আব্দুল মান্নান
উনিশের ভোট এগিয়ে আসছে। অ্যাদ্দিনে চিটফান্ড কাণ্ডে ধরপাকড় শুরু করেছে সিবিআই। ব্যাপারটা কতদূর যায় আমরাও নজর রাখছি। কারণ, চিটফান্ডের নামে বাংলায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দেওয়ার যে চক্রান্ত, তার বিরুদ্ধে আমরাই তো প্রথম থেকে কথা বলছিলাম। কারও নামে ব্যক্তিগত স্তরে অভিযোগ করিনি। শুধু সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িয়ে বলেছি, গরিব খেটে খাওয়া মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা যে লুঠ হল, তার বিচার চাই। যারা এই লুঠ চালিয়েছে, তারা প্রভাবশালী। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টই পারে সুবিচার দিতে।
সর্বোচ্চ আদালতই নির্দেশ দিয়েছিল সেই সমস্ত প্রভাবশালী লোককে চিহ্নিত করতে। আদালতের সেই রায় ঘোষণার পর প্রায় চার বছর কেটে গেছে। এতদিনে সেই প্রক্রিয়া শুরু হল।
আসলে নরেন্দ্র মোদীর সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করা শুরু করেছে। সিবিআইকেও পোষা তোতাপাখির মতো সরকারের শেখানো বুলিই আওড়াতে হয়েছে। উপর থেকে যা বলা হয়েছে এজেন্সি তাই করেছে। নইলে গোড়ায় হই হই করে তদন্তের কাজ শুরু হলেও পরে কেন থমকে গেল? আসলে প্রভাব খাটিয়ে চিটফান্ড কেলেঙ্কারির সব তদন্ত বন্ধ করে রেখেছিল কেন্দ্রের সরকার। পরিবর্তে তারাও পেয়েছে। চোদ্দ সালের শেষ থেকে ষোলো সালের গোড়া পর্যন্ত সংসদে কক্ষ সমন্বয়ে বাকি বিরোধীদের সঙ্গে হাঁটেনি তৃণমূল। কখনও ভোটাভুটিতে অনুপস্থিত থেকে কখনও বা ওয়াক আউট করে সরকারের সুবিধা করে দিয়েছে বারবার। এমনকী লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, রাফায়েল কেলেঙ্কারি নিয়ে রাহুল গান্ধী থেকে শুরু করে বাকি বিরোধীরা যখন সরব, তৃণমূল তখন স্পিকটি নট্। কেন?
কিন্তু এই সরকার তো চিরদিন থাকবে না। কেন্দ্রে বিজেপি-র সরকার তো আগামী নির্বাচনের পর আর ফেরত আসবে না। তখন কী হবে?
ভুলে গেলে চলবে না, জাতীয় কংগ্রেস কিন্তু কখনওই সিবিআইয়ের তদন্তে হস্তক্ষেপ করেনি। অসমে কংগ্রেসেরই মন্ত্রী ছিলেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তাঁকে সিবিআই চিটফান্ড মামলায় জেরা করতে ডেকেছিল। তিনি রাতারাতি বিজেপি-তে চলে গেলেন। চন্দন রায় অসম প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ ছিল। সিবিআই তাঁকেও গ্রেফতার করেছিল। কমনওয়েলথ গেমস দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন মহারাষ্ট্র তথা পুণের তাবড় কংগ্রেস নেতা সুরেশ কালমাডি। তাও কংগ্রেসেরই আমলে। এমনকী পশ্চিমবাংলাতেও সোমেন মিত্রকে জেরা করতে ডেকেছিল সিবিআই।
কংগ্রেসের সেই চিরন্তন অবস্থানের বদল ঘটার প্রশ্ন নেই। আগামী নির্বাচনে কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে কোনওভাবেই সিবিআইয়ের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। তখন অবধারিত ভাবেই দোষীরা ধরা পড়বে।
কিন্তু ওদিকে দেখুন, ধরপাকড় শুরু হওয়া মাত্র আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে তৃণমূল। আমরা কিন্তু সুনির্দিষ্ট ভাবে কারও নামে নির্দিষ্ট করে কোনও অভিযোগ করিনি। শুধু বলেছি, যারা লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষকে ঠকিয়েছে, তাদের টাকা দিয়ে ফূর্তি করেছে, তারা ধরা পড়ুক। কিন্তু ঠাকুর ঘরে কে আমি তো আপেল খাইনির মতো করে ফেললেন তৃণমূলের নেতারা। মিছিল পর্যন্ত বের করে ফেলল!
