
দ্য ওয়াল ব্যুরো: আলো ফুটতেই হাতে ঝাড়ু নিয়ে পথে নেমে পড়েন দু’দুটো গ্রামের মানুষ৷ পথেঘাটে, বাড়ির পাশের আবর্জনা টেনে এনে জড়ো করা হয়। সেই জঞ্জাল ফেলার জন্য বাঁশ দিয়ে প্রায় খান ষাটেক ডাস্টবিন বানিয়েছেন গ্রামের মেয়েরাই। ঘণ্টাখানেকের এই সাফাই অভিযান শেষ হতে না হতেই এসে পড়েন মাস্টারমশাইয়েরা। ইস্কুলের সময় না হওয়া অব্দি তাঁদেরই তত্ত্বাবধানে গ্রামে গ্রামে চলে কচিকাঁচাদের পঠনপাঠন। ঝাড়খন্ডের দুটি গ্রাম ‘আরা’ ও ‘কেরাম’এর এই এখন রোজনামচা।এতকালের দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অনুন্নতির চেনা ছবি ছাপিয়ে এখন আরা আর কেরাম, দুটি গ্রামই আত্মনির্ভরতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এমনকি কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর বিখ্যাত টক শো ‘মন কি বাঁতে’তেও স্বনির্ভর ভারতের কথা বলতে গিয়ে এই গ্রামদুটোর উদাহরণ টেনেছেন।
একদিন এই গ্রামের মেয়েরা প্রায় কোমর বেঁধে পথে নেমেছিল। সর্বনাশা মদের নেশায় তাদের বাড়ির পুরুষেরা বারমুখী তখন। সেই নেশার থেকে এলাকার পুরুষদের বের করে আনতে একজোটে বিক্ষোভ জানিয়েছিল। এখন অবশ্য ছবিটা অন্য। গ্রামবাসীদের অনেকেই এখন স্বনির্ভরভাবে হাঁস মুরগি পালন করেন, দুধের ব্যবসা করেন, ছোটো দোকানও চালান কেউ কেউ। অবিশ্বাস্য শোনালেও গত চার বছরে এই দুটি গ্রামের গড় আয় প্রায় পাঁচ গুণ বেড়েছে।
এলাকায় সাকুল্যে একটিমাত্র পাবলিক স্কুল। তাতে এতকাল ক্লাস নিতেন মাত্র দুজন প্যারাটিচার। ২০১৭ সালে গ্রামবাসীরাই স্যারেদের বেতন থেকে অল্প কিছু টাকা কেটে মাসিক ৪০০০ টাকার বিনিময়ে কলেজ পাশ করা দুজনকে নিয়ে এসেছেন ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর জন্য।
কিন্তু এই অসাধ্যসাধন হল কীভাবে? যে মানুষটিকে ছাড়া এই রূপকথা অধরাই থেকে যেত, তিনি সিদ্ধার্থ ত্রিপাঠি। সাড়ে চার বছর আগে ঝাড়খণ্ডে এমজিএনরেগা-এর কমিশনার হয়ে আসেন ১৯৯৯-ব্যাচের ফরেস্ট সার্ভিস অফিসার সিদ্ধার্থ ত্রিপাঠি। আইআইটি রুরকি থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স করার পর ফরেস্ট অফিসার হিসাবে তাঁর কর্মজীবন করেন সিদ্ধার্থ। ২০০১ সালে প্রথম পোস্টিং হয় চাঁইবাসায়।
প্রথম পোস্টিংয়েই প্রত্যন্ত গ্রামীণ ভারতকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ আসে। বইয়ের পাতার বাইরে এসে সিদ্ধার্থ এই প্রথম দেখলেন দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অপুষ্টি আর অন্ধকারে ছেয়ে থাকা এ দেশের আসল ছবি।
‘বেটার ইন্ডিয়া’কে দেওয়া একটা সাক্ষাৎকারে সিদ্ধার্থ জানিয়েছেন, কত হতাশাজনক ছিল সেই শুরুর দিনগুলো। কীভাবে এই দারি্দ্র্যের অন্ধকার থেকে টেনে তোলা যায় দেশের মানুষকে, তা স্পষ্ট ছিল না তাঁর কাছে। প্রথমজীবনে চাঁইবাসা হাজারিবাগ অঞ্চলে চাকরি করতে গিয়ে তিনি যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন, তাকে পুঁজি করেই আগামীর পরিকল্পনা শুরু করেন সিদ্ধার্থ। সরকারি নির্ভরশীলতা কাটিয়ে গ্রামগুলো নিজেদের পায়ে উঠে দাঁড়াক, এই স্বপ্নই দেখেছেন বরাবর। ২০০৪ সালে কোডারমায় ডিএফও থাকাকালীন সে ব্যাপারে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষাও শুরু করেন।
