
ঈশ্বর রাওয়ের সঙ্গে কাজ শেষ করে পৃথ্বীশ যখন নিজের ঘরে এল তখন প্রায় রাত্রি একটা বাজে, আসার আগে দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে রাওকে আগামীকাল ছুটির কথা বলতেই মৃদু হেসে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এনিথিং সিরিয়াস রয়?’
–নো স্যর নাথিং সিরিয়াস বাট সি ইজ এক্সপেক্টিং মি! নেক্সট ফিউ মান্থস
কথা শেষ করতে না দিয়েই পৃথ্বীশের চোখে চোখ রেখে শান্ত স্বরে পুনরায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘সি মিনস মিস ভট্টাচারিয়া, রাইট?’
কোনও কথা না বলে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল পৃথ্বীশ।
–এখান থেকে কতো দূর?
–বেশি দূর নয়, ম্যাক্সিমাম সিক্স টু সেভেন আওয়ার্স ড্রাইভ।
কয়েক মুহূর্ত পর কী যেন চিন্তা করে রাও বলেছিলেন, ‘সে এখানে আসতে পারবে না?’
–স্যর আসলে সবকিছু ফেলে হঠাৎ ওর পক্ষে এতটা পথ আসা, এনিওয়ে, প্লিজ লিভ দ্য টপিক, সামহাও আই উইল ম্যানেজ।
–এন্ড হোয়াট ইজ দ্য নেম ওফ দ্যাট প্লেস ?
প্রায় অপরিচিত মানুষটির কৌতূহল দেখে সামান্য অবাক হয়েই পৃথ্বীশ উত্তর দিয়েছিল, ‘এরুল, এড়োয়ালি।’
–ওকে, ডু ওয়ান থিঙ্গ, ডে আফটার টুমরো লেটস গো!
–মানে, ইউ ওলসো ওয়ান্ট টু গো?
পৃথ্বীশের বিস্মিত মুখচ্ছবি দেখে সামান্য হেসে রাও জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘ইফ আই গো উইথ ইউ খুব অসোবিধা হবে কি তোমাদের? আকচুয়ালি আই হ্যাভ নেভার সিন রুরাল বেঙ্গল!’
ইতস্তত কণ্ঠে পৃথ্বীশ বলেছিল, ‘না না স্যর, ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম, কিন্তু জায়গাটা ভেরি রিমোট, আপনার থাকার অসুবিধার কথা ভেবেই বলেছিলাম, প্লিজ ডোন্ট মিসআন্ডারস্ট্যান্ড মি!’
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পৃথ্বীশের কাঁধে আলতো হাত রেখেছিলেন রাও, মুখে ফুটে উঠেছিল হাসির রেখা, ‘রয়, আই ক্যান স্টে এনিহোয়ার ইন দিজ ওয়ার্ল্ড, মাই লাইফ টট মি দ্যাট, সো প্লিজ ডোন্ট থিঙ্ক আবাউট মাই কমফোর্ট!’
ঘরে এসে বিছানার একপাশে ক্লান্ত শরীরটি রাখতেই বিপ বিপ শব্দে বেজে উঠল মোবাইল, কোথায় যে রাখল ফোনটা! ছোট একচিলতে খাটখানি যেন অভয়ারণ্য, ল্যাপটপ, কাগজ, বইপত্র, দু-চারটি জিন্স প্যান্ট, জামা মোজা রুমাল- জিনিসের আর শেষ নেই। বালিশের নিচে শেষে খুঁজে পেল ফোন, মেসেজ এসেছে। দ্রুত হাতে খুলে দ্যাখে বন্যা লিখেছে, বাঁশি যে এখনও বাজল না!
উত্তর দেওয়ার আগে ঋষাকে লিখল, কাল আসতে পারছি না, পরশু আসব, কাল সকালে ফোন করব। পাঠানোর আগে কী মনে হওয়ায় ফের মেসেজ খুলে আরও একটি বাক্য যোগ করল, চিন্তা করিস না, ঠিক আছি।
বন্যাকে লিখল দুটি মাত্র শব্দ, ফোন করব?
কয়েক মুহূর্ত পরেই ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল বন্যার মুখ। কেশরাজি চালচিত্রের মতো সাজিয়ে রেখেছে মুখখানি। অপেক্ষা না করে নিজেই কল করেছে, রিসিভ করতেই ওদিক থেকে ভেসে এল কণ্ঠস্বর, বলো! সব ঠিক আছে তো?
