
নির্দিষ্ট ক্যানসার কোষে স্পষ্ট ও নির্ভুল রেডিয়েশন থেরাপি, হ্যালসিয়ন যেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক আশীর্বাদ
তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
বিশ্বজুড়ে নিঃশব্দে বেড়ে উঠেছে ক্যানসারের প্রকোপ। সংখ্যায় যেমন বাড়ছে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা, তেমনই বাড়ছে এর তীব্রতাও। মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। ক্যানসার নিয়ে একটা কথা ক’দিন আগেও শোনা যেত, ‘ক্যানসার হ্যাজ নো অ্যানসার’। না, ক্যানসার রোধ করার মতো কোনও সুনির্দিষ্ট ওষুধ হয়তো এখনও বেরোয়নি, জানা যায়নি এর সবটুকু ব্যাখ্যা। কিন্তু তাই বলে বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিও কিন্তু থেমে নেই। নিরন্তর গবেষণা চলছে, কী করে এই দুরারোগ্য অসুখের নিরাময় আরও সহজ হয়, সুনির্দিষ্ট হয়। সেই গবেষণারই একটি সাম্প্রতিক ফসল হল হ্যালসিয়ন যন্ত্র। আমেরিকার একটি সংস্থা নির্মিত এ যন্ত্র প্রায় ইতিহাস তৈরি করেছে ক্যানসারের অন্যতম চিকিৎসা পদ্ধতি রেডিয়েশনের ক্ষেত্রে।
ঠিক কীভাবে কাজ করছে এই যন্ত্র, এর ব্যবহারে কতটা সুবিধা হয়েছে ডাক্তারদের এবং রোগীদের, তা নিয়ে এ সময়ে আলোচনা জরুরি। কারণ চিকিৎসকরাই বলছেন, বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী আবিষ্কার এই হ্যালসিয়ন মেশিন, যা ক্যানসারের চিকিৎসার অন্যতম জরুরি ধাপ রেডিয়েশন থেরাপিকে করেছে অনেক সহজ ও নির্ভুল।
অ্যাপোলো হাসপাতালের রেডিয়েশন অঙ্কোলজিস্ট ডক্টর জীবক ভট্টাচার্য জানালেন, হ্যালসিয়ন নিয়ে জানতে হলে আগে জানতে হবে কীভাবে হতো রেডিয়েশন থেরাপি। তিনি জানান, প্রথম দিকে কোবাল্ট মেশিনে গামা রে দিয়ে রেডিয়েশন দেওয়া হতো রোগীর শরীরে। এই কোবাল্ট মেশিন অবশ্য এখনও আছে। সেই মেশিনে একটা নির্দিষ্ট উৎস থেকে রে বেরিয়ে টিউমারের ‘অ্যানাটমিক্যাল ল্যান্ডমার্ক’ দেখে তা রোগীর শরীরে পৌঁছয় নির্দিষ্ট জায়গায়। ফলে শরীরের একটা বড় এরিয়া ধরে রেডিয়েশন দিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে টিউমার ছাড়াও আরও অনেকটা অংশ থাকে। এতে স্বাভাবিক ভাবেই টিউমারের ক্যানসার কোষগুলো যতটা নষ্ট হয়, সেই সঙ্গে অন্যান্য অংশও নষ্ট হয়। সহজ কথায় বললে, টিউমার আন্দাজ করে রেডিয়েশন দিয়ে দেওয়ার ফলে আশপাশের স্বাভাবিক টিস্যুতেও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে।