সারা দেশে প্রায় সাড়ে ছলাখ গরীব গ্রাম রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে জনকল্যাণের একটা সার্বিক মডেল গড়ে তোলা যে খুব সোজা কাজ নয়, সেটা সিদ্ধার্থ জানতেন। ধন্দে ছিলেন তাঁর সহকর্মীরাও। বন্ধুরা প্রায়ই না কি মজা করে বললেন “ইতনে সারে গান্ধি কাঁহা সে আয়েঙ্গে”( এতগুলো গান্ধি একসঙ্গে আসবে কোথা থেকে)! কিন্তু কোনও বিরুদ্ধ পরিস্থিতিই দমাতে পারেনি দৃঢ়চেতা সিদ্ধার্থ ত্রিপাঠিকে।
স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে সেসময় কী করেননি সিদ্ধার্থ! কখনও সেচকূপ নির্মাণ করে কৃষি উন্নতির চেষ্টা চালিয়েছেন। কখনও অবৈধ চোলাই মদ আর মহুয়ার বিরুদ্ধে ক্যাম্পেনিং করেছেন গ্রামে গ্রামে। কখনও বাসিন্দাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য বরাদ্দ করে ফেলেছেন গোটা একটা দিন।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতেও চলে গেছেন নকশাল অধ্যুষিত প্রত্যন্ত গ্রামে। কথা বলেছেন, গ্রামসভা গঠনের চেষ্টা করেছেন। মদের নেশা হোক, বা গ্রামবাসীদের গার্হস্থ্য সমস্যা – পাশে থাকতে চেয়েছেন সবসময়।
কিন্তু জীবন তো রূপকথা নয়। তাই সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতাও এসেছে বহুবার। এ প্রসঙ্গেই সিদ্ধার্থ তুলে ধরেন একটি অভিজ্ঞতার গল্প, যেখানে ভিন জাতের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করার অপরাধে গ্রামেরই এক কিশোরকে নির্মমভাবে হত্যা করেন ওই মেয়ের পরিবারের লোকজন। সেসময় পুলিশি অত্যাচারের ভয়ে বাসিন্দারা গ্রাম বড় শহরে পালাতে শুরু করে। অপূর্ণ থেকে যায় সিদ্ধার্থের স্বনির্ভর গ্রাম গঠনের স্বপ্ন।কিন্তু তারপরও হাল ছাড়েননি এই তরুণ অফিসার। আবার সুযোগ আসে। সিমারকুণ্ডি নামে জঙ্গলে ঘেরা এক প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামে দায়িত্ব সামলানোর সময় নতুন করে সাফল্যের মুখ দেখেন সিদ্ধার্থ।
কোডারমার ডিএফও থাকাকালীন তিনি তখনও কোনও নকশাল গ্রামে যাননি। এদিকে গ্রামউন্নয়নের দেড় লাখ টাকা খরচ করার জন্য উপরমহল থেকে চাপ আসছিল। স্থানীয় রেঞ্জ অফিসারেদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধার্থ বোঝেন গ্রামে সবার আগে পানীয় জল দরকার। গ্রামবাসীদের সেসময় খাবার জল পাওয়ার জন্য শুকনো নদীখাত খুঁড়ে জল তুলতে হত। এলাকাবাসীদের জলকষ্ট দূর করতে স্থানীয় অফিসারদের সহায়তায় সে সময় প্রায় ৭৮,০০০ টাকা ব্যয়ে একটি ৩০ ফুট গভীর পানীয় কূপ খননের কাজ শুরু করেন সিদ্ধার্থ। প্রথমবার সেই গ্রামে পৌঁছনোর অভিজ্ঞতা ভারি অদ্ভুত ছিল। ২০০৬ সালে প্রায় দুঘণ্টা ট্রেক করে সেই গ্রামে প্রথমবার পা রাখেন সিদ্ধার্থ। আর প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে যান। সাক্ষাৎকারে সিদ্ধার্থ বলেন,” কূপ খননের পর প্রতি সপ্তাহে গ্রাম পরিদর্শনে যেতাম আমি। প্রায় ১৪ কিলোমিটার হেঁটে যেতে হত আমায়। আর এখন আপনি চাইলে নিজের গাড়ি নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন ওই গ্রাম থেকে।”