–সব ঠিকই আছে, এমনি ফোন করলাম!
–মিটিং শেষ হল তোমার?
–হ্যাঁ, এই জাস্ট ফিরলাম ঘরে। মি. ঈশ্বর রাও, লোকটি দারুণ ইন্টারেস্টিং জানো!
–তাই? কীরকম একটু শুনি!
বন্যার ছেলেমানুষি উৎসাহ দেখে মৃদু হেসে পৃথ্বীশ বলে, ‘সে অনেক কথা, কাল দেখা হলে বলব।’
ওপার থেকে ভেসে আসে বিস্মিত কণ্ঠস্বর, ‘কাল? কাল তুমি ঋষার কাছে যাবে না?’
–নাহ, কাল ছুটি পাইনি, পরশু যাব।
চাপা হাসির শব্দে বেজে ওঠে বন্যা, ‘ও সেইজন্য মনখারাপ! বুঝেছি এবার!’
‘বন্যা প্লিজ, এখন আর ইয়ার্কি ভালো লাগছে না’, তারপর একমুহূর্ত চুপ করে থেকে নিজের মনেই পুনরায় বলল, ‘তোমার মেসেজ দেখেই ফোন করলাম।’
হঠাৎ দুপ্রান্তেই নেমে আসে নির্জনতা, দু-এক মুহূর্ত পর কুয়াশার মতো নীরবতার তন্তুজাল ছিন্ন করে শোনা যায় বন্যার ধীর কণ্ঠস্বর, ‘সত্যিই তো বাঁশি বাজল না আজ।’
–শুনবে?
–শুনব বলেই তো ও-কথা লিখলাম!
–আচ্ছা একটু ধরো, আমি বাঁশিটা নিয়ে আসি।
খাট থেকে নেমে সামনে ছোট দেরাজের ভেতর থেকে লম্বা একহারা আড়বাঁশি বের করে আনল পৃথ্বীশ, এলোমেলো ঘরে অন্য কোনও কিছু খুঁজে না পেলেও এই বাঁশিটি কখনও হারায় না সে। তিনবছর আগে কাঁকড়াঝোড়ের জঙ্গলে যাওয়ার পথে বেলপাহাড়ির শবরদের এক সান্ধ্যহাট থেকে এই মধুর সুরযন্ত্রটি তাকে বন্যা কিনে দিয়েছিল। বিচিত্র দর্শন এই বাঁশি আর পাঁচটা সাধারণ বাঁশির মতো দেখতে নয়। ঘন বাদামী শরীরে চারটি মাত্র ছিদ্র, ওষ্ঠপ্রান্তে আরও একটি ছিদ্র, আশ্চর্য বিষয় হল এই একটিমাত্র বাঁশি নিয়েই সেদিন হাটের বাইরে মহুয়াগাছ তলায় ধুলার উপর বসেছিলেন বিক্রেতা, বন্যা কিনতে চাইলে প্রায়ান্ধকার শীতসন্ধ্যায় মৃদু হেসে সেই প্রৌঢ় শবর বলেছিলেন, ‘ফুঁ দিঁতা ন জানু ইটো বাজতে পারবি নাই, কেঁচর কেঁচর হবি!’
বাঁশিটি হাতে নিয়ে ঘরের জানলাটি খুলে দিল পৃথ্বীশ। গাঢ় অথচ নরম কেশরাজির মতো কার্তিকের কুয়াশায় আচ্ছন্ন চরাচর, জানলার ঠিক পাশে শরীর বিছিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বকুল গাছটির পাতায় সরসর শব্দ তুলে কে যেন নিচের দিকে নেমে গেল, রাতের দিকে জানলা খুললে প্রায় এই শব্দটি শোনা যায়, কে জানে কী, গাছের আঁধারমাখা পাতা জানলার গরাদ স্পর্শ করে রয়েছে, সেদিকে একবার তাকিয়ে ফোনের লাউডস্পিকার চালু করে পৃথ্বীশ আলতো স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘শুরু করব?’
–কতদিন রাত্রে তোমার বাঁশি শুনিনি!
