
বড় ম্যাচে আমার প্রথম গোল চ্যাপ ভাইয়ের ক্রস থেকে, সেই ছবি আজও বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো আছে
দীপেন্দু বিশ্বাস
(প্রাক্তন ভারতীয় ফুটবলার)
কলকাতা মাঠ একটা অন্যরকম জায়গা। এখানে যেমন আবেগও রয়েছে, তেমনি আবার সেই আবেগকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা তোলার চেষ্টাও থাকে। এতবছর কলকাতা মাঠে খেলে সেটি প্রতিনিয়ত বুঝেছি।
আবার কিছু কিছু ঘটনাও রয়েছে, যেগুলি মনকে আনন্দ দেয়, এখনও বাড়িতে বসে ভাবলে উদীপ্ত হই। এও ভাবি যে ওই মানুষগুলি ছিল বলেই আমি ফুটবলার হিসেবে যতটা পেরেছি নাম করতে পেরেছি, বা মানুষের ভালবাসা অর্জন করেছি। কাউকে পাশে থাকতে হয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, সে ফুটবল মাঠ হোক বা রাজনীতি, বা অন্য কোনও আঙিনায়।
আমি যখন টিএফএ (টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমি)-তে যোগ দিই, সেইসময় অ্যাকাডেমির ডিরেক্টর মহম্মদ হাবিব। আমি যে বছর গেলাম, সেইবছরই শেষ ছিল কার্লটন চ্যাপম্যানদের।
যে কোনও জায়গায় জুনিয়রদের ওপর সিনিয়রদের একটা কর্তৃত্ব থাকে, আমি সেটাই ভেবেছিলাম অ্যাকাডেমিতে গিয়ে। যে আমার ক্ষেত্রেও হয়তো তেমনই হবে। কিন্তু ভুলটা আমার ভাঙতে থাকে চ্যাপম্যানের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকে। প্রথমে আমি ‘কার্লটনদা’ বলতাম, তারপর দেখি ওকে সবাই ‘চ্যাপ’ বলে ডাকছে, তো আমার কাছেও সেই থেকে চ্যাপদা নয়, ‘চ্যাপ-ভাই’ হয়ে গেল।
আমাকে নানাভাবে পরামর্শ দিত, বলত, শর্টকাটে কিছু হয় না দীপু, তোকে একদিন ভারতের একনম্বর স্ট্রাইকার হতে হবে। তার জন্য যা দরকার, যা পরিশ্রম করার কথা, সেটা করে যা, তোকে কেউ আটকাতে পারবে না। আমি ওঁর কথা রাখতে পেরেছিলাম। ভারতের হয়ে দীর্ঘদিন খেলেছি। একজন সিনিয়র যে একজন জুনিয়রকে ওভাবে পাশে থেকে বড় দাদার মতো সাহায্য করতে পারে, আমি দেখেছিলাম চ্যাপম্যানের মধ্যে।
আমি ওঁর ব্যাঙ্গালোরের অস্টিন টাউনের বাড়িতেও গিয়েছি, রাতে থেকেছি, গল্প করেছি। চ্যাপ ভাই-এর একটি ছেলে, আরও একটি মেয়ে। ভাবি তো রয়েইছে, কিন্তু খুব কষ্ট হচ্ছে ওই দুই সন্তানের জন্য। কত অল্পবয়সে বাবাকে হারাল।
অনেকেই আমাকে সারাদিন কত সব প্রশ্ন করেছে চ্যাপ ভাই নিয়ে। আমাকে একজন তার মধ্যে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কাছে কে এগিয়ে থাকবে মানুষ চ্যাপম্যান, না ফুটবলার চ্যাপম্যান? আমি তাঁকে বলেছিলাম, দুজনকেই এগিয়ে রাখব, দুইজনই থাকবে সমান-সমান। বড় হৃদয়ের মানুষ ছিল। কোনও ফুটবলার কোনও বিপদে পড়েছে, তাকে তৎক্ষণাৎ বিপদমুক্ত করতে সচেষ্ট হতো। বাইরে ভারতের হয়ে খেলতে গিয়েছি, কিংবা বাংলার হয়ে ভিনরাজ্যে সন্তোষ ট্রফি খেলতে গিয়েছি, রাতবিরেতে কারোর কোনও অসুবিধে হলে চ্যাপ ভাই আগে প্রস্তুত এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। এই অকুতোভয় ব্যাপারের জন্য ও যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল।
আমার বিশেষভাবে মনে পড়ছে ১৯৯৮-৯৯ মরসুমে যেবার আমি ইস্টবেঙ্গলে যোগ দিই। মোহনবাগান ম্যাচের সে কী টেনশন। ওই প্রথম বড় ম্যাচ খেলতে নামব, তার আগে এসে চ্যাপম্যান আমাকে নানাভাবে গাইড করছে। তো সেই ম্যাচেই হল ইতিহাস রচনা। আমার গোলে ইস্টবেঙ্গল জিতেছিল, চ্যাপ ভাই-এর ক্রস থেকে আমি হেডে গোলটা করেছিলাম। দৌড়ে এসে গালটা টিপে বলেছিল, দেখলি তো তোর রেকর্ডের সঙ্গে আমার নামটাও আজ জুড়ে গেল! বলে কী সে হাসি চ্যাপ ভাইয়ের।
জীবনে ওই কথা ভোলা যায়, না ওই ঘটনা। নিজের জীবনের প্রথম বড় ম্যাচে গোল, তাও আবার চ্যাপম্যান কান্ডারি, ওই ছবি এখনও আমি আমার বাড়ির দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখেছি। সোমবার সকালে অফিস বেরনোর আগে প্রণাম করে এলাম। কষ্ট হচ্ছিল খুব, বাড়িতেই বলছিলাম, এত যে কী তাড়া ছিল ওঁর! কাউকে নিজের কষ্ট বুঝতেই দিল না।
সেই দিনগুলি মনে পড়ে যাচ্ছিল। যখন বাইরে খেলতে যেতাম দলের হয়ে, রাজ্যের হয়ে, কিংবা দেশের হয়েও। ওই দিনগুলিতে হোটেলের বাইরে আমাদের গাইড করত চ্যাপ ভাই। কতসব স্মৃতি এসে চোখটাকেই ঝাপসা করে দিচ্ছে। ভাল বাংলা বলতে পারত। আমাদের সঙ্গে সমানে রসিকতা করত। সন্তোষ ট্রফি ফাইনালে গোয়ার বিরুদ্ধে বাংলার হয়ে জিতেছিলাম পাঁচ গোলে। সেই ফাইনালে আমি, বাইচুং, চ্যাপম্যান, রামন বিজয়ন ও বাসুদেব মন্ডলের গোল ছিল।
সবই অতীত হয়ে গেল সোমবারের পর থেকে। এত বড় তারকা ছিল, কিন্তু অহংবোধ ছিল না কোনওদিনই। ভারতের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার, যে স্ন্যাচিংও করত অনায়াসে। ফুটবলার হিসেবে বেঁচে তো থাকবেই, মানুষ হিসেবেও আমার মতো যারা ওর সান্নিধ্যে এসেছিল, তাদের মনেও বিরাজ করবে চিরকাল।