বাস্তব হল, চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে তৃণমূলের বহু নেতা-মন্ত্রী-সাংসদ গ্রেফতার হয়েছেন। ভয় পেয়ে তাই ওঁরা নরেন্দ্র মোদী সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে আঁতাত করার চেষ্টা করেছিলেন। এখন হাওয়া স্পষ্ট। বিজেপি সরকার আর ফিরছে না। ফলে মওকা বুঝে তৃণমূলও মোদীর বিরুদ্ধে কথা বলছে।
এবং এ ব্যাপারে একটা তাৎপর্যপূর্ণ ফারাক মানুষের চোখে পড়া দরকার। অনেকে ভাবছেন বা বলছেন, তৃণমূল কংগ্রেস এখন বিজেপি বিরোধিতা করছে। কিন্তু সত্যি কথা হল, আসলে মানুষকে কিছুটা বিভ্রান্ত করছেন তৃণমূলনেত্রী। উনি মোটেও বিজেপি-র বিরুদ্ধে নন। উনি শুধু নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে। লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলী মনোহর জোশী, রাজনাথ সিংহ, নিতিন গড়কড়ির মতো বিজেপি-র অন্য বহু নেতার বারবার প্রশংসা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকী আডবাণীকে রাষ্ট্রপতি করার কথাও বলেছিলেন উনি। কাল যদি নরেন্দ্র মোদীর জায়গায় লালকৃষ্ণ আডবাণীকেই ফের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দাঁড় করায় বিজেপি, তা হলে কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনকার মতোই কট্টর ভাবে বিজেপি-র বিরোধিতা করবেন?
কংগ্রেসের নীতি কিন্তু মোটেও এরকম নয়। আমরা কখনও বলিনি মোদী হটাও। আমরা সব সময়েই বলেছি, বিজেপি হটাও।
তৃণমূলনেত্রীর অবস্থা শেষ পর্যন্ত হবে সিপিএমের প্রকাশ কারাটের মতো। ষাট-পঁয়ষট্টি জন সাংসদ নিয়ে প্রকাশ কারাট ভেবে বসেছিলেন কংগ্রেস ওঁর উপর নির্ভরশীল। উনি তাই কংগ্রেসের সঙ্গে দর কষাকষি করতে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন নরম মাটি! অথচ কংগ্রেস এখন ফের কেন্দ্রে সরকার গড়ার মতো পরিস্থিতির দিকে পৌঁছতে চলেছে। আর প্রকাশ কারাটের পার্টিটাই উঠে যেতে বসেছে। আজ মমতাও কংগ্রেসকে উপেক্ষা করার কথা ভাবছেন। ভাবছেন, উনি নিজেই প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু উনি যাই ভাবুন, ওঁর ক্ষেত্রেও সেই প্রকাশ কারাটের মতো ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হবে।
দলবদল
কংগ্রেস ছেড়ে কদিন আগেই তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন কংগ্রেস নেতা বরকত গণি খান চৌধুরীর পরিবারের মেয়ে মৌসম বেনজির নূর। এতে তৃণমূলের অনেকেই উল্লসিত। কিন্তু তাঁরা একটা কথা ভেবে দেখছেন না, একটা দল ছেড়ে অন্য দলে যোগ দিলে কেউ কিন্তু তাঁর পুরনো দলের কোনও ক্ষতি করতে পারে না। এই তো তৃণমূলেরই বেশ কয়েকজন সাংসদ দল ছেড়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ অন্য দলেও যোগ দিয়েছেন। এক সময়ে তৃণমূলেরই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা মুকুল রায় এখন বিজেপিতে। কদিন আগেই বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খান বিজেপিতে চলে গেছেন। তাতে কি তৃণমূল দলের কোনও ক্ষতি হয়েছে? কোনও ক্ষতি হয়নি। বরং সাধারণ মানুষ এই দলবদলু নেতা নেত্রীদের ঘৃণা করেন। শেষ অবধি এই দলবদল করা নেতারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে চলে যায়।