জানলার বাইরে অন্ধকার আকাশে অস্পষ্ট প্রদীপের মতো জেগে রয়েছে কয়েকটি ম্লান নক্ষত্র, থিরথির উত্তরপথগামী বাতাসে ভেসে আসছে কোন সুদূর জগতের কথা যেন গন্ধর্বলোকের একদল কুসুমবিলাসিনী পরস্পরের হাত ধরে ভুবনডাঙায় নেমে এসেছে, তাদের মনোবীণায় ঢেউ তুলেই হয়তো বেজে উঠল পৃথ্বীশের বাঁশি। রাত্রির সুর নয় কিন্তু দুজনেরই বড়ো প্রিয় এই গান- আমরা মলয় বাতাসে ভেসে যাব, শুধু কুসুমের মধু করিব পান। বাঁশিসুরের টলোমলো সাগরে ডিঙি নৌকোর মতো মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে বন্যার মৃদু কণ্ঠ- ‘সন্ধ্যার মেঘে করিব দুকূল, ইন্দ্রধনুরে চন্দ্রহার, তারায় করিব কর্ণের দুল, জড়াবো গায়েতে অন্ধকার।’
বাঁশি নিভে যাওয়ার পর বেশ কিছু সময় দুজনেই চুপ করে রইল, রাত্রির তৃতীয় প্রহর প্রায় শেষ হয়ে আসছে, এসময় জগৎ নিদ্রামগ্ন হয়ে পড়ে, ঘুমন্ত শিশুর কপালে মা যেমন করে নিবিড় স্নেহহাতটি রাখেন তেমনই রাত্রিদেবীর আঁচল বিছানো রয়েছে এই ধুলাখেলার ভুবনে, জানলা দিয়ে সেদিকপানে চেয়ে পৃথ্বীশ জিজ্ঞাসা করল, ‘ভালো লাগল?’
কথাটির কোনও উত্তর না দিয়ে দু-এক মুহূর্ত পর বন্যা আপনমনেই যেন বলে উঠল, ‘জানো আজ অদ্ভুত একটা ঘটনা, সন্ধ্যায় তোমার সঙ্গে দেখা করে ফেরার পর একটানা কতগুলো ছবি চোখের সামনে দেখে যাচ্ছি!
একটু অবাক হয়েই পৃথ্বীশ জিজ্ঞাসা করল, ‘ছবি দেখছ মানে মুভি?’
–না না মুভি নয় কিন্তু মুভির মতো কতগুলো দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে যাচ্ছে, এমনকি বললে বিশ্বাস করবে না কথা অবধি শুনতে পাচ্ছি আর এত ইন্টারেস্টিং যে অন্য কোনও কাজও করতে পারছি না!
দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে পৃথ্বীশ বলে ওঠে, ‘বন্যা আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না! দেখছ মানে কোথায় দেখছ? ল্যাপটপে?’
–উফ! আরে না রে বাবা, দেখছি, মানে চোখের সামনে দেখছি যেমন করে কাউকে সামনে দেখি ঠিক সেরকম।
–কাইন্ড অব হ্যালুসিনেশন?
পৃথ্বীশের প্রশ্ন শুনে বন্যার অধৈর্য কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘হ্যালুসিনেশন কেন হতে যাবে! বললাম তো স্পষ্ট দেখছি, তুমি একটুও বোঝার চেষ্টা করছ না আমাকে।’
–আচ্ছা একটা কথা বলো, আগে কখনও এরকম হয়েছে? মানে আগে দেখেছ এই জিনিস?
–না, কোনওদিন দেখিনি। কখনও দেখিনি।
দু-এক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর পৃথ্বীশ জিজ্ঞাসা করে, ‘কী দেখছ? মানুষজন ঘরবাড়ি এইসব?’
–ঘরবাড়ি নয়, জঙ্গল। গাছপালায় ভরা ঘন জংলা পাহাড়ি পথ, পাকদণ্ডী বেয়ে উঠে চলেছে দুইজন হিন্দু সন্ন্যাসী
কথার মাঝেই পৃথ্বীশ প্রশ্ন করে, ‘হিন্দু সন্ন্যাসী বুঝলে কী করে?’
