
অতীতের নারায়ণগড়ে
রত্না ভট্টাচার্য্য
শক্তিপদ ভট্টাচার্য্য
বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এখনও বাড়ির বাইরে বেরতে মানা। বেড়াতে যাওয়ার চ্যাপ্টার আপাতত ক্লোজ। লকডাউন চলছে। বাসা-বন্দি বাঙালির প্রাণপাখি ছটফট করছে। তবুও ‘পায়ে পায়ে বাংলা’ যথারীতি প্রকাশিত হল। আপাতত ভ্রমণকাহিনি পাঠেই হোক আপামর বাঙালির মানসভ্রমণ।
খড়গপুর-বেলদা রাস্তায় পড়ে নারায়ণগড় থানা। থানার পাশের রাস্তা দিয়ে গেলে বর্তমান রাজবাড়িতে পৌঁছনো যায়। অতীতে এখানে একটি প্রাচীন দুর্গ ছিল যার নাম ছিল হান্দোলগড়। সেই সময় নারায়ণগড়ের চারদিকে চারটি দরজা ছিল। পশ্চিমদিকের দরজাটি ওড়িশা যাওয়ার পথের ওপর ছিল। তার নাম ছিল যমদুয়ার বা ব্রাহ্মণী দরজা। কারণ, রাস্তার উভয় পাশে গভীর জঙ্গল ছিল ও জঙ্গলে প্রচুর হিংস্র জীবজন্তু থাকত। সেই সময় পুরী যেতে গেলে নারায়ণগড়ের রাজার ছাড়পত্র নিয়ে তবে যাওয়া যেত। শ্রীচৈতন্যদেব এই পথ দিয়ে পুরী গিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি এখানে ধলেশ্বর শিবের জঙ্গলে হরিনাম সংকীর্তন করেছিলেন।
দ্বিতীয় দরজার নাম সিদ্ধেশ্বর দরজা। এর পাশেই সিদ্ধেশ্বর শিবের মন্দির ছিল। তৃতীয় দরজার নাম ছিল মৃন্ময় দরজা বা মেটে দুয়ার। তার প্রাচীরের ওপর দিয়ে তিনজন ঘোড়সওয়ার পাশাপাশি যেতে পারত, এমনই চওড়া ছিল সেই প্রাচীর। চতুর্থ দরজাটি ছিল কেলেঘাই নদীর ধারে কোনও একজায়গায়। এই নারায়ণগড়ের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পরাক্রমশালী রাজা গন্ধর্ব পাল, ত্রয়োদশ শতকের কোনও একসময়।
প্রাচীন হান্দোলগড় দুর্গের বর্তমানে কিছু অবশিষ্ট নেই। রাজবাড়িটি দেখে নেওয়া যায় যেখানে বর্তমান বংশধররা বাস করেন। এলাকাটি হান্দোলা রাজগড় নামে পরিচিত। এখানেই রয়েছে ব্রজনাগরের নবরত্ন মন্দির। উচ্চতা ৪৫ ফুট। এখনও অল্প কিছু টেরাকোটার কাজ দেখা যায়। বহুবার সংস্কার হয়েছে। কাছেই রাজরাজেশ্বর শিবের আটচালার মন্দির আছে। রাজবাড়ি এলাকার বাইরে মধ্যপাড়ায় লাহাদের রসবিলাসেশ্বর শিবের মন্দির আছে।
ব্রাহ্মণী দেবীর মন্দির : যোগেশচন্দ্র বসুর লেখা ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’ থেকে জানা যায়, নারায়ণগড়ের আদিপুরুষ গন্ধর্ব পাল এই দেবীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সময়কাল ছিল ত্রয়োদশ শতাব্দী। সেই সময় ব্রাহ্মণী দেবীর অসীম প্রভাব ছিল। পুরী যাওয়ার প্রাচীন পথটি এই মন্দিরের পাশ দিয়েই ছিল। প্রত্যেক পুরীযাত্রীকে দেবীর চরণে প্রণামী দেওয়ার পর ‘ব্রাহ্মণী দেবীর ছাপ’ দেওয়া মুদ্রা নিয়ে পুরীতে প্রবেশ করতে হত। চৈতন্যদেব এই পথ দিয়েই পুরী গিয়েছিলেন। তখন এই রাস্তার নামই ছিল জগন্নাথ রাস্তা। রাস্তাটি এখনও বর্তমান।
