
দ্য ওয়াল ব্যুরো: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঘাঁটলে ‘কিলো ফ্লাইট’ নামটা উঠে আসবে। এটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ বিমান চালানোর সাংকেতিক নাম। কমব্যাট এয়ারক্রাফ্ট তখনও ছিল না। ভারতের থেকে উপহার পাওয়া নন-কমব্যাট এয়ারক্রাফ্ট দিয়ে বিমানবাহিনী বানিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা। সেই এয়ারক্রাফ্টের একটি ছিল অ্যালুয়েট-থ্রি হেলিকপ্টার। চার দিনের বাংলাদেশ সফরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সেই স্মৃতির চিহ্ন অ্যালুয়েট-থ্রি বাংলাদেশের হাতে তুলে দিলেন ভারতের বায়ুসেনাপ্রধান আর কে এস ভাদুরিয়া। পরিবর্তে বাংলাদেশ ভারতকে দিল নর্থ আমেরিকান এফ-৮৬ সাবরে এয়ারক্রাফ্ট। পাকিস্তানি লড়াকু বিমান যা মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহার হয়েছিল।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশতম বছরকে ‘স্বর্ণিম বিজয় দিবস’ হিসেবে পালন করছে ভারত ও বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে কীভাবে দুরমুশ করেছিল ভারতীয় বাহিনী সেই স্মৃতি ফিরিয়ে এনে দুই দেশই একে ওপরকে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত এয়ারক্রাফ্ট উপহার দিয়েছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের যতটা গর্বের, পাকিস্তানের কাছে ততটাই অগৌরবের। পাকিস্তানের কাছে এই যুদ্ধ দু’দিক দিয়ে গ্লানির। প্রথমত এই যুদ্ধে পাকিস্তান ভেঙে দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল, আর দ্বিতীয়ত সে যুদ্ধে ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সেনা। একাত্তরের যুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তান বরাবর মুখে কুলুপ আঁটলেও, বাংলাদেশ বিজয়গর্বে সে স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের গর্বই শুধু নয়, আবেগও।
ভারতের তরফে বাংলাদেশকে উপহার দেওয়া অ্যালুয়েট-থ্রি হেলিকপ্টার সেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিনগুলোকে মনে করিয়ে দেয়। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম ইউনিট তথা কিলো ফ্লাইট তৈরি হয়েছিল ভারতের ডিমাপুরে। ভারতের থেকে উপহার পাওয়া তিনটি নন-কমব্যাট এয়ারক্রাফ্ট অ্যালুয়েট-থ্রি হেলিকপ্টার, অটার ডিএইচসি-৩ ও সিসি-৩ ডাকোটা বিমান নিয়ে তৈরি হয়েছিল কিলো ফ্লাইট ইউনিট। অ্যালুয়েট কপ্টারের ককপিটে ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন আহমেদ এবং ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম। ডিএইচসি-৩ অটার বিমানের পাইলট ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ ও ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন আহমেদ। ডিসি-৩ ডাকোটা বিমানের পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন আব্দুল খালেক, ক্যাপ্টেন আব্দুল মুকিত ও ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার।

তিনটি নন-কমব্যাট এয়ারক্রাফ্টকে যুদ্ধবিমানের চেহারা দেওয়া হয়েছিল সে সময়। এই যুদ্ধবিমানে রূপান্তরের কাজে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করেছিলেন ভারতের বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং। কিলো ফ্লাইট ইউনিটে ৯ জন অফিসার ছিলেন ও ৫৮ জন সেনাকর্মী ছিলেন। অ্যালুয়েট কপ্টার চালিয়েই বাংলাদেশের ভেতরে প্রথম অপারেশন হয়েছিল।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ওপর আচমকা চোরাগোপ্তা পথে হামলা চালানোর জন্য এই কিলো ফ্লাইট ইউনিট ব্যহার করা হয়েছিল সে সময়। এই ইউনিট ভারতীয় বায়ুসেনার বেস জোড়হাট থেকে পরিচালনা করা হত, স্কোয়াড্রন লিডার ছিলেন সুলতান মাহমুদ। একাত্তরের ডিসেম্বরে ৪ থেকে ১৬ তারিখের মধ্যে এই ইউনিটটি মোট ৯০টি অভিযান চালিয়েছিল। কম করেও ৪০টি অপারেশনের পরিকল্পনা করেছিল। জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাক বাহিনীর ঘাঁটি।
অন্যদিকে পাকিস্তানের বায়ুসেনার সংগ্রহে ছিল ১৪টি চিনা মিগ-১৯, আমেরিকার তৈরি এফ-৮৬ সাবরে এয়ারক্রাফ্ট। ঢাকার এয়ারবেসে রাখা হয়েছিল এই যুদ্ধবিমানগুলি। তবে মুক্তিযুদ্ধের আগে পাকিস্তান চিনা মিগ উড়িয়ে নিয়ে গেলেও রয়ে গিয়েছিল সাবরে এয়ারক্রাফ্টগুলি। এই সাবরে ব্যবহার করেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ভারতের বায়ুসেনার কম্যান্ডাররাও।
পাক ঘাঁটিগুলিতে প্রায় ১২৫০ টি বোম ফেলেছিল ভারতের বিমানবাহিনী। ১২ হাজারের বেশি রকেট ছোড়া হয়েছিল। তিন ইউনিট সাবরে ছিল পাকিস্তানের দখলে। ইতিহাস বলে, ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর ভারতীয় আকাশসীমায় ঢুকে পড়ে সাবরেগুলি, তবে ভারতের বায়ুসেনার প্রতিটি পাক এয়ারক্রাফ্ট ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।