–আহ পৃথ্বী, প্লিজ লেট মি ফিনিশ ফার্স্ট।
লজ্জা পেয়ে পৃথ্বীশ বলে, ‘সরি সরি, বলো তুমি।’
–হ্যাঁ, তো দুজন সন্ন্যাসী, একজনের পরনে কৌপীন, সারা দেহ ছাইমাখা আরেকজন গেরুয়া কাপড় পরেছে, দুজনের হাতেই কমণ্ডলু, কী যেন একটা সংস্কৃত মন্ত্র বলছে, ভালো বুঝতে পারলাম না, শুধু একটা লাইন মনে আছে, রেবা মাঈকী জয় হো।
সাগ্রহে পৃথ্বীশ জিজ্ঞাসা করল, ‘তারপর?’
–তারপর দেখি দুজনে একটা মন্দিরে গেছে, ওইরকম জঙ্গলের মধ্যে পাথরের ভাঙা মন্দির, ওই কৌপীন যে পরে আছে সে বলল, জানকী মাঈয়ার মন্দির। কেউ কোথাও নাই, শুকনো পাতায় ভরে আছে মন্দিরের চাতাল আর কত ফল, তেমন ফল কখনও দেখিনি, আপেলের মতো কোনওটা পেয়ারার মতো, টুকটুকে লাল হলুদ সাদা ফল, ওরা দুজনে দেবীকে উপুড় হয়ে শুয়ে প্রণাম করল, দেবীর মুখ দেখে বুঝলাম সীতা, কী মিষ্টি মুখখানি, কী মায়া যেন এখনই আমার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠবেন।
কথা বলতে বলতে থেমে লম্বা শ্বাস নিল বন্যা, কয়েক মুহূর্ত পর আকুল গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘পৃথ্বী কেন এমন দেখছি আমি? কী এর অর্থ?’
–একটা কথা বলো আমায়, দেবীমূর্তি যে সীতা তা তুমি কী করে বুঝলে?
–বা রে, তোমাকে বলেছিলাম ছেলেবেলায় দিদিমার কাছে রামায়ণ পড়েছি, বইয়ে যেমন দেখেছি অবিকল তেমনই মুখ, শুধু এখানে পাশে রাম নেই।
বন্যার কথায় পৃথ্বীশের হঠাৎ মনে পড়ল বন্যার মা হিন্দু, বাড়িতে নিশ্চয় রামায়ণ পড়ার চল ছিল, পরক্ষণেই নিজ মনের আচরণে লজ্জিত হল, মুসলমান হলে রামায়ণ পড়বে না এই কুযুক্তি কেমন অবচেতন মন নিজেই তৈরি করে রেখেছে! ধীর স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘আর কী দেখলে?’
–দেখলাম মন্দিরের চাতালেই ওরা খেতে বসেছে, শুকনো শালপাতায় রুটি, একটা আমলকী আর মাটির সরা ভরা দুধ, কী আশ্চর্য জানো ভুরভুর করছে ঘিয়ের গন্ধ, আমি সেই গন্ধও পেলাম।
আপনমনেই পৃথ্বীশের মুখ থেকে বেরিয়ে এল একটি শব্দ, ‘আশ্চর্য!’
–হ্যাঁ পৃথ্বী আশ্চর্য তো বটেই, আচ্ছা তুমি বুঝতে পারছ জায়গাটা কোথায়?
–আন্দাজ করতে পারছি। একটা কাজ করো, ভোর হতেই চলল, আমি এবার জগিং-এ বেরোব, তুমি আসবে? তাহলে মুখোমুখি কথা বলতাম, ফোনে এত কথা বলা যায় না।
দু-এক মুহূর্ত কী যেন চিন্তা করে বন্যা বলল, ‘সেটাই ভালো, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। ওই পাঞ্জাবী ধাবার দিকে যাই?’
–হ্যাঁ, তাই চলো।
একটা ঘন নীল রঙা ট্র্যাকস্যুট আর সাদা স্নিকার পায়ে কোলাহলমুখর ধাবার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বন্যা, একঢাল চুল টান করে বাঁধা, প্রসাধনহীন মুখে কুয়াশাবৃত কার্তিকের নূতন ধানশিষের দুধ যেন লেগে রয়েছে, নিদ্রাহীন রাত্রি কাটানোর ফলে চোখদুটি ঈষৎ লাল, একপলক দেখলে মনে হয় এই জগতের মালিন্য কখনও তাকে স্পর্শ অবধি করেনি। আধফোটা কুসুমের মতো প্রভাতী আলোয় জেগে উঠেছে চরাচর, যদিও আলো এখনও অস্পষ্ট কিন্তু তার হিমমাখা আভায় নতুন দিনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। পেছন থেকে হঠাৎ শোনা গেল পৃথ্বীশের কণ্ঠস্বর, অনেকটা ছুটে আসার কারণে সামান্য হাঁপানির টান লেগেছে গলায়, ‘বাব্বা! তোমাকে তো লন টেনিস প্লেয়ারের মতো দেখাচ্ছে!’