তিনি জানালেন, এটা করতে গিয়ে নানা সমস্যা হতো। শরীরের কিছু কিছু জায়গা এত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল, যে সেখানে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি রে দেওয়াই যায় না। ফলে টিউমারেও কম পরিমাণ রে দিতে হবে। ফলে এটা একটা বাধা হয়ে গেছিল টিউমার নষ্ট করায়। নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি রে টিউমারে দেওয়াই যেত না। পরবর্তী কালে যখন আধুনিক যন্ত্রপাতি আসতে শুরু করল, তখন সিটি স্ক্যান বেসড রেডিয়েশন শুরু হল। অর্থাৎ সিটি স্ক্যান করে টিউমারের আয়তন, অবস্থান খুব ভাল করে বুঝে নিয়ে, টিউমারের দিকে রে প্রয়োগ করাটা আরও একটু সুনির্দিষ্ট করা সম্ভব হল। তাঁর কথায়, “এতে কী হল, আগে যতটা জায়গায় রে পড়ত, এখন তার চেয়ে কম অংশে রে দেওয়া সম্ভব হল। এর পরে আরও একটু উন্নত ব্যবস্থা হল, যে টিউমারের যেমন আকৃতি, সেই আকৃতি অনুযায়ীই রে জেনারেট করতে শুরু করা সম্ভব হল। এর ফলে আরও বেশি সুনির্দিষ্ট ভাবে টিউমার রেডিয়েশন পেতে শুরু করল, আশপাশের টিস্যু বাঁচল।”
এরও পরে আর এক ধাপ এগোল চিকিৎসা। শুধু টিউমারের আয়তন ও অবস্থান নয়, এর পরে এল আইএমআরটি। অর্থাৎ ইন্টেন্সিটি মড্যুলেশনে কাজ শুরু হল। এর মাধ্যমে যে সুবিধা হল, রে দেওয়ার সময় তার মুভমেন্টও করানো সম্ভব হল। অর্থাৎ, রে যখন টিউমারের কাছে, তখন তার তীব্রতা বাড়ানো ও যখন টিউমার থেকে ক্রমে দূরে সরছে, তখন তার তীব্রতা কমানো সম্ভব হল। এর ফলে কোথায় বেশি ডোজ বা কোথায় কম ডোজ তা নির্ণয় করা সম্ভব হল। এতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে ডোজের সঙ্গে আপস করা একটু কমল।
জীবকবাবু বলেন, “এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলা ভাল, সিটি স্ক্যানের উপর ভিত্তি করে রোগীর যখন চিকিৎসা চলছে, তখন প্রতিদিন যে রোগী আসছেন, বেডে শুচ্ছেন, এতে তাঁর অবস্থান ও আকৃতি সামান্য হলেও বদলে যায়। শ্বাসপ্রশ্বাসের কমা-বাড়া হয়, শরীরের ভেতরেও বদল আসে। এর ফলে রে যেখানে পড়ছে, সেটাই নির্দিষ্ট টিউমার কিনা, তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। তখন শুরু হল, প্রতিদিন এক্সরে করে রোগীর টিউমারের অবস্থান নির্ধারণ করা। পরে এই এক্সরে পরিণত হল সিটি স্ক্যানে। ফলে ঠিক জায়গায় রে পড়ছে কিনা, তা বোঝা সহজ হল। টিউমার কতটা বড় বা ছোট হচ্ছে, তাও স্পষ্ট হল প্রতিদিন।”
এখন এ কথা বলাই বাহুল্য, সিটি স্ক্যান যত নিখুঁত হবে, রেডিয়েশনও ততটা নির্দিষ্ট হবে। পাশাপাশি, যে রেডিয়েশন রোগীর শরীরে ঢুকছে, তা যত কম সময়ে হবে, তাও ভাল। কারণ কম সময় মানেই কম নড়াচড়া।
এইখানেই আসছে হ্যালসিয়ন মেশিনের সুবিধা। জীবকবাবু জানালেন, দুটো স্তরে মেশিনটা কাজ করছে। প্রথমত, এই মেশিনের মাধ্যমে টিউমারের আকার ও আকৃতি অনুযায়ী রেডিয়েশনের রশ্মিটার আকৃতিও বদলানো যায়। ফলে টিউমার ধ্বংসকারী যে রশ্মি রোগীর শরীরে ঢুকছে, তা সুবিশেষ ও সুনির্দিষ্ট ভাবে টিউমারটিকেই ধ্বংস করছে। দ্বিতীয়ত, এই মেশিনটা অত্যন্ত দ্রুতগতির। ফলে খুব তাড়াতাড়ি অনেকটা রেডিয়েশন রোগীর শরীরে প্রয়োগ করা সম্ভব হল। ফলে অনেক তাড়াতাড়ি অনেক বেশি পরিমাণে রেডিয়েশন পেলেন রোগী। তাড়াতাড়ি ছাড়া পেলেন তিনি। পাশাপাশি, রোগীর মুভমেন্টের ফলে যে গন্ডগোল হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তা প্রায় শূন্য হয়ে গেল।