প্রাচীনকাল থেকে এখনও পর্যন্ত মন্দিরটির মাটির দেওয়াল ও টিনের চাল এবং বিরাট এক মাটির পাঁচিল দিয়ে মন্দিরটি ঘেরা রয়েছে। মন্দিরে মাঝে দেবী ব্রাহ্মণী, তাঁর ডান দিকে দেবী রুদ্রাণী ও বাম দিকে দেবী ইন্দ্রাণী রয়েছেন। প্রবাদ আছে, দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন যে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো হয়েছিল তা টানা ৬০০ বছর পর্যন্ত সমানভাবে প্রজ্বলিত ছিল। এই বংশের শেষ রাজা পৃথ্বীবল্লভের মৃত্যুর পর প্রদীপটি নাকি হঠাৎ নিভে যায়। মন্দিরে দুর্গাপূজার সময় প্রধান পূজা হয় ও মাঘী পূর্ণিমায় একটি মেলা বসে। মন্দির খোলা থাকার সময় সকাল ৬.৩০ থেকে ১২.৩০ পর্যন্ত ও সন্ধ্যা আরতির সময়।
কাছেই রানিসাগর নামে প্রায় দুশো বিঘার একটি দিঘি আছে। প্রবাদ আছে, রাজা গন্ধর্ব পালের স্ত্রী রানি মধুমঞ্জরী স্বপ্নে দেখেছিলেন দেবী ব্রাহ্মণী তৃষ্ণার্ত হয়ে তাঁর কাছে জল চাইছেন। সেই স্বপ্নের সার্থক রূপ হল এই বিরাট রানিসাগর।
কসবা নারায়ণগড় : হান্দোলগড় রাজবাড়ি থেকে ২ কিলোমিটারের মধ্যে একটি প্রাচীন মসজিদ আছে। শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র সুজা ১০৬০ হিজরি অর্থাৎ ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে এই তিন-গম্বুজ মসজিদটি তৈরি করান। এখানে মসজিদ তৈরির অন্যতম কারণ হল, মোগল ও পাঠান সৈন্যরা এই রাস্তা ধরে দক্ষিণে ওড়িশায় যাতায়াত করত। কথিত আছে, সম্রাট শাহজাহান পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে যখন সম্রাট সৈন্যের নিকট পরাজিত হন তখন তিনি এই পথ দিয়ে নারায়ণগড়ের হয়ে দাক্ষিণাত্যে পলায়ন করেছিলেন।
জগন্নাথবাড়ি : নারায়ণগড় থানার মধ্যেই পড়ে এই গ্রাম। নারায়ণগড় থেকে বেলদা যাওয়ার প্রধান রাস্তায় পোক্তাপোল থেকে তিন কিলোমিটার ভেতরে গেলে জগন্নাথবাড়ি গ্রামে দারুণ সুন্দর জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার দর্শন পাওয়া যায়। কথিত আছে, নারায়ণগড় রাজবংশের রাজা পৃথ্বীবল্লভ পাল স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুরী যাওয়ার রাস্তার পাশে এই মন্দির তৈরি করেন। মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি উনিশ শতকের প্রথম দিকে তৈরি। এই মন্দির দেখতে যাবার সময় উপরি পাওনা হবে সুন্দর গ্রাম দর্শন।
কেশিয়াড়ি
গড়বেতার সর্বমঙ্গলা দেবীর যেরূপ খ্যাতি ঠিক ততটাই খ্যাতি কেশিয়াড়ির সর্বমঙ্গলা দেবীর। কেশিয়াড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে যে রাস্তাটা সোজা চলে গেছে উত্তর দিকে, তা ধরে কিছুটা গেলেই পাওয়া যাবে মঙ্গলমোড়া গ্রাম। এখানে রয়েছে মাকড়া পাথরের তৈরি পুবমুখী সর্বমঙ্গলা মন্দির। এটি পুরাকীর্তির এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। নাটমন্দিরের চারদিক খোলা এবং বারোটি খিলানের ওপর তা নির্মিত হওয়ায় সাধারণের কাছে এটি বারোদুয়ারি নামে পরিচিত।
