
মারাংবুরু মাহাত: শুক্রবার পয়লা বৈশাখ বা ১ জানুয়ারি ছিল না। কিন্তু তাও বাংলার প্রান্তপদে পালিত হল নববর্ষ। ঢাকে, মাদলে, নতুন সাজের বাহারে, পুজোর আদিম আড়ম্বরে আহ্বান করা হল নতুন বছরকে। আলো আঁধারির জঙ্গলমহলের বন, পাহাড়ের মানুষদের কাছে ১মাঘই নতুন বছরের প্রথম দিন। সেই অনাদি কাল থেকে জঙ্গলের ভূমিপুত্র-কন্যারা এদিনেই পালন করে আসছে ‘আখাঞন জাতরা’ বা নববর্ষ। প্রকৃতিস্য পুত্রাদের কাছে প্রকৃতিই সব। তাই নতুন বছরের প্রথম দিন দ্রিমি দ্রিমি ধামসা, মাদলে… পাহাড় থেকে গাছ পুজো হয়েছে, মাটির ঘোড়ায় অর্ঘ্য সাজিয়েছে জঙ্গলমহল। সাব- অল্ট্রানরা এই রীতিতেই নিজেদের নববর্ষ পালন করে থাকে। থাকে না কোনও ফেস্টিভ্যালের সেলিব্রেশন। থাকে না টুপটাপ মেসেজ বা হ্যাপিওয়ালা মার্কা গ্রিটিংস কার্ড। টিভিতে কাউন্টডাউনেরও কোনও বালাই নেই। বেণীমাধবীয় পঞ্জিকাতেও যার কোনও নির্ঘণ্ট নেই। শুধু প্রান্তজনবাসীর নখদর্পণে বাউড়ি, মকর, আখাঞন!
![]()

‘আখাঞন জাতরা’ অর্থাৎ সূর্যের উত্তরায়ন যাত্রা শুরু। প্রথাগত শিক্ষায় প্রায় অশিক্ষিত মানুষদের অবাক করা জ্যোতির্বিদ্যা দক্ষতার আভাস পাওয়া যায় কুড়মালি ক্যালেন্ডারে। ক্যালেন্ডারে ঋতু অনুযায়ী মাস। অর্থাৎ ছয়টি মাস… জাড়, মধু, খরা, বেরসা, করম, মাইসর। সূর্যদেবের যাত্রার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই আখাঞনের দিন আদিবাসীদের নববর্ষ। আদিকালে যখন ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা ছিল না, চাঁদ বা সূর্য দেখেই দিন, মাস গোনা হত। সেই আদিকাল থেকেই আখাঞন দিনটি আদি জনজাতিদের কাছে বছরের প্রথম দিন। আদিকাল থেকে চলে আসা এই প্রথা এখনও টিকে রয়েছে বাংলারই প্রান্তভূম জঙ্গলমহলে। বাংলা নববর্ষের ১লা বৈশাখ, বা ইংরেজি নিউ ইয়ার পালনের উন্মাদনা খুব একটা দেখা যায় না পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম জেলায়। জঙ্গলমহলে গত কয়েক বছর ধরে কুড়মি জনজাতি যেহেতু নিজেদের জাতিসত্তা, সারনা(প্রকৃতি), ধর্ম স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে। তাই ‘আখাঞন জাতরা’ পালনে আদি জনজাতিরা এখন আরও বেশি উন্মুখ।![]()

আদি জনজাতিরা বরাবরই প্রকৃতি পূজায় বিশ্বাসী। প্রকৃতি রক্ষায় তারাই স্বতস্ফূর্তভাবে এগিয়ে থাকে সবসময়। নতুন বছরের প্রথম দিনেও যা রীতি, নীতি সবই প্রকৃতি কেন্দ্রীক। কোথাও হয় পাহাড় পুজো, কোথাও আবার গরাম থানে গাছ পুজো। পাহাড়, গাছকে দেওয়া হয় মাটির ঘোড়া। উড়িয়ে দেওয়া হয় পায়রা, মোরগ। আদি জনজাতির মানুষরা নিজেরাই পুরোহিত সেজে পূজার্চনা করেন। এদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় কোনও কোনও গ্রামে ভানসিং পুজো। ভানসিং অর্থাৎ সূর্যকে আরাধনা।
বছরর প্রথম দিনে প্রতিটি সাঁওতাল অধ্যুষিত গ্রামে ‘মাঝি’ পরিবর্তনের রেওয়াজ রয়েছে। মাঝি অর্থাৎ গ্রামের প্রধান। তবে মূলত ১ মাঘে গ্রামে গ্রামে ভানসিং পুজো দিয়েই শুরু হয় বছর।![]()

‘আখাঞন জাতরা’কে ঘিরে আবেগটা একটু বেশিই কুড়মি সমাজে। বছরের প্রথম দিনেই যে কোনও শুভ কাজ শুরু করে তারা। ‘আড়াই পাক’ লাঙল দেওয়া, বা মাটিতে কোদাল চালানো সবই রীতি মেনে। আড়াই পাক লাঙল চালিয়ে ‘হাল পুণ্য’র মাধ্যমে নতুন বছরের সূচনা। দুপুরে দই চিঁড়ে ভোজ। পাত্র পাত্রী দেখার জন্যও অনেকসময় এই দিনটাকেই বেছে নেয় আদি জনজাতিরা। বর্ষবরণ উদযাপন করতে চাপাইসিনি, দুয়ারসিনি, দেউলঘাটায় জমে ওঠে মেলা। মেলায় ছৌ, ঝুমুর, নাচনি, নাটুয়া, টুসু গান বা মোরগ লড়াইয়ে মেতে ওঠে মানুষ। নতুন বছরকে ঘিরে এক অনাবিল আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে সাঁওতাল, কুড়মিদের নিজস্ব ভুবনে। বাংলার বুকেই এ এক অন্য দলিল, অন্য ইতিহাস। যা আজও অবহেলিত, অলিখিত।
(জল জমি জঙ্গল পাহাড় রক্ষায় আদিবাসীদের পক্ষে এই লেখকের কলম গর্জে ওঠে। একাধিক আদিবাসী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বন ভূমি পাহাড়ের জন্য তিনি সদা জাগ্রত। জঙ্গলমহলে জন্মে জঙ্গলমহলেই বিচরণ করেন এই লেখক।)