
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বাংলার আইকনিক অভিনেতা তিনি। অবশ্য হিরো নয়, নিজেকে চরিত্রাভিনেতা ভাবতেই বেশি ভালোবাসতেন। আজীবন দাপিয়ে বেড়িয়েছেন বড়পর্দা থেকে মঞ্চ। দেশে বিদেশে পেয়েছেন অজস্র পুরস্কার, সম্মাননা, স্বীকৃতি। কিন্তু এই স্টোরিলাইন, অ্যাকশন, স্পটলাইটের বাইরের মানুষটা কেমন ছিলেন, তা অনেকেরই অজানা। রঙ্গমঞ্চের মেকআপ মুছে, অনুরাগীদের ভিড় ঠেলে যে মানুষ একা বাড়ি ফিরতেন, তাঁর আশ্রয় কোথায় ছিল, জানেন কি! হ্যাঁ, কথা হচ্ছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে। কথা হচ্ছে তাঁর জীবনেরই তুলনায় কম আলোচিত এক অধ্যায় নিয়ে। কম আলোচিত বটে, কিন্তু কম আলোকিত নয় সেই অধ্যায়। অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে আমরা সকলেই চিনি। তাঁর আলোকছটায় আজও উদ্ভাসিত বাঙালি। সেই বর্ণময়তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন রক্তমাংসের যে মানুষ, সেই কবি সৌমিত্র, কবিতানুরাগী সৌমিত্র কিন্তু আজীবন থেকে গেলেন আড়ালে। অবশ্য নিভৃতচারিতাকেই কবিদের ধর্ম ভাবা যায় যদি, তাহলে সেই যাপনেও তিনি সার্থক।
১৯৭৫ এ প্রকাশ পায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম কবিতা সংকলন ‘জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াব বলে’। চারফর্মা ৫৪টি কবিতার সেই সংকলনের প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। তারপর একে একে প্রকাশ পেয়েছে ‘ব্যক্তিগত নক্ষত্রমালা’, ‘শব্দেরা আমার বাগানে’, ‘হায় চিরজল’, ‘পদ্মবীজের মালা’ কিংবা সিগনেট থেকে প্রকাশিত ‘হলুদ রোদ্দুর’। একটু একটু করে বাংলা সাহিত্যের সূর্যকরোজ্জ্বল রোদ্দুরে ডানা মেলেছেন তিনি। গা ভাসিয়েছেন ছন্দে উপমায়। অভিনয়ের পাশাপাশি এই নিভৃত কবিতাচর্চা নিয়ে এক আলোচনায় কবি জয় গোস্বামীর প্রশ্নের উত্তর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন – “অভিনয়ের সময় কী হয় জানো, আমি কোনও একটা চরিত্রের অন্তরালে আত্মগোপন করি। বলা যায়, চরিত্রটিকে সামনে রেখে তার পিছনে লুকিয়ে পড়ি। বা, উবু হয়ে বসে থাকি। চরিত্রটিই তখন আমার আড়াল। এই বার সেই চরিত্রের সত্তার সঙ্গে নিজেকে অল্প অল্প করে মিশিয়ে চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তোলার কাজটা শুরু হয় আমার মধ্যে। কিন্তু কবিতা লেখার চেষ্টা যখন করি তখন ব্যাপারটা হয়ে যায় একেবারে অন্য রকম। তখন কোনও চরিত্রের মধ্যে ঢুকে আমাকে কথা বলতে হচ্ছে না আর। এই আমি, মানে আমার যা সারাংশ, তাকেই আমি সরাসরি কবিতায় বলতে পারছি।” এই ছিল তাঁর আড়ালের কবিতাযাপনের আসল কথা। শুধু বাংলায় নয়, সারা ভারতেই সম্ভবত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একমাত্র অভিনেতা, যাঁর রয়েছে একাধিক কবিতাগ্রন্থ, কবিতাসংগ্রহ এবং দে’জ থেকে প্রকাশিত ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র বইও৷
