
করোনা পরবর্তী সময়ে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অভ্যাস গড়তে হবে মানুষকেই
করোনাভাইরাস নিয়ে মানুষ যে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে তার থেকে নতুন করে শিক্ষা নেওয়ার সময় এসেছে। লকডাউন, সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং-এর মতো শব্দ মানুষের রোজকার অভিধানে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে।
সঞ্জীব আচার্য
কর্ণধার সিরাম অ্যানালিসিস
জানুয়ারির শুরুতেও বিপদটা আঁচ করা যায়নি। তারপর যেন একটা ঝড়ের ঝাপটা এল। এক লহমায় তোলপাড় করে দিল সবকিছু। বদলে গেল আমাদের চেনা পৃথিবীটাই। চারদিকে শুধু মৃত্যুর আতঙ্ক। এমন এক ভাইরাস যা মানুষের থেকেই মানুষকে সরিয়ে দিল কয়েক যোজন দূরে। সাহায্যের হাত ধরার বদলে পারস্পরিক দূরত্ববিধিই সুরক্ষার একমাত্র উপায় হিসেবে ধার্য হল। পৃথিবী এখন যেন দুটো যুগে ভাগ হয়ে গেছে। করোনা-পূর্ব এবং করোনা-পরবর্তী যুগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) জানিয়ে দিয়েছে, এমন মারণ ভাইরাসের শক্তি কমলেও তাকে পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়। কাজেই ভাইরাসকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলা, বেঁচে থাকা শিখে নিতে হবে মানব সমাজকে। ভবিষ্যত সাজাতে হবে এক অজানা বিপদকে সঙ্গে করেই।
স্প্যানিশ ফ্লুয়ের মতো মহামারীর বিভীষিকা, মন্বন্তর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, উদ্বাস্তু মানুষের হাহাকার, পৃথিবী সাক্ষী থেকেছে অনেক ঘটনারই। তবে করোনাভাইরাস নিয়ে মানুষ যে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে তার থেকে নতুন করে শিক্ষা নেওয়ার সময় এসেছে। লকডাউন, সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং-এর মতো শব্দ মানুষের রোজকার অভিধানে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে। এখন কাছাকাছি নয়, বরং দূরে দূরেই থাকাই শিখে নিতে হবে মানুষকে। রাস্তাঘাটে, বাসে-ট্রামে মুখ ঢেকে রাখতে হবে মুখোশে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে যে মৃত্যুমিছিল দেখেছে বিশ্ব সেই বিপর্যস্ত, দিশাহারা সময় পেরিয়ে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে হলে একতা ও সংহতির পথে চলাও শিখে নিতে হবে ভবিষ্যত প্রজন্মকে।
করোনা নিয়ে তর্জা
ভাইরাস ছড়িয়েছে কোথা থেকে সেই নিয়ে তর্ক-বিতর্কের অবসান হয়নি। গত বছর ডিসেম্বরে উহান থেকে যখন প্রথম এমন সংক্রামক ভাইরাস ছড়াবার খবর আসে, তখন সেই ভাইরাসের মারণ রূপ সম্পর্কে ধারণা ছিল না কোনও দেশেরই। কোনও দেশ আগে, আবার কোনও দেশ পরে এই ভাইরাসকে ঠেকাবার উপযুক্ত বিধিব্যবস্থা গড়ে তোলে। তবে ততদিনে দেরি হয়ে যায় অনেক। বাড়তে থাকে মৃত্যু, হাহাকার। আমেরিকা চোখ রাঙিয়ে অভিযোগের আঙুল তোলে সরাসরি চিনের দিকেই। দাবি করে, রাসায়নিক মারণাস্ত্র তৈরি করতে গিয়ে চিনই গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে এমন ভাইরাস। অন্যদিকে চিন দাবি করে, মার্কিন খেলোয়াড়দের থেকেই এমন সংক্রামক ভাইরাস ছড়িয়েছে উহানে। কাজেই আমেরিকাই ভাইরাস বয়ে নিয়ে গেছে চিনে। শুরু হয়ে যায় বিবাদ, তর্ক-বিতর্ক, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, এই ভাইরাস রাসায়নিক মারণাস্ত্র নয়। কারণ যেভাবে প্রতি মুহূর্তে ভাইরাসের মধ্যে জিনের বদল ঘটে চলেছে, তাতে স্পষ্ট এই ভাইরাসকে তৈরি করা হয়নি, বরং এর স্বাভাবিক প্রাকৃতিক উৎস আছে। হু-এর বক্তব্য নিয়ে ফের শুরু হয়ে যায় তর্জা। অভিযোগ ওঠে, চিন ভাইরাস সংক্রমণের কথা লুকিয়ে গোটা বিশ্বকে বোকা বানিয়েছে এবং তাদের এই অভিসন্ধিতে সায় দিয়েছে হু। করোনা নামক মহামারীর উৎপত্তি কীভাবে হল সেই নিয়ে তর্ক-বিতর্কের অবসান এখনও হয়নি, তবে হু পষ্টাপষ্টি জানিয়ে দিয়েছে, সঙ্কটের এই পরিস্থিতিতে পারস্পরিক বিবাদ জটিলতা আর বাড়াবে। করোনাকে সঙ্গে নিয়েই যেহেতু বাঁচতে হবে, তাই সংহতির পথে চলাই শ্রেয়।
বদলে যাবে সমাজ, বেঁচে থাকার অভ্যাস শিখতে হবে মানুষকে
করোনাভাইরাসের অতিমহামারী এবং লকডাউন। এই দুইয়ের ধাক্কায় পুরোপুরি বেসামাল হয়ে পড়ছে বিশ্ব অর্থনীতি। বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও আইএমএফের মতো সংস্থা একবাক্যে বলছে, অর্থনৈতিক বিপর্যয় হয়তো কয়েক বছর বাদে কাটিয়ে উঠবে গোটা পৃথিবী। অতিমহামারীর পরেই আসছে আর্থিক মন্দা। তাতে বহু লোকের কাজ হারানোর সম্ভাবনা। এর ফলে বাজারে চাহিদা কমবে। মন্দার ছায়া দীর্ঘতর হবে তাতে। লকডাউনের ভয়ানক প্রভাব এখনই দেখা গেছে। লক্ষ লক্ষ কাজ হারানো উদ্বাস্তু মানুষের ঢল নেমেছে রাস্তায়। দুমুঠো খাবারের জন্য রাস্তায় পড়ে ধুঁকতে ধুঁকতে প্রাণ গেছে কত শত মানুষের। অর্থনৈতিক বিপর্যয় হয়তো কয়েক বছর বাদে কাটিয়ে উঠবে গোটা পৃথিবী। কিন্তু এই দুঃসময় মানুষের মননে, চিন্তনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যাবে। বিপর্যয় পরবর্তী সময়ে আমাদের দুটো পথ খোলা আছে। প্রথমত, যেখানে আমাদের জীবন থমকে গিয়েছিল, সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে এগিয়ে চলার পথ তৈরি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, এই দুঃসময় থেকে আমরা খুঁজে পেতে পারি এক নতুন বোধ, এক নতুন উপলব্ধি। মানুষকে শিখতে হবে মিতব্যয়িতা, শুধু নিজেকে নিয়ে নয় পারিপার্শ্বিক জগৎ, প্রকৃতি, বাস্তুতন্ত্র—গুরুত্ব দিতে হবে সবকিছুকেই। কারণ এই সব কিছুর ভারসাম্যই টিকিয়ে রেখেছে মানুষের অস্তিত্ব।
আয়নার মুখোমুখি মানব সভ্যতা, সংশোধনের সময় এখনই
করোনা বিপর্যয়ের একটা বড় আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে গোটা মানবজাতিকে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী মানুষই। বাস্তুতন্ত্র ও জীবজগতের অস্তিত্বকে মানুষ কোনওদিনই গুরুত্ব দিয়ে বোঝেনি। তাই প্রকৃতির এক নির্মম রূপের মুখোমুখি হতে হয়েছে মানব সভ্যতাকে। যার ভয়ঙ্কর পরিণতি মৃত্যু। করোনা মহামারী শিখিয়েছে সংশোধনের সময় এটাই। প্রকৃতির ভারসাম্য রাখতে না পারলে, নিজেদের অস্তিত্বের ভারসাম্যও টালমাটাল হবে। শুধু পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নয়, দৈনন্দিন অভ্যাসেও সংশোধনটা এখনই দরকার। পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যবিধির যে নিয়ম শিকেয় উঠেছিল, সেটাই আবার ফিরিয়ে আনার সময় এসেছে। নিজেকে শুধু নয়, নিজের চারপাশকে পরিচ্ছন্ন রাখতে না পারলে, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার রাস্তাটাও হয়ত একদিন বন্ধ হয়ে যাবে। করোনাকে ঘিরে এই পরিস্থিতি তাই নতুন করে শিখিয়ে দিয়েছে, আগামীতে ভাল ও সুস্থ থাকার নিশ্চয়তা ঠিক করতে হবে নিজেদেরই। এই অভ্যাস হাড়ে-মজ্জায় মিশে না গেলে, ভবিষ্যতে আরও বড় বিপদের মুখোমুখি হতে হবে মানব সভ্যতাকে