মুখ ফিরিয়ে পৃথ্বীশের দিকে তাকিয়ে কুন্দকুসুম রেণুর মতো হাসল বন্যা, ‘কার মতো? সাবাতিনি?’
–উঁহু, সাবাতিনির তো এত লম্বা চুল ছিল না!
–তাহলে?
সামান্য হেসে পৃথ্বীশ জবাব দিল, ‘তোমাকে ঠিক বন্যা রহমানের মতোই দেখাচ্ছে!’
–থাক! সকাল সকাল আর ঢং করতে হবে না! চলো এগোই!
সামনে পিচঢালা রাস্তা ধরে অল্প কিছুটা দৌড়েই লম্বা শ্বাস নিতে নিতে বন্যা বলে উঠল, ‘ওহ পৃথ্বীশ একটু আস্তে, আমি কি তোমার মতো দৌড়তে পারি!’
–এইটুকুতেই এমন অবস্থা? ননীর পুতুল একেবারে!
–পায়ে টান ধরেছে, দাঁড়াতে পারছি না, বাজে লেকচার না দিয়ে হাতটা এসে ধরো!
পেছন ফিরে বন্যার কাছে এসে পৃথ্বীশ হাঁটুমুড়ে বসে পায়ের কাফ মাসলে হাত দিতেই হাঁ হাঁ করে উঠল বন্যা, ‘ও কী করছ, পায়ে হাত দিও না প্লিজ!’
–চুপ করো, মাসল স্টিফ হয়ে গেছে, একটু ম্যাসাজ করলেই ঠিক হয়ে যাবে!
কুণ্ঠিত বা হয়তো খানিকটা লজ্জা পেয়েই মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল বন্যা, কার্তিকের দুধ কুয়াশা আর অস্ফুট আলোক দিঘির মাঝে একজন কুসুম নারীর সামনে নতজানু হয়ে ধুলার উপর বসে রয়েছে এক পুরুষ-এই দৃশ্যের উপর কালের প্রসন্না দেবীর হাসি পুষ্পবৃষ্টির মতো যেন ঝরে পড়ল, তিনি মনে মনে ভাবলেন, এই মায়াজাল ছিন্ন করিবার সামর্থ্য কাহারও নাই! এমন ধুলাখেলার জগত লইয়া শিশুর ন্যায় তোমাদিগকে খেলিতে দেখিলে বড়ো আনন্দ হয়!
অল্পক্ষণ পর পৃথ্বীশ মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী কমেছে?’
কোমল আলোর মতো হাসি মুখে টেনে মৃদু স্বরে বন্যা বলল, ‘কমেছে। ওঠো তুমি, আর করতে হবে না!’
–দাঁড়াও আর দু-এক মিনিট করে দিই তাহলে স্টিফনেসও কেটে যাবে।
–না, ওঠো তুমি, ক্যাম্পাসের হাজারটা ছেলেমেয়ে এখান দিয়ে যায়, তোমাকে এই অবস্থায় দেখলে হাসাহাসি করবে, ওঠো তুমি।
অবজ্ঞার সুরে ঠোঁট উল্টে পৃথ্বীশ বলল, ‘দেখলে আমার ভারি বয়ে গেল! লোকের কথায় অত পাত্তা দাও কেন!’
শিরশিরে বাতাসে বন্যার মুখে একটি শুকনো পাতা কোথা থেকে যেন উড়ে এল, পাতাটি হাতে নিয়ে চিনতেও পারল, জারুল পাতা, বামমুঠির মধ্যে সেটি রেখে সুদূর থেকে ভেসে আসা আনমনা গলায় বলে উঠল, ‘মেয়েদের অনেক কথা শুনতে হয় পৃথ্বী, ও তুমি বুঝতে পারবে না।’
বড়ো রাস্তায় কালভার্টের ধারে সিমেন্ট বাঁধানো বেদির উপর বসেছে দুজন, পাশেই একখানি প্রকাণ্ড বকুল গাছ ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, দিনের প্রথম আলো পাতায় ঝিলিমিলি তুলে ঝর্ণার মতো নেমে এসেছে ওদের কাছে, সারা মুখে সেই আলোর প্রসাধন নিয়ে বন্যা জিজ্ঞাসা করল, ‘জায়গাটা আন্দাজ করতে পেরেছ বললে, কোথায় হতে পারে?’