জীবনের প্রায় শেষ দিন পর্যন্ত কবিতাই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান, তাঁর আশ্রয়। আমরা অনেকেই জানিনা, গত মাসের ১৩ তারিখ মিনিস্ট্রি অফ মিউজিক থেকে প্রকাশ পেয়েছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের এক একক আবৃত্তির এলবাম। সুকুমার রায়ের বিখ্যাত ছড়ার বই ‘আবোল তাবোল’ থেকে একের পর এক কবিতা পাঠ করেছেন তিনি সেই এলবামে। রয়েছে ‘গোঁফচুরি’, ‘খিচুড়ি’, ‘কাঠবুড়ো’, ‘সৎপাত্র’এর মত জনপ্রিয় কবিতাগুলিও।
মিনিস্ট্রি অফ মিউজিকের ছত্রছায়ায় প্রাথমিক উদ্যোগটি নিয়েছিলেন শিলাদিত্য চৌধুরী। তাঁরই ভাবনাকে রূপদান করেন সৌমিত্রবাবুর কণ্ঠ। খুব অল্প দিনের ভিতরে সৌমিত্রবাবুর উচ্চারণে ‘আবোল তাবোল’এর ৫৩টি কবিতা আবৃত্তি করে রেকর্ড করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে নিজের এই শেষ কাজ দেখে যাওয়া হল না সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। শিশুদিবসের দিন যখন এই অ্যানিমেটেড সিরিজের প্রথম পর্ব প্রকাশিত হল, তখন তিনি হাসপাতালে, পাঞ্জা লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে।
সুকুমার রায়’কে ‘শিশুসাহিত্যিক’ তকমা দেওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।ক্ষণজন্মা প্রবল প্রতিভাধর এই কবির কোনও যোগ্য উত্তরসূরী আজও খুঁজে পায়নি বাংলা সাহিত্য। পাশ্চাত্য ‘এবসার্ড রাইটিং’এর মূল ভাবনাটিকে কত সহজেই না তিনি তুলে এনেছিলেন বাংলা ভাষা-সাহিত্যের বুকে, আজও ভাবলে অবাক লাগে! ১৯২৩ সালে দুমলাটের ভিতরে প্রকাশ পায় ‘আবোল তাবোল’। ৫৩ টি ছড়ার সেই বই আজও বেস্ট সেলার বাংলা ছড়া বইগুলির অন্যতম। তারই একটি অংশ মিনিস্ট্রি অফ মিউজিক ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত হয়েছে গতমাসের ১৩ তারিখ। অনলাইন সেই প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সন্দীপ রায় সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। কিন্তু উপস্থিত হতে পারেননি একজনই, তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
‘আবোল তাবোল’ যে তাঁর অন্যতম প্রিয় বই,সে কথা বহুবার বহু আলোচনায় বলেছেন সৌমিত্রবাবু। এমনকি কখনও নির্জন দ্বীপে নির্বাসিত হলে সঙ্গে যে বইগুলো নিয়ে যেতে চান, তার তালিকাতেও ‘গীতবিতান’এর পাশেই রেখেছিলেন ‘আবোল তাবোল’ কে। তাই মিনিস্ট্রি অফ মিউজিকের তরফে আবৃত্তির অনুরোধ যখন এল, তিনি এককথায় রাজি হয়ে যান। তারই ফলশ্রুতি এই অসামান্য প্রজেক্ট।
এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে ‘মিনিস্ট্রি অফ মিউজিক’ নামক ইউটিউব চ্যানেলটির কর্ণধার
শিলাদিত্য চৌধুরী বলেন, “দেশজুড়ে লকডাউন চলাকালীনই আমরা এই কাজটির প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। ‘আবোল তাবোল’এর নাম শুনেই তিনি রাজি হয়ে যান এই সিরিজে যোগ দিতে।” লকডাউনের মধ্যেই মাত্র দুদিনে রেকর্ড করা হয়েছে সমগ্র কাজটা। একরকমভাবে দেখলে এটাই সৌমিত্রবাবুর জীবনের শেষ কাজ। কবিতার প্রতি আজীবন ভালোবাসারই ছাপই রেখে গেলেন তিনি তাঁর জীবনের শেষ কাজেও।