূল কারণ হল, সচেতনতার অভাব। ৭৫ শতাংশ মহিলাই অজ্ঞানতা ও অসচেতনতার কারণে এত দেরি করে চিকিৎসকের কাছে পৌঁছন, যে তখন চিকিৎসায় অনেক দেরি হয়ে যায়। মূলত এই কারণেই এ দেশে ক্যানসার আক্রান্ত নারীদের মধ্যে মৃত্যুর হার অনেক বেশি।
দ্য ওয়াল: ভারতের মহিলাদের ক্যানসারের মধ্যে কি কোনও আঞ্চলিক বিভাজনও দেখা যায়?
ডক্টর: হ্যাঁ, স্পষ্ট। গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করা মহিলাদের মধ্যে জরায়ু ও জরায়ুমুখের ক্যানসারের প্রবণতা বেশি। আবার শহরাঞ্চলে মহিলারা বেশি ভুগছেন স্তন ক্যানসারে।
দ্য ওয়াল: কেন এমনটা হচ্ছে?
ডক্টর: গ্রামের মহিলাদের মেনস্ট্রুয়াল হাইজিনের বিষয়টি যথাযথ নয়। দেশের মাত্র ১২ শতাংশ মহিলা স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন। এছাড়াও অসংখ্য ভুল ধারণা ও কুসংস্কার ছড়িয়ে রয়েছে মেয়েদের মাসিক ঋতুচক্র নিয়ে। সেসবের জেরে তৈরি হওয়া অপরিচ্ছন্নতা সংক্রমণ ঘটায় যৌনাঙ্গে। তা থেকেই ছড়িয়ে পড়ে সমস্যা।
আবার ব্রেস্ট ক্যানসারের একটা মূল কারণ হল হরমোনাল ডিসব্যালেন্স। ইস্ট্রোজেন হরমোনের ক্ষরণ বেশি হলে এই ঝুঁকি বাড়ে। এখন খারাপ লাইফস্টাইল, ওবেসিটি, তৈলাক্ত খাবার বেশি খাওয়া, দেরি করে বিয়ে করা, সন্তানধারণে দেরি করা বা সন্তানধারণ না করা, সন্তানকে স্তন্যপান না করানো– এগুলি সবই ইস্ট্রোজেনের আধিক্য বাড়াতে থাকে। শহরাঞ্চলের একটা বড় অংশের মহিলাদের মধ্যেই এই অভ্যেস দেখা যায়। ফলে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।
দ্য ওয়াল: মহিলাদেরও কি হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসার হতে পারে?
ডক্টর: অবশ্যই। আন্তর্জাতিক সমীক্ষা বলছে, ভারতে মোট যত ক্যানসার হয়, তার ১০ শতাংশই হল মহিলাদের মাথা ও মুখের ক্যানসার।
দ্য ওয়াল: কী কী ভাবে মহিলারা ক্যানসারের ঝুঁকি এড়াতে পারেন?
ডক্টর: জরায়ুমুখের ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে স্মোকিং বন্ধ করতে হবে, মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন রক্ষা করা খুব জরুরি। সময়মতো এইচপিভি ভ্য়াকসিন নিতে হবে। বহু শয্যাসঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্ক ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
আবার স্তন ক্যানসারের জন্য আগে মডিফাই করতে হবে লাইফস্টাইল। তৈলাক্ত, প্রসেস্ড খাবার, জাঙ্কফুড বন্ধ করতে হবে, মদ্যপানে পরিমিতি চাই। সময়মতো সন্তানধারণ ও বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো জরুরি। নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে।
হেড অ্যান্ড নেক ক্যানসারের ক্ষেত্রে বন্ধ করতে হবে গুটখা বা তামাকজাত কোনও রকম নেশার দ্রব্য নেওয়ার অভ্যেস। মুখের পরিচ্ছিন্নতা মেনটেন করা খুব জরুরি।