একবার মুখ তুলে গাছটির দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে পৃথ্বীশ বলল, ‘নর্মদা উপত্যকা। ওই যে বলছেন সন্ন্যাসী, রেবা মাঈয়ের কথা, নিশ্চয়ই নর্মদা উপত্যকা।’
–নর্মদা? কী বলছ তুমি? তোমার এই প্রজেক্টে ওখানে যাওয়ার কথা আর আমি এই ছবি দেখছি, আশ্চর্য! কী মানে এর পৃথ্বী?
–সেটাই তো বুঝতে পারছি না, আচ্ছা আর কিছু দেখেছ?
দু-এক মুহূর্ত মন স্থির করে চিন্তা করল বন্যা, তারপর ধীর স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ, ওই গেরুয়া পরা সন্ন্যাসী তোমাদের একজন দেবতার কথা জিজ্ঞাসা করছিল, খুব উত্তেজিত গলার স্বর, ভালো বুঝতে পারলাম না কথাগুলো আর ঠিক তখনই তুমি মেসেজ করলে, দৃশ্যও ওমনি মুছে গেল!’
–দেবতার কী নাম বলেছিল সেটা মনে আছে?
–আছে, কালভৈরব।
‘কী?’, প্রচণ্ড বিস্মিত হয়ে পৃথ্বীশ উঠে দাঁড়িয়ে বন্যার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার ঠিক মনে আছে? সাধু কালভৈরবের কথাই বলেছিল?’
পৃথ্বীশের এমন অদ্ভুত আচরণে অবাক হয়ে বন্যাও উঠে দাঁড়িয়ে থতমত গলায় বলল, ‘হ্যাঁ কালভৈরবের কথাই বলেছিল, স্পষ্ট মনে আছে আমার। কিন্তু তাতে কী হল? কে এই কালভৈরব? খুব পাওয়ারফুল কেউ?’
–জানি না তবে আশ্চর্য বিষয় হল গতকাল রাও স্যর কথাপ্রসঙ্গে বলছিলেন কালভৈরব ওঁর আরাধ্য দেবতা!
এবার বন্যাও অবাক হয়ে বলল, ‘কী বলছ তুমি পৃথ্বী? তারমানে নিশ্চয় এর মধ্যে কোনও কানেকশন রয়েছে!’
–হয়তো আছে তবে
–তবে কী?
–শুনেছি কালভৈরব শিবের একটি রূপ এবং তিনি কাল বা সময়ের নিয়ন্ত্রক।
পৃথ্বীশের কথা শুনে দু-এক মুহূর্ত কী যেন চিন্তা করল বন্যা তারপর সামান্য উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, ‘আচ্ছা আমার এই দৃশ্যের কথা রাও স্যরকে একবার জিজ্ঞাসা করলে হয় না?’
–তা হয় কিন্তু সেটা কি ভালো দেখাবে? সামান্য কয়েকঘণ্টার মাত্র আলাপ তারপর প্রফেশনাল রিলেশন, ওঁকে এইসব পার্সোনাল কথা বলা মনে হয় উচিত হবে না।
–সেটা অবশ্য একটা পয়েন্ট, বাট পৃথ্বী আই মাস্ট ডিকোড দিস ভিশন। আই মাস্ট।
বর্ধমান পার হয়ে অনেকটা পথ সামনে ডাকবাংলো হাটের আগে ময়ূরাক্ষীর ব্রিজের উপর গাড়ি উঠতেই পৃথ্বীশের দিকে তাকিয়ে রাও বলে উঠলেন, ‘বিউটিফুল রিভার, কী নাম এর?’
–ময়ূরাক্ষী! এখন শীতে জল নেই কিন্তু বর্ষায় স্রোতে টলোমলো করে।
‘ময়ুরাকসি, ময়ুরাকসি’, নিজের মনেই বারদুয়েক নামটি উচ্চারণ করে ঈশ্বর বললেন, ‘ক্যান উই টেক আ ব্রেক হিয়ার, জাস্ট টেন মিনিটস! নদী চোখে পড়লে আই কান্ট রেজিস্ট মাইসেলফ!’
