
দ্য ওয়াল ব্যুরো: মঞ্চে সুব্রত বক্সীর মুখ দেখে মনে হল, এই ঘোষণার জন্য তিনিও প্রস্তুত ছিলেন না। দিদির কথা শুনেও অনেকের সন্দেহ হচ্ছে, সোমবার তেখালি মাঠে যে ঘোষণা তিনি করে দিলেন, তা আদৌ সুচিন্তিত কি?
প্রথমে বললেন, “নন্দীগ্রাম সিটে কারও নাম আমি এখনই বলছি না। পরে বলব। তবে নন্দীগ্রাম সিটে ভাল মানুষ দেব, যিনি সত্যিই আপনাদের কাছে পড়ে থেকে কাজ করবেন।”
তার পর বললেন, “এমনিতে এটা জেনারেল সিট। আমিই যদি নন্দীগ্রামে দাঁড়াই, কেমন হয়? একটু ভাবছিলাম, কথার কথা, একটু বললাম, একটু ইচ্ছে হল, একটু গ্রামীণ জায়গা, একটু আমার মনের জায়গা।… আমি হয়তো ভোটের সময় বেশি থাকতে পারব না। তার পর যা কাজ আমি সব করে দেব।… ভবানীপুরকেও আমি অবহেলা করছি না। সেখানেও ভাল প্রার্থী দেব। বক্সীকে বলব নন্দীগ্রামেও যেন আমার নামটা থাকে।”
আবার শেষে বললেন, “ভবানীপুর আমার মেজো বোন, নন্দীগ্রাম আমার ছোট বোন। পারলে আমি দুটো আসনেই লড়ব। তবে নন্দীগ্রামে দাঁড়াবই।”

একটাই বক্তৃতা। অনেকের মতে, পরপর এ কথাগুলো শুনলেই বোঝা যাবে হয়তো ভেবেচিন্তে এই ঘোষণা করেননি। তাঁর মধ্যে দোদুল্যমানতা ছিল। তাই কখনও বলেছেন, “নন্দীগ্রামে ভাল প্রার্থী দেব।” কখনও বলেছেন, “ভবানীপুরেও ভাল প্রার্থী দেব।” আবার শেষে বলেছেন, “পারলে দুটো সিট থেকেই লড়ব।”
আরও পড়ুন: নন্দীগ্রামে মাননীয়াকে যদি হাফ লাখ ভোটে হারাতে না পারি, রাজনীতি ছেড়ে দেব: শুভেন্দু
তৃণমূল অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের কথা বললেও, তা যে ষোলো আনা ব্যক্তিকেন্দ্রিক দল সে ব্যাপারে সর্বভারতীয় স্তরে সমালোচনা রয়েছে। অনেকের মতে, এদিন স্পষ্ট হয়ে গেল, তৃণমূল সত্যিই তাই। প্রার্থী বাছাই নিয়ে কোনও আলোচনা নেই। সরাসরি সিদ্ধান্ত ঘোষণা হয় একজনের ইচ্ছেয়।
এখন, প্রশ্ন এটা কি সত্যিই মমতার মাস্টারস্ট্রোক
বস্তুত সোমবারের এই ঘোষণার আকস্মিকতা এমনই ছিল যে তৃণমূলের অনেকেই চমকে গিয়েছেন। আবার অনেকে ভেবেচিন্তে বলেছেন, “এ হল দিদির মাস্টারস্ট্রোক।”
কেন তাঁরা তা বলছেন, তার সপক্ষে তাঁদের নিজের মতো যুক্তি রয়েছে।
এক, এর পর শুভেন্দু অধিকারীকে নন্দীগ্রামে লড়তেই হবে। নন্দীগ্রামে শুভেন্দু প্রার্থী হতে না চাইলেই বড় জয় হবে তৃণমূলের।
দুই, নন্দীগ্রামে প্রার্থী হবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অর্থাৎ সেই চাপে শুভেন্দুকে অনেকটা সময় ব্যস্ত থাকতে হবে নন্দীগ্রাম নিয়ে।
তিন, মমতার নন্দীগ্রামে প্রার্থী হওয়ার অর্থ, তার প্রভাব দুই মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামেও পড়বে। শুভেন্দু দল ছাড়লেও দিদির এই ঘোষণাতেই অক্সিজেন পাবেন তৃণমূল কর্মীরা।
চার, অজয় মুখোপাধ্যায়ের পর মেদিনীপুর জেলা আবার মুখ্যমন্ত্রী পেতে চলেছে।
নাকি মরিয়া চেষ্টা, ডেসপারেশন
তৃণমূল মাস্টারস্ট্রোক বললেও অনেকেই তা মানতে রাজি নন। তাঁদের মতে, এটা একেবারেই মরিয়া চেষ্টা, মানে ডেসপারেশন।
এ কথা তাঁরা কেন বলছেন, তার সপক্ষে তাঁদেরও যুক্তি রয়েছে।
এক, মমতার ঘোষণায় আরও একবার স্পষ্ট হয়ে গেল, শুভেন্দু অধিকারীকে মোকাবিলা করার মতো নেতা তৃণমূলে নেই। তৃণমূলের মমতার পর শুভেন্দুই সবথেকে মজবুত নেতা ছিলেন। বাংলার লড়াইয়ে মেরুকরণ আরও ধারালো হয়ে গেল। মমতা বনাম শুভেন্দু।
দুই, এমনিতেই জল্পনা ছিল যে মমতা ভবানীপুরে প্রার্থী হতে চাইছেন না। কারণ, সেখানে লোকসভা ভোটেও মার্জিন ছিল খুব কম। এদিনের দোদুল্যমানতায় তা আরও স্পষ্ট হয়ে গেল। এমনিতে বাংলার রাজনীতিতে দু’টি আসনে লড়ার বিশেষ চল নেই, তা মূলত উত্তর ভারতের সংস্কৃতি। জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা কখনও আসল বদল করেননি। বিরোধীরা পষ্টাপষ্টি বলার সুযোগ পেয়ে গেল ভবানীপুরে ঘরের মাঠেই ভরসা পাচ্ছেন না দিদি। এই কথাটাই এদিন আবদুল মান্নান-সুজন চক্রবর্তীরা বলেছেন।
তিন, মমতার এ ঘোষণার পরই এদিন মুকুল রায় বলেন, “ওঁকে দেখে মনে হল, ভেবেচিন্তে আসেনি। নার্ভাস হয়ে বলে ফেলেছেন। এভাবে কোনও প্রার্থী ঘোষণা হয়? একবার বলছেন, নন্দীগ্রামে ভাল প্রার্থী দেব, আবার বলছে ভবানীপুরে ভাল প্রার্থী দেব। সুব্রত বক্সীকে বরাবর বক্সীদা বলে, অথচ দেখলাম আজ বক্সী বলছে। আমার থেকে তো ওঁকে বেশি কেউ চেনে না, একদম ঘেঁটে গেছেন।”
বিবদমান এই যুক্তি ও পাল্টা যুক্তির মাঝে একটা বিষয় পরিষ্কার। তা হল নন্দীগ্রামের লড়াই এ বার হতে চলেছে ঐতিহাসিক। এসপার-ওসপার যাই হোক, ইতিহাসে লেখা থাকবে।