শুধু তাই নয়। এই মেশিন যে সিটিস্ক্যানটি করছে, তা অন্য মেশিনগুলোর তুলনায় অনেকটা ভাল। অনেক বেশি রেজোলিউশনের ছবি পাওয়া যায় এই যন্ত্রে। এত দিন যে সিটিস্ক্যান হতো, তার ছবির গুণগত মান খানিকটা কমা হতো। এখানে তা না হওয়ায়, রে প্রয়োগ করতে আরও সুবিধা হচ্ছে চিকিৎসকদের। একইসঙ্গে সিটিস্ক্যানের সঙ্গে টিউমার ম্যাচ করিয়ে রেডিয়েশন দেওয়ার যে পদ্ধতিটি হাতে-কলমে করতে হতো, তার অনেকটাই এই মেশিন করে দেয় নির্ভুল ভাবে। ফলে ত্রুটি বা খুঁত থাকার সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য হয়ে যায়। ম্যানুয়াল এরর এড়ানো যায় সহজেই।
সেই সঙ্গে জীবকবাবু জানান, এই মেশিনের স্ক্রিনে নিজের ছবিটি দেখতে পান রোগী। সেখানে তিনি দেখেন, তাঁর চিকিৎসা শুরু হল। এটা একটা মানসিক শান্তি। আরও একটি বিষয় হল, অন্যান্য মেশিনের ভিতরে থেকে চিকিতসা চলার সময়ে বদ্ধ জায়গায় একা ভয় পান রোগীরা। কষ্ট হয় অনেকের, দমবন্ধ হয়ে আসে। হ্যালসিয়ন সেখানে অনেকটাই সহজ, এবং সিম্পল। ছোট বদ্ধ জায়গায় অনেক রকম যন্ত্রপাতি ঘুরছে, খুব ভীতিপ্রদ পরিবেশ, তা নয়। এর ফলে রোগীর ওপর মানসিক চাপ অনেক কম পড়ে। শুধু তাই নয়, এই যন্ত্রে শোয়ার যে বেড বা কাউচ, সেটা অনেকটা নিচু করা যায়। ফলে যে কেউ অনেক আরামে মেশিনটিতে উঠে বসতে ও শুতে পারেন।
এ বিষয়ে অ্যাপোলো হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট রেডিয়েশন অঙ্কোলজিস্ট ডক্টর আখতার জাভেদ জানালেন, ক্যানসারের ক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে চেষ্টা করা হয় সিস্টেম্যাটিক থেরাপির মাধ্যমে, মেডিক্যাল অঙ্কোলজিক্যালি রোগীর চিকিৎসা করা। এর পরের ধাপ রেডিয়েশন। একে সহজ ভাবে বললে, হাই ইন্টেনসিটি এনার্জি দিয়ে ক্যানসার আক্রান্ত কোষগুলি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

ডক্টর জাভেদের কথায়, “এক্স রে গিয়ে ক্যানসার কোষের ভিতরে এমন চেঞ্জ করে, যার ফলে সেলটা পুড়ে গিয়ে মৃত কোষে পরিণত হয়। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই ক্যানসার সেলের পাশাপাশি আশপাশের কিছু ভাল কোষও পুড়ে যায়। এর ফলে অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় রোগীর শরীরে। ঠিক নির্দিষ্ট কোষটুকুতেই রেডিয়েশন দিতে পারাটাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা যদি জায়গাটা আরও ছোট করে ডোজ বাড়াতে পারব, তত কম সময়ে চিকিৎসা শেষ হবে। এই গোটা বিষয়টাকে পরিপূর্ণ করে হ্যালসিয়ন যন্ত্র। প্রযুক্তি আর বিজ্ঞান দুর্দান্ত এক উপায় উপহার দিয়েছে চিকিৎসা শাস্ত্রকে।”