ব্রিজ পার হয়ে বড়ো রাস্তার একপাশে দাঁড়াল গাড়িটি, ঈশ্বর আজও একটা সাদা জামা আর ব্লু জিনস পরেছেন, চোখে রোদচশমা, দরজা খুলে নেমেই একটা সিগারেট ধরিয়ে পৃথ্বীশের দিকে প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ডোন্ট হেসিটেট, আই নো ইউ স্মোক!’
সিগারেট নিয়ে একটু সামনে এগিয়ে এসে ফোন খুলে ঋষাকে ডায়াল করল পৃথ্বীশ, দুবার রিঙ হতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল ঋষার গলা, ‘বলো, কতদূর তোমরা?’
–এই তো আর মিনিট চল্লিশের মধ্যেই পৌঁছে যাব!
–বাহ! তোমরা কি কান্দি হয়ে আসছো?
নদীপারের এলোমেলো হাওয়া একহাতে আড়াল করে সিগারেট ধরিয়ে পৃথ্বীশ বলল, ‘না রে আমরা বর্ধমান থেকে সোজা ডাকবাংলো হাট হয়ে আসছি।’
–ওহ! তাহলে তো রাস্তা ভালো, বেশ সাবধানে এস, আর…
কথার মাঝেই পৃথ্বীশ জিজ্ঞাসা করল, ‘আর?’
সামান্য হাসি শোনা গেল ওপাশে, ‘আর বেশি সিগারেট খেও না!’
–লাইটারের শব্দ পেলাম যে! তোমাকে আমি হাড়ে মজ্জায় চিনি পৃথ্বী! বারবার ধরা পড়ে যাও অথচ কথা শুনবে না!
–চুপ কর মিস মার্পল! এসে তোর পাকামি বের করছি!
পৃথ্বীশের কথা শুনে আহ্লাদির মতো গলায় ‘সাবধানে এসো, অপেক্ষা করছি! ‘বলেই ফোন কেটে দিল ঋষা।
ফোন রাখতেই বন্যাকে একবার রিং করল, রিং বেজে থেমে গেল কিন্তু ফোন তুলল না কেউ। আরও একবার ফোন করল, এবারও কেউ ধরল না, সামান্য চিন্তা নিয়েই দ্রুত হাতে মেসেজবক্স খুলে লিখল, ‘সব ঠিক আছে? কল ব্যাক করো।’
বেলা প্রায় এগারোটা বাজে, দুপাশে থইথই কার্তিকের নরম আলোয় সবুজ জ্যোৎস্নার মতো ফুটে উঠেছে আদিগন্ত ধানক্ষেত, আকাশে কতগুলি মেঘ ইস্কুলছুট বালকের চঞ্চলতায় যেন ভুবনপাড়ায় খেলতে বেরিয়েছে, শীর্ণা ময়ূরাক্ষীর ধু ধু বালুচরে শারদস্মৃতির উপহার স্বরূপ এখনও বিগতযৌবনা কাশঝোপ বাতাসে মাথা দুলিয়ে কাকে যেন ডেকে চলেছে, মাঠে হাল বলদ নিয়ে চাষার দল নেমে পড়েছে, দূর থেকে তাদের গলার স্বর অস্পষ্ট গানের মতো ভেসে আসছে-মায়াজগতের এই অপার ঐশ্বর্যের দিকে তাকিয়ে পৃথ্বীশের হঠাৎ মনে হল বন্যা কতবার বলেছে এমন একাকী নদীর কথা অথচ কখনও আসা হয়নি, আজ নিজে এল কিন্তু তাকে সঙ্গে নেওয়া হল না। মেয়েটি বড়ো নিঃসঙ্গ, বড়ো অভিমানী কিন্তু সব বুঝেও পৃথ্বীশ কিছু বলতে পারে না, সম্পর্কের কতটুকুই বা মানুষ বুঝতে পারে, বারবার আধার আর আধেয়কে এক করে ফেলে কষ্ট পায়, সেই হয়তো বাসনা সমুদ্রে ডুবে থাকা মানুষের নিয়তি।
পৃথ্বীশকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে রাও অন্তরঙ্গ সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এনিথিং রং?’
