
ফুসফুসে রক্ত জমাট বেঁধেও কি মৃত্যু হচ্ছে করোনা রোগীর, কেন হচ্ছে তীব্র শ্বাসকষ্ট, ব্যাখ্যা করলেন বিশেষজ্ঞ
গবেষকরা বলছেন, ফুসফুস শুধু নয়, রক্ত জমাট বাঁধছে মস্তিষ্কে, হৃদপিণ্ডে, কিডনিতে। শরীরের যেসব অঙ্গে সংক্রমণ বেশি ছড়াচ্ছে, সেখানেই রক্ত জমাট বাঁধতে দেখা যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে রক্ত জমাট বাঁধছে কেন? তার অনেকরকম কারণ হতে পারে।
সঞ্জীব আচার্য
কর্ণধার সিরাম অ্যানালিসিস
করোনা সংক্রমণের সবচেয়ে মারাত্মক উপসর্গ যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তাহলে বিজ্ঞানীরা একবাক্যেই বলবেন রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া বা ব্লাড ক্লট (Blood Clot)। ভাইরাস সংক্রমণের সঙ্গে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার সরাসরি সম্পর্ক আছে কিনা সে নিয়ে বিজ্ঞানীমহলে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে। তবে করোনা রোগীদের শারীরিক পর্যবেক্ষণ করে অধিকাংশ ডাক্তার ও গবেষকেরই দাবি, সংক্রামিত রোগীর শরীরে নানা অঙ্গে রক্ত জমাট বাঁধতে দেখা গেছে। বিশেষত ফুসফুসে এমনভাবে ব্লাড ক্লট হচ্ছে যে রোগীর শ্বাসের প্রক্রিয়াও ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফুসফুসে রক্ত জমাট বেঁধে রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যাচ্ছে।
গবেষকরা বলছেন, ফুসফুস শুধু নয়, রক্ত জমাট বাঁধছে মস্তিষ্কে, হৃদপিণ্ডে, কিডনিতে। শরীরের যেসব অঙ্গে সংক্রমণ বেশি ছড়াচ্ছে, সেখানেই রক্ত জমাট বাঁধতে দেখা যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে রক্ত জমাট বাঁধছে কেন? তার অনেকরকম কারণ হতে পারে।
আক্রান্ত হচ্ছে এপিথেলিয়াল কোষ, অক্সিজেন সরবরাহ কমছে ফুসফুসে
করোনাভাইরাসের সংক্রামক আরএনএ ভাইরাল স্ট্রেন মূলত নাক, মুখ বা গলার মাধ্যমেই শরীরে প্রবেশ করে। নাক বা গলার গবলেট কোষকে টার্গেট করে করোনা। কারণ এই কোষের মধ্যেই তাদের ‘বন্ধু’ রিসেপটর প্রোটিন ACE-2 থাকে। এই প্রোটিনের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে শ্বাসনালীর মাধ্যমে সোজা ফুসফুসে চলে আসে ভাইরাস। এটাই তার বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা। আবার এখানেই সে নিশ্চিন্তে তার প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। ফুসফুস যদি দুর্বল হয় (তার নানা কারণ, অধিক ধূমপান, শ্বাসজনিত রোগ, ফুসফুসের কোনও সংক্রামক ব্যধি) তাহলে ধীরে