
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
চলে গেলেন ছোট পর্দার বড় পরিচালক দেবীদাস ভট্টাচার্য। মাত্র ষাট বছর বয়সে সেই কোভিডই কাড়ল প্রাণ অভিনেতা ও পরিচালক দেবীর। চিরচেনা সিরিয়ালের থেকে অন্য পথে হাঁটতেন তিনি। তাই তাঁর কাজে থাকত অভিনবত্ব। যদিও বসিরহাটের ছেলে সুদর্শন দেবীদাস এককালে অভিনয়ও করেছেন। সহযোগী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন ফিল্মেও।
নতুনদের কাছেও দেবীদা ছিলেন একজন শিক্ষক। দেবীদাসের হাত ধরেই মনামি ঘোষ, অনিন্দ্য চক্রবর্তীর মতো কত শিল্পী সৃষ্টি হয়েছেন। দেবীদাসের শোকে কাতর ভাস্বর চ্যাটার্জী, মৈত্রেয়ী মিত্র, চৈতী ঘোষাল, পরিচালক বিষ্ণু পালচৌধুরী সহ ইন্ডাস্ট্রির সবাই।
সুদীপ্তা চক্রবর্তীর মতে ‘ভদ্র, মার্জিত, শিক্ষিত, সুন্দর, সুপুরুষ, ভালো মানুষ, সু-অভিনেতা, সু-পরিচালক…. এই এতগুলো বিশেষণ একটা মানুষের নামের পাশে দেওয়া যায়, এমন মানুষ এখন প্রায় বিরল। তাই খানিক অবহেলিত আর কোণঠাসা ও। সেটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠছে ক্রমশঃ। এবার আরও বিরল হয়ে গেল।
দেবীদাস ভট্টাচার্যও চলে গেলেন।
মিছিল থামছেই না।’
শেষ যে অভিনেত্রীর সঙ্গে কথা বলে দেবীদাস ইন্ডাস্ট্রি ছেড়েছিলেন তিনি লিলি চক্রবর্তী।
প্রখ্যাত লেজেন্ডারি অভিনেত্রী লিলি চক্রবর্তীর সঙ্গেই দেবীদাস তাঁর শেষ সিরিয়াল ‘বৃদ্ধাশ্রম ২’তে কাজ করছিলেন। আজ লিলি চক্রবর্তী শোকাহত। তবু তাঁর প্রিয় পরিচালক দেবীর জন্য দরকারি কথা বললেন বর্ষীয়ান অভিনেত্রী।
‘আমার ঠিকানা তাই… বৃদ্ধাশ্রম’ , নচিকেতার বিখ্যাত গানকেই অবলম্বন করে দেবীদাস ভট্টাচার্য তৈরী করেন ছ’মাসের গল্প ‘বৃদ্ধাশ্রম’। মেগার হাঁসফাঁস টেনেটেনে বাড়ানো গল্পর থেকে ভিন্নপথে হেঁটে সাফল্যও পান দেবীদাস। অভিনয় করেন লিলি চক্রবর্তী, মনোজ মিত্র, ছন্দা চ্যাটার্জীর মতো শিল্পীরা। ‘বৃদ্ধাশ্রম’ সাফল্যের সঙ্গে শেষ হতে দেবীদাস বানান ‘বৃদ্ধাশ্রম ২’। দুটোতেই মুখ্যভূমিকায় লিলি চক্রবর্তী, তিনিই এই ধারাবাহিকের পাওয়ার হাউস।
বহু স্মৃতি এই সিরিয়াল ঘিরে লিলির। আজ যেন এক দমকায় সবটা ফাঁকা করে দিয়ে চলে গেলেন দেবীদাস।
লিলি চক্রবর্তী বললেন ”যেদিন শেষ দেবী স্টুডিও থেকে গেল সেদিন শেষ কথা আমার সঙ্গেই বলে গেল ‘দিদি আমি একটু বেরচ্ছি, আমার সহকারীরা রয়েছে ওরা দেখবে। আমি মনোজদার (মনোজ মিত্র) সঙ্গে একটু দেখা করে আসি। বয়স হয়েছে তো, অনেকবার ডাকাডাকি করছেন।’
যাবার সময় গাড়ি করে গেছিল কিন্তু ফেরার সময় একটা অটোতে উঠেছিল।
তারপর দেবী শ্যুটিং-এ আসছে না দেখে আমি ফোন করেছিলাম। তখন ও বলল ‘অটোতে ফেরার সময় ঠান্ডা লেগে গেছে। তাই প্রচন্ড মাথা ধরে আছে।’ তখনই আমি বলেছি ওঁকে ‘সময়টা ভালো না, টেস্ট করা। এইসময় জ্বর, মাথাব্যথা ভালো না।’ তখন বলল ‘জ্বর হচ্ছেনা, শুধু মাথা ধরে আছে।’ আমি বললাম ‘তবু কোভিড টেস্ট করা।’ সেটা ও করায়নি। কোনও টেস্ট আগে থেকে করেনি। আমার তো রোজই ‘বৃদ্ধাশ্রম ২’র শ্যুটিং থাকছে। খোঁজ নিচ্ছি। ওঁর কাছাকাছি তো যেতে পারছি না। প্রথমে ভর্তি করল ডিসানে, তারপর আমরি, তারপর পাঠিয়ে দিল কোভিডের উলুবেড়িয়া সঞ্জীবনীতে। ওর স্ত্রীও এখানে ছিলেন না। ব্যাঙ্গালুরুতে মেয়ের কাছে গেছিলেন। দেবী হাসপাতালে ভর্তি হবার পর ওর বউ ফিরেছেন। ওর বউ বলেছেন প্যারাসিটামল খাও ইত্যাদি তাতে কমেনি। আরেকটু সতর্ক হতে পারত। ইউনিট থেকে যতদূর জানি ওঁর সংক্রমণ হয়নি। ঠান্ডা লেগে আরও বাড়াবাড়ি হল। তারপর ও বাড়িতেই থাকত। প্রথমে অতটা কেয়ার করেনি। অন্তত ডাক্তার দেখালে এতটা বাড়াবাড়ি হতনা। প্রথম স্টেজেই তো অনেকের করোনা আজকাল সেরে যাচ্ছে। প্রথম স্টেজে ও যায়নি তো। একদিন তো বাথরুমে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিল। বাড়িতে কেউ নেই। স্ত্রী অনন্যাও বহুদিন পর ব্যাঙ্গালোরে মেয়ের কাছে থাকায় কাজের লোকটাও সেদিন কামাই করে দিয়েছে। তারপর দু’ঘণ্টা বাদে যখন জ্ঞান ফিরেছে তখন ও বলছে ‘আমি এখানে কীকরে এলাম।’ তারপরও সবাই শুনে বলেছে, এবার অন্তত ডাক্তার দেখাও। তখনও বলছে ‘কোনও কারণে মাথা ঘুরে পড়ে গেছি হয়তো।’ খালি পিছিয়ে যাচ্ছিল ও এভাবে। শেষে যখন খুব বাড়াবাড়ি হল, তখন ইন্ডাস্ট্রির লোকেরাই ওকে জোর করে হাসপাতালে ভর্তি করে দিল।
বৃদ্ধাশ্রম প্রথম সিজনেও আমি ছিলাম। সেটাও দেবীর সঙ্গে কাজ। খুব নিয়েছিল মানুষ সিরিয়ালটা। বৃদ্ধাশ্রম হিট করার পরই ‘বৃদ্ধাশ্রম ২’ করল আবার। সেটাও নিল দর্শক। আকাশ আটে চিরকালই অন্যরকম গল্প বলা হয় যেটা অন্য বাংলা চ্যানেলে আজকাল আর দেখিনা এবং এই নতুনধারার কাজে দেবী ছিল অন্যতম। ভালো কাজ করার কারিগর চলে গেল। কিছুদিন আগে দেবী খালি বলছিল ‘ ‘বৃদ্ধাশ্রম ৩’ ও করব। ‘
ও খুব শান্ত আর ভীষণ চুপচাপ থাকত। জুনিয়রদেরও জোরে কথা বলত না। আমার তো আজকেও শ্যুটিং ছিল, সকালে যে ছেলেটি আমার প্রোগাম করে সে যখন আমাকে ফোন করে হাউমাউ করে কেঁদে বলছে ‘দিদি আজকে শ্যুটিং হচ্ছেনা’, তখনই আমি বুঝে গেছি। কারণ খুব খারাপ অবস্থা যাচ্ছিল দেবীদাসের। ফুসফুস, ব্রেন, কিডনি সবটাই আক্রান্ত হয়ে গেছিল। আমরা তো রাতদিন ঠাকুরকে ডাকছিলাম ভালো হয়ে যাক ছেলেটা। এত ভদ্র, সুদর্শন, ভালো ব্যবহার, প্রত্যেকে ওঁকে ভালোবাসে। নয়তো একজন প্রোগ্রামার হাউমাউ করে কেঁদে বলে ওঁর কথা! আমি বাড়িতে বসে থাকলেও খুব মন খারাপ হয়ে আছে।
দেবী জোর করে আমাকে ‘বৃদ্ধাশ্রম ২’ সিরিয়ালটা করালো। ‘দিদি টেকনিশিয়ানরা সবাই বসে আছে লকডাউনে, তুমি যদি কাজ না কর, এরাও কাজ পাবেনা। আমি তোমার জন্য আলাদা মেকআপ রুম, ভালো করে বাড়ি থেকে নেওয়া ফেরার ব্যবস্থা করে দেব।’সত্যি দেবী কথা রেখেছিল সব ব্যবস্থা করেই কাজ করত। এখনও পর্যন্ত ওদের ওখানে আমি ঐভাবেই কাজ করছি।
আর নিতে পারছি না। এত ভালো মানুষরা এত তাড়াতাড়ি চলে যায়। আজ সকালে আমি যখন ফেসবুক খুলছি শুধু দেখছি দেবীর ছবি, সবাই দেবীকে নিয়ে বলছে। তার আগেই যদিও খবর পেয়ে গেছি। এত খারাপ লাগছে। এরকম মানুষ আর পাওয়া যাবেনা। দেবীদাস কাজের প্রতি যতটা যত্নবান ছিল, নিজের শরীরের প্রতি ততটাই সচেতন ছিলনা। তাই আরো হল এই অকাল পরিণতি।
এই কুড়িকুড়ি বছরটা অসহ্য একেবারে আর ভালো লাগছেনা। আমি লকডাউনে কাজ করছিলাম না শুরুতে। দেবীর অনুরোধেই এই বয়সেও কাজে নামলাম। কাজ করছিও। আমার শরীর ঠিক আছে। কিন্তু মনটা ভীষণ খারাপ।’