মলিন হাসি মুখে নিয়ে পৃথ্বীশ জবাব দিল, ‘নাহ!’, দু-এক মুহূর্ত পর বলল, ‘চলুন রওনা হই আমরা।’
গাড়ির দিকে যেতে যেতে ঈশ্বর হঠাৎ সুদূর প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে আপনমনেই বলে উঠলেন, ‘রয়, থ্যাঙ্কস, থ্যাঙ্কস ফর এভরিথিং!’
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ঈশ্বরের দিকে তাকাতেই তিনি সামান্য হেসে বললেন, ‘ইওর মাদারল্যান্ড ইজ বিউটিফুল, লাইক আ হেভেনলি ইয়ং লেডি, বিউটিফুল এন্ড আট দ্য সেম টাইম ভেরি অ্যারিস্টোক্রেট! তোমার জন্য আমিও দেখলাম, দিজ ট্রিপ ওয়াজ নিডেড ফর মি।’
সলজ্জ হেসে পৃথ্বীশ নিচু গলায় বলল, ‘ইউ আর অলসো আ ভেরি সেনসিটিভ পারসন, আ গুড হিউম্যান বিয়িং।’
নদীচর থেকে উঠে আসা হুহু বাতাসে গলা মিলিয়ে উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠলেন ঈশ্বর, ‘তুমি এখুনও চেনো না আমাকে রয়! ডোন্ট গিভ আ ওপেন সার্টিফিকেট টু এনি আননোন পারসন সো কুইকলি, তাহলে কখুনও মানুষ বুঝতে শিখবে না তুমি!’
এই রৌদ্রস্নাতা অপরূপা হেমন্ত ঋতুর মাঝে ময়ূরাক্ষীর আঁচল জড়িয়ে শুয়ে থাকা শূন্য বালুচরের দিকে তাকিয়ে অকারণেই এই বিদেশি মানুষটিকে খুব আপনার জন বলে মনে হল পৃথ্বীশের, যেন কতকালের পরিচয়, কত জন্ম পূর্বে হয়তো সেই অচেনা ভীরাভরম গ্রামে কলকলনাদিনী গোদাবরীর তীরে আলাপ হয়েছিল তারপর কেটে গেছে কত মাস বৎসর দিন, জ্যোৎস্নায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চরাচর, মেঘে আকুল হয়েছে আকাশ কত খরতপ্ত গ্রীষ্ম মধ্যাহ্নে বয়ে গেছে তপ্ত বাতাস, দুজনার কারোর মনে পড়েনি কাউকে, আজ এতদিন পর আবার দেখা হয়েছে…সখার মতো ঈশ্বরের দিকে তাকিয়ে পৃথ্বীশের বলতে ইচ্ছা হল, ‘আপনাকে আমার খুব প্রয়োজন ঈশ্বর, আমাকে ছেড়ে যেন চলে যাবেন না!’
মানুষের অন্তরঙ্গ অনুচ্চারিত শব্দ বোধহয় অপর মানুষের মনে হিল্লোল তোলে, পৃথ্বীশের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বর মৃদু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রয়, তুমি কি কিছু বলতে চাও আমাকে?’
কোনও কথা না বলে মুখ নিচু করে মাথা নাড়ল পৃথ্বীশ।
–ওয়েল, যেতে যেতে শুনব। বাট ওয়ান থিং রয়, নেভার ফরগেট দিজ বিউটিফুল মাদারল্যান্ড, সি ইজ ইয়োর রুট, ওলওয়েজ রিমেমবার ইওর রুট, আ রুটলেস পারসন ক্যান্ট বি হ্যাপি।’
কয়েক মুহূর্ত পর পরমা প্রকৃতির চোখের মণির মতো উজ্জ্বল সুনীল আকাশের দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে বলে উঠলেন, ‘যো বৈ ভূমা তৎ সুখং নাল্পে সুখমস্তি, ভূমৈব সুখং!’
চিত্রকর: শুভ্রনীল ঘোষ পরের পর্ব : আগামী মাসের দ্বিতীয় শনিবার
সায়ন্তন ঠাকুর, গদ্যকার, সরল অনাড়ম্বর একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত। পূর্বপ্রকাশিত উপন্যাস নয়নপথগামী ও শাকম্ভরী। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ, বাসাংসি জীর্ণানি।