আগে যেখানে গ্রামের বার্ষিক আয় ছিল মাত্র ২০,০০০ টাকা, সেখানে আজ ওই গ্রামের বাসিন্দারা কৃষিকাজ ও যৌথ পশুপালনের মাধ্যমে বার্ষিক ৪৭ লক্ষ টাকা আয় করেন। স্বেচ্ছায় মদ ছেড়েছেন গ্রামের অসংখ্য পুরুষ৷ একসময় যে গ্রামে পানীয় জলের একটি কূপও ছিল না, এখন সেখানেই সমস্ত জমি জলসেচের আওতাভুক্ত।
দুবছরের মধ্যে খামারের উন্নতি হয়েছে, বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়েছে, সার্বিক পরিচ্ছন্নতা বেড়েছে গ্রামের ভিতরে। ফ্যামিলি প্ল্যানিং নিয়ে সচেতনতাও বেড়েছে। এমনকি অবৈধ কাঠ কাটা বন্ধ করে গাছের গায়ে রাখি পরিয়েছেন গ্রামের মানুষ। ২০০৮ সালে কোডারমা থেকে রাঁচি চলে যাওয়ার পরেও গ্রামগুলির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে গেছেন সিদ্ধার্থ।
গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে দাঁড়ানো, শিক্ষা প্রচার এবং গ্রামসভা গঠন -এই তিনটি পদক্ষেপকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন সিদ্ধার্থ, তাঁর আদর্শ গ্রামের মডেলে। এছাড়াও,সার্বিক পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিকেও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এই মডেলে। এই পরিচ্ছন্নতা আবার ৫ রকমের – জমি ও ক্ষেতের পাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করা, প্লাস্টিকের বর্জ্য সংগ্রহ করা, জল শোধন ও পুনর্ব্যবহার, বাড়ি থেকে দূরে কম্পোস্টের ব্যবস্থা এবং সুলভ শৌচালয় নির্মাণ। তবে সিদ্ধার্থের মতে, সবার উপরে জনগনের আস্থা আর বিশ্বাস অর্জন।
আরা আর কেরামের সাফল্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে সিদ্ধার্থ বলেন, “আমরা প্রথমে সামাজিক সমস্যা নিয়ে কাজ শুরু করি। গ্রামসভাগুলোর সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবাইকেই ডাকা হত। সরকারি সাহায্য ছাড়া তারা নিজেরাই যাতে নিজেদের সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারেন, সেদিকে বিশেষ নজর দিতাম আমরা। এভাবেই গ্রামের মানুষ নিজের চেষ্টায় মদ ছেড়েছেন, স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন, পরিবার পরিকল্পনা শুরু করেছেন। বন্ধ হয়েছে শিশুশ্রম বা বাল্যবিবাহের মতো কুপ্রথা। মেয়েদের পড়াশোনার হারও বেড়েছে আগের থেকে অনেকটাই। এমনকি বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জীবিকা, জল, জঙ্গল কিংবা চাষবাসের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যাগুলিও একে একে সমাধানের পথ খুঁজে পাচ্ছে। ”
সিদ্ধার্থবাবু এবং তাঁর সহকর্মীদেরদের সম্মিলিত চেষ্টায় আরা আর কেরাম এই গ্রামদুটোর মোট আয় আগের থেকে পাঁচগুণ বেড়েছে। তিন বছরের মধ্যেই ভোল বদলে গেছে গ্রামের মানুষজনেরও। তাঁরা এখন অনেক বেশি স্বচ্ছল আর সুখী। ঠিকঠাক প্রয়োগ হলে এই কর্মসূচি গ্রামীণ ভারতে সাফল্য আনতে পারে, বদলে যেতে পারে গ্রাম ভারতের মুখ। সিদ্ধার্থবাবুদের নেতৃত্বে সেই সাফল্যেরই পথ দেখাচ্ছে ঝাড়খণ্ডের ‘আরা’ আর ‘কেরাম’।