মুকুল রায়ের কথাই যদি ধরি। তৃণমূল ছেড়ে আবার এক সময় সেই দলেই ফিরে এসেছিলেন তিনি। তার পর আবার বিজেপিতে চলে গেলেন। সেখানেও যে তিনি বিরাট জায়গা করে ফেলেছেন এমন নয়। আবার তৃণমূলে ফিরে আসার উপায়ও নেই। তাই, আজকে দল ভাঙিয়ে যাঁরা উল্লসিত হচ্ছেন, তাঁদের সাময়িক উল্লাস সরিয়ে আয়নায় নিজেদের মুখ দেখা উচিত। তৃণমূলে ছেড়ে যাঁরা বিজেপি গিয়েছেন, তাঁরাই কি আদৌ কোনও জায়গা করতে পেরেছেন? নাকি কংগ্রেস ছেড়ে যাঁরা হালফিলে তৃণমূলে গেছেন, তাঁরা কোনও মর্যাদা পাচ্ছেন? তাই এই দলবদলে কংগ্রেসের কোনও ক্ষতি হবে না। কংগ্রেস একটা জাতীয় দল। কোনও ব্যক্তি বা স্বঘোষিত নেতার ওপর নির্ভরশীল নয়।
তবে ব্যাপারটা শুধু এটুকুতেও সীমাবদ্ধ নয়। রাজনৈতিক দিক থেকেও অর্থবহ। এই দল ভাঙানোর মধ্যে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিচারিতাও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মুখে উনি মোদীর বিরোধিতা করছেন, আর অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ক্ষতি করে, বিজেপি-কেই পরোক্ষে সাহায্য করছেন। তা ছাড়া এটা ওঁর স্বৈরাচারী মানসিকতার পরিচয় দেয়। মোদী যেমন কংগ্রেস মুক্ত ভারতের কথা বলেন, তেমনই মমতা বলেন, বিরোধী মুক্ত বাংলা। মানে গণতান্ত্রিক পরিবেশকে মোদী-মমতা দু’জনেই ভয় পান।
ব্রিগেড ও প্রধানমন্ত্রীর পদ
দেশ জুড়ে বিজেপি বিরোধী হাওয়া চলেছে। মমতার বিরোধিতা অবশ্য মোদীর বিরুদ্ধে। সে যাক ব্রিগেডে তিনি লোক দেখানো সভা করলেন। এক গাদা লোক জড়ো করলেন সেখানে। মমতার ওই ব্রিগেডে কংগ্রেস হাইকম্যান্ডও মল্লিকার্জুন খার্গেকে প্রতিনিধি হিসাবে পাঠিয়েছিল। কারণ, কংগ্রেস সত্যিই বিজেপি বিরোধিতায় আন্তরিক। সেখান সংকীর্ণ স্বার্থ দেখে না।
কিন্তু প্রশ্ন হল, যাঁরা সেদিন তৃণমূলের ব্রিগেডে এলেন, তাঁরা কেউ তৃণমূলের সঙ্গে জোটের কথা বললেন কি? কেউ মমতার নেতৃত্বের কথা মানলেন? না। স্ট্যালিন, তেজস্বী, ওমর আবদুল্লাহ,- সবাই ফিরে গিয়েই রাহুলের নেতৃত্বের কথা বললেন। আমি এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারি তৃণমূলের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসের কোনও জোট হবে না।
মমতা বলছেন উনি সামনের লোকসভা ভোটে রাজ্যের বিয়াল্লিশটা আসনের মধ্যে বিয়াল্লিশটাতেই জিতবেন। ওঁর দলেরই বাকিরা বলছেন যে বিয়াল্লিশটা সিট নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু কেন্দ্রে সরকার গড়তে গেলে তো বিয়াল্লিশ নয়, দুশো তিয়াত্তরটা আসন চাই। নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতাও চাই। ভারতবর্ষের বর্তমান যা রাজনৈতিক পরিস্থিতি যা, তাতে কংগ্রেস বা বিজেপির মতো সর্বভারতীয় দলকে বাদ দিয়ে আদৌ কি কোনও মহাজোট হতে পারে? কংগ্রেসকে বাদ দিলে সারা দেশে মেরে কেটে দুশোটা আসনেও কোনও মহাজোট প্রার্থী দিতে পারবে না। সেই দুশো আসনে জিতে কি কেন্দ্রে সরকার গড়া যাবে?
সুতরাং মমতা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, ভাল কথা! কিন্তু এই স্বপ্ন কোনওদিন বাস্তবের মাটি ছোঁবে না।