মূল মন্দিরের ভেতর দিক, জগমোহন ও বারোদুয়ারি খুবই সংকীর্ণ এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন। মন্দিরের প্রবেশপথে, সিঁড়ির দু’পাশে দুটি পাথরের সিংহমূর্তি রয়েছে। উঁচু ভিত্তিবেদির ওপর প্রতিষ্ঠিত মন্দির ও তৎসংলগ্ন জগমোহন ও নাটমন্দিরে ওড়িশা স্থাপত্যশৈলীর ছাপ রয়েছে। কেবল তাই নয়, বারোদুয়ারি নাটমন্দিরের সামনের দেওয়ালে ওড়িয়া ভাষায় খোদিত এক লিপি রয়েছে যার মর্মোদ্ধার করলে জানা যায়, নাটমণ্ডপটি ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। মূল মন্দিরটি উচ্চতায় প্রায় ৩০ ফুট। মন্দিরের গর্ভগৃহে এক উঁচু বেদিতে দেবী অধিষ্ঠিত। প্রায় ৩ হাত উঁচু প্রস্তরনির্মিত দ্বিভুজা মাতৃমূর্তি। দক্ষিণ পা সিংহের ওপর রাখা। দু’পাশে দুটি প্রস্তরনির্মিত সিঁদুরচর্চিত মূর্তি জয়া-বিজয়া নামে পরিচিত। বেদির ওপরে বাম দিকে ওই মূর্তিগুলির অনুরূপ ‘বিজয়া মঙ্গলা’ নামে পিতলের তৈরি আরও তিনটি মূর্তি একটি সিংহাসনের ওপর স্থাপিত। গর্ভগৃহ ছাড়া জগমোহনের মধ্যেও যে দু-তিনটি পাথরের মূর্তি রয়েছে তার মধ্যে একটি হল গণেশের মূর্তি, একটি ত্রিশূলধারী মূর্তি ও অসুরনাশিনী মূর্তি।
রাজা মানসিংহের আমলের এই মন্দির। মানসিংহের পর এই মন্দিরের স্বত্ব পায় দে প্রহরাজ নামের জমিদার বংশ। এখন মন্দির পরিচালনা করে ট্রাস্ট কমিটি। দেবীর পূজার ভোগ দিনের বেলা মাছ-ভাতে, রাতে দেওয়া হয় পান্তাভাত। মন্দির সন্ধে ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এখানকার শারদোৎসব বিখ্যাত। বিজয়া দশমীতে রাবণ দাহ উৎসবটিও উল্লেখযোগ্য।
সর্বমঙ্গলা মন্দিরের সামনেই পুব দিকে কাশীশ্বর শিব মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরটিও সর্বমঙ্গলা মন্দিরের সমসাময়িক। ৩০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট মন্দিরটি মাকড়া পাথরের পশ্চিমমুখী। কোনও প্রতিষ্ঠালিপি নেই। জগমোহনের সামনের দেওয়ালে হর-পার্বতী ও কার্তিক-গণেশের মূর্তি নিবদ্ধ আছে। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, মন্দিরটি খ্রিস্টীয় সতেরো শতকের শেষ দিকে নির্মিত। এই পথেই কিছু দূরে কেশিয়াড়ি নদীঘাট।
কেশিয়াড়ি বাজার থেকে কাছেই খেলার মাঠের পাশে রয়েছে জগন্নাথ মন্দির। রথযাত্রা হয় এবং উল্লেখযোগ্য তিনটি রথ বের হয়। কেশিয়াড়িতে যতগুলি ছোট-বড় জগন্নাথ মন্দির আছে তাদের সব ঠাকুর সেদিন এই রথগুলিতে চড়েন। রথ উপলক্ষ্যে মেলা বসে এবং প্রচুর জনসমাগম হয়।
কেশিয়াড়িতে আরও কিছু উল্লেখযোগ্য মন্দির রয়েছে যেগুলি পুরাকীর্তির এক অনুপম নিদর্শন বলে বিবেচিত হয়। যেমন, কেশিয়াড়ির তল-কেশিয়াড়ি পল্লির আর এক জগন্নাথ মন্দির। মন্দিরে উপাসিত বিগ্রহ কাঠের জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি। এছাড়াও এখানে রয়েছে কপিলেশ্বর শিবের প্রতিষ্ঠালিপিহীন পুবমুখী, মাকড়া পাথরের পঞ্চরথ মন্দির।
২ কিলোমিটার পুবে রয়েছে কুমারহাটি গ্রাম। এই গ্রামে রয়েছে প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো ৬০ ফুট উচ্চতার জগন্নাথ মন্দির। চূড়ার দিকে লম্ফমান সিংহের প্রতিকৃতি রয়েছে। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা আনন্দলাল পাঁড়ে মহাশয়।
পুরোহিতের কাছ থেকে জানা যায়, আনন্দলাল ছিলেন বস্ত্র ব্যবসায়ী। জনশ্রুতি আছে, বহু বছর আগে একদল বস্ত্র ব্যবসায়ী সুদূর মধ্যপ্রদেশ থেকে এই কেশিয়াড়িতে আসেন ব্যবসার জন্য। তখন সুবর্ণরেখা বয়ে যেত কেশিয়াড়ি গ্রামের পাশ দিয়ে। সেই সময় কেশিয়াড়িতে রাজত্ব করতেন দে প্রহরাজ বংশের রাজপরিবার। কোনও অজ্ঞাত কারণে রাজাদের সঙ্গে বাজি রেখে জুয়া খেলা হয় এবং ব্যবসায়ীরা হেরে যান। শর্ত হিসেবে ব্যবসায়ীরা রাজার সাহায্যে এখানে জগন্নাথ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যবসায়ীরা স্বদেশে ফিরে গেলে রাজপরিবার মন্দিরের দায়িত্বভার নেয় কিন্তু পুরোহিত হিসেবে থেকে যায় সেই ব্যবসায়ীদের বংশ। মন্দিরে নিত্যপূজা ও ভোগ, আরতি হয়। শান্ত, স্নিগ্ধ মেজাজের কেশিয়াড়িতে যে কোনও সময় আসা যায়। সামনেই সুবর্ণরেখা নদী, ঘুরে বেড়াতে বেশ ভাল লাগবে আশা করা যায়।
খড়গপুর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে কেশিয়াড়ি বাসে যাওয়া যায়। পথ গেছে খড়গপুর আইটি-কে বাঁ দিকে রেখে সালুয়া মিলিটারি ক্যাম্পাসের বুক চিরে কেশিয়াড়ি।
কিয়ারচাঁদ : কেশিয়াড়ি-কুলটিকিরি রাস্তার পাশেই কিয়ারচাঁদ গ্রাম। এখানে পাথরডাঙা নামক এক চত্বরে এক মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট শিখর দেউলের আকৃতিবিশিষ্ট অসংখ্য পাথরের স্তম্ভ দেখা যায়। এই চত্বরে ভাঙা আমলক, মূর্তির ভগ্নাংশ পাওয়া গেছে যা থেকে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখানে আগে কোনও বড় মন্দির ছিল। আর মন্দির আকৃতির এইসব স্তম্ভগুলি দেবতার উদ্দেশে নিবেদিত হয়ে ছিল। প্রত্নতত্ত্বে উৎসাহীদের বেশি ভাল লাগবে।
এখান থেকে একটু রনবনিয়া গ্রামে রয়েছে মিশনারিজ অফ চ্যারিটির চার্চ ও শান্তি শিশুভবন। চারিদিকে ফুলের গাছ, নীচে পাথর বিছানো, স্তম্ভের ওপর কাচের মধ্যে মাদারের সুন্দর মূর্তি। গায়ে লেখা-– ‘তোমরা শ্রান্ত যারা বোঝার ভারে ক্লান্ত যারা, তোমরা সকলেই আমার কাছে এসো, আমি তোমাদের আরাম দেব।’ এই প্রত্যন্ত গ্রামের এক কোণে এরকম সুন্দর চার্চ মনের প্রশান্তি এনে দিতে বাধ্য।
খড়গপুরে রাত্রিবাস করে জায়গাগুলি দেখে নেওয়া সুবিধার হবে। রাত্রিবাসের ঠিকানা : আনারকলি লজ, গোলবাজার, খড়গপুর, চলভাষ : ৯৫৬৪১৩৮৮০৭।
কাছেপিঠে আরও নানা জায়গায় বেরিয়ে পড়তে ক্লিক করুন নীচের লাইনে।