
আমার দল ক্ষমতায়। সুতরাং আমি যা খুশি তাই করতে পারি। সোমবার এই গা জোয়ারির মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিগুরুর বিশ্বভারতীতে পৌষমেলার মাঠ পাঁচিল দিয়ে ঘেরার প্রস্তুতি চলছিল। রাতারাতি সেখানে জড়ো হয়ে গেল হাজার খানেক মানুষ। চলে এল পে লোডার। ভেঙে দেওয়া হল পাঁচিল। নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হল। পুরো ব্যাপারটা ঘটল পুলিশের নাকের ডগায়। বিশ্বভারতীর গেটের অদূরেই থানা। কিন্তু আইনরক্ষকরা কেউ বাধা দিতে আসেনি।
বিতর্কের কেন্দ্রে বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। তিনিই পৌষমেলার মাঠ ঘিরে দিতে চেয়েছিলেন। স্থানীয় কেউ কেউ বলছেন, এতে শান্তিনিকেতনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হবে। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, মুক্ত পরিবেশে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখুক। কিন্তু উপাচার্য বিশ্বভারতীকে কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত করতে চাইছেন। সুতরাং ‘ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’।
গণতন্ত্রে কেউ বিরোধী মত পোষণ করতেই পারেন। প্রতিবাদ করার নির্দিষ্ট আইনসম্মত পন্থা আছে। তাতেও কাজ না হলে আদালতের দরজা খোলা। সেখানে যুক্তি ও তথ্য পেশ করে প্রতিবাদীরা প্রমাণ করতে পারতেন, উপাচার্যের সিদ্ধান্ত ভুল। কিন্তু তাঁরা সেই পথে হাঁটলেন না। পেশিশক্তি প্রদর্শন করলেন। কোনও দল ক্ষমতায় থাকলে তার পক্ষে এক হাজার লোক জড়ো করে ফেলা কোনও ব্যাপারই নয়। তাদের দিয়ে ভাঙচুর করিয়ে নেতারা বলছেন জনরোষ। অতীতে সিপিএম এমন প্রায়ই বলত। এখন তৃণমূলও বলছে।
রবিবার থেকেই বিশ্বভারতীর আশপাশে টেনশন ছিল। পৌষমেলার মাঠে পাঁচিল দেওয়ার প্রতিবাদে ‘মেলার মাঠ বাঁচাও শান্তিনিকেতন বাঁচাও’ নামে একটি সংগঠন গজিয়ে উঠেছে। তারা রবিবার থেকে বোলপুরে ও তার আশপাশের গ্রামে মাইকে প্রচার শুরু করে। সোমবার সকাল ন’টায় জমায়েত শুরু হয়। প্রথম থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন দুবরাজপুরের বিধায়ক তথা বোলপুরের বিদায়ী উপপ্রধান নরেশ বাউরি। এছাড়া ছিলেন বিশ্বভারতীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মী ও জেলা তৃণমূল নেতা গগন সরকার, বোলপুরের পুর প্রশাসক সুকান্ত হাজরা, বিদায়ী কাউন্সিলার ওমর শেখ।

তৃণমূল নেতারা মিছিলে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন, তবুও তাঁরা দাবি করছেন, মিছিলের চরিত্র অরাজনৈতিক, স্বতঃস্ফূর্ত।
সাড়ে ন’টা নাগাদ মিছিল হানা দেয় বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসে। শুরু হয় ভাঙচুর। নির্মাণের জন্য সেখানে জড়ো করা ছিল ইট, পাথর, বালি, সিমেন্ট, বৈদ্যুতিক আলো ও পাখা। সেসব দ্রুত উধাও হয়ে যায়। ঠিকাদারের কর্মীরাও কেউ কেউ মারধর খেয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
তৃণমূল নেতাদের নিশানায় ছিলেন উপাচার্য। ঠিকাদারের লোকেদের তো কোনও দোষ নেই। সে বেচারারা পেটের দায়ে কাজ করতে গিয়েছে। তাদের মারধর করা কেন?
বিক্ষোভকারীরা বলছেন, পৌষমেলার পাঁচিল দেওয়া রবীন্দ্রনাথের আদর্শের বিরোধী। কিন্তু তাঁরা যা করলেন, এইভাবে দলবল নিয়ে হামলা করা, সেটা কি খুব রাবীন্দ্রিক কাজ? রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে কি হামলাকারীদের সমর্থন করতেন?
তৃণমূল নেতারা দেখাতে চাইছেন, রবীন্দ্রনাথের আদর্শের টানে মিছিলে এক হাজার লোক জড়ো হয়েছিল। আদর্শবাদীরা সুযোগ পেয়েই ইট, বালি, সিমেন্ট ঝটপট সরিয়ে ফেলল কী করে? এ আবার কেমনতর আদর্শ?
কেউ কেউ বলছেন, ঠিকাদারের লোকজনই ইট,বালি সরিয়ে ফেলেছে। সেকথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। হাজারখানেক মারমুখী লোকের মাঝখানে ঠিকাদারের কর্মীরা কীভাবে সরাবে?
কোনও আদর্শ নয়। স্রেফ রাজনীতি। ক্ষমতার লড়াই। এভাবেই দেখা যায় পুরো ব্যাপারটাকে। হয়তো উপাচার্যও কোনও রাজনীতির শরিক হয়ে পড়েছেন।
বিশ্বভারতীর অবস্থা দেখে সঙ্গত কারণেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাজ্যপাল। তিনি টুইটারে লিখেছেন, সিচুয়েশন অব ল অ্যান্ড অর্ডার ইন বিশ্বভারতী ইজ অ্যালার্মিং। শিক্ষায়তনে যাতে শান্তি ফিরে আসে, সেজন্য আমি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করছি।
মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু হামলাকারীদের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা করেননি। যদিও তাঁর কাছে এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল। উল্টে তাঁর দল রাজ্যপালের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতে পারে শোনা যাচ্ছে।
দলীয় রাজনীতি অতীতে বহুবার শিক্ষাঙ্গনকে কলঙ্কিত করেছে। বিশ্বভারতীতেও তাই ঘটছে। একদা সেখানে তপোবনের মতো পরিবেশ ছিল। সেসব বহুদিনই নেই। তার ওপরে যদি প্রতিষ্ঠানটিকে কেন্দ্র করে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি শুরু হয়, তাহলে যেটুকু পড়াশোনা হয়, তাও বন্ধ হয়ে যাবে।