
বিজ্ঞান মানুষকে সুখ, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা দিতে পারে। কিন্তু তার মধ্যে মানবিকতা জাগিয়ে তুলতে পারে না। এমন অনেক সমস্যা আছে যা শুধুমাত্র বিজ্ঞানের সাহায্যে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। অতিমহামারী তার মধ্যে একটি। কোনও জনগোষ্ঠীর মধ্যে যখন মারণরোগের বীজ হু হু করে ছড়াতে থাকে, তাকে প্রতিরোধ করতে হলে চাই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। রোগী ও তার পরিজনদের দিকে বাড়িয়ে দেওয়া চাই সহমর্মিতার হাত। শুধুমাত্র ওষুধ বা ভ্যাকসিন দিয়ে অতিমহামারী দূর করা যায় না।
আমাদের দেশে জানুয়ারি মাসের শেষে প্রথম কোভিড ১৯ রোগের সংক্রমণ ধরা পড়ে। তারপর থেকে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মাঝে লকডাউন করে কিছুদিন সংক্রমণের হার কমেছিল। কিন্তু বেশিদিন তো সব বন্ধ রাখা যায় না। তাই একসময় আনলক করতেই হয়েছে। তার পরে হু হু করে বাড়ছে সংক্রমণ। অগাস্টের গোড়ার দিকে একদিন তো দেশে প্রায় ৬৫ হাজার মানুষ সংক্রমিত হয়েছিলেন।
করোনা সংকটের শুরু থেকে স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগের বিরুদ্ধে লড়ছেন। অনেক সময় যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই রোগীর পরিচর্যা করতে হচ্ছে। ফলে তাঁরা নিজেরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে। আইএমএ জানিয়েছে, কোভিড সংকটে ভারতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২০০ জন চিকিৎসক।
অতিমহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনেক সাধারণ মানুষও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁদের জন্য রোগীর জীবন রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু বিপরীত উদাহরণও কম নেই। পাছে করোনা হয়, এই ভয়ে অনেকে বুদ্ধি-বিবেচনা হারিয়ে ফেলেছেন। এমন আচরণ করছেন যা সভ্য মানুষকে শোভা পায় না।
মঙ্গলবারই অভিযোগ উঠেছে, কোভিডে মৃত এক ব্যক্তিকে শেষবারের মতো দেখতে দেওয়ার জন্য তাঁর আত্মীয়দের থেকে টাকা চেয়েছেন শিবপুর শ্মশান ঘাটের কর্মীরা। সোমবার শোনা যায়, করোনায় মৃত্যু সন্দেহে ক্যানিং-এ এক ব্যক্তির পরিবারকে একঘরে করে রেখেছে গ্রামের মানুষ। দীর্ঘ ১৭ ঘণ্টা মৃতদেহের সৎকার করা যায়নি।
করোনা সংকট শুরুর পর থেকেই দেশের নানা প্রান্তে স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপরে আক্রমণের খবর আসছে। হায়দরাবাদ, দিল্লি, বেঙ্গালুরু, শেওপুর, মোরাদাবাদ ও আরও নানা স্থানে মানুষ স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমসিম খেয়েছে পুলিশ। হাওড়ার বেললিয়াস রোডে লকডাউন কার্যকর করতে গিয়ে পুলিশই আক্রমণের মুখে পড়েছে।
অনেক শহরে দেখা গিয়েছে, কোনও চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী করোনা রোগীদের সেবা করছেন জানলে তাঁকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিবেশীরা ভাবছেন, তাঁকে পাড়ায় থাকতে দিলে ছড়াতে পারে মারণ রোগ।
সরকারি হিসাবমতো, ভারতে ২২ লক্ষ ৭৭ হাজারের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গিয়েছেন ৪৫ হাজারের বেশি মানুষ। এই অবস্থায় নাগরিকদের এক বড় অংশ ভীতসন্ত্রস্ত। তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু আতঙ্কিত হয়ে বুদ্ধি-বিবেচনা হারিয়ে ফেলা দোষের। বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। একথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু বিপদে পড়লে ওই কথাটিই ভুলে যাই সকলের আগে। নার্ভাস হয়ে পড়ি। এমন অনেক আচরণ করি যা স্বাভাবিক অবস্থায় করার কথা ভাবতেই পারতাম না।
এর মধ্যে মঙ্গলবার একটা বড় খবর এসেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বড় মুখ করে বলেছেন, তাঁর দেশ করোনার টিকা আবিষ্কার করে ফেলছে। এই দাবি নিয়ে আবার সংশয় প্রকাশ করেছেন কয়েকটি পশ্চিমী দেশের বিজ্ঞানীরা।
এতদিন আমরা জানতাম, বিশ্ব জুড়ে মোট ছ’টি সংস্থা ভ্যাকসিন গবেষণায় এগিয়ে রয়েছে। তাদের কেউ কেউ হয়তো আর কয়েক মাসের মধ্যে প্রতিষেধক এনে ফেলবে। কিন্তু এখনই গণ হারে টিকাকরণ বোধহয় সম্ভব হবে না। পুতিন বলেছেন, আগামী জানুয়ারি মাস থেকে আম জনতাকে টিকা দেওয়া শুরু হবে। অন্যান্য সংস্থা ভ্যাকসিন আনলেও আগামী বছরের আগে টিকাকরণ শুরু করা যাবে কিনা সন্দেহ।
অতএব চলতি বছরের বাকি সময়টা অতিমহামারী আমাদের ছাড়বে না। অনেকে বলছেন, শীতে আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে ভাইরাস। তাই খুব সাবধানে থাকতে হবে। কিন্তু ভয় পেলে চলবে না। করোনা মানেই মৃত্যু নয়। বেশিরভাগই সেরে উঠছেন। আরও বেশি মানুষ যাতে সেরে উঠতে পারেন, সেজন্য বাড়িয়ে দিতে হবে সাহায্যের হাত। আগামী প্রজন্ম যেন বলতে না পারে, করোনার সংক্রমণে আমাদের দেশে মানবিকতার মৃত্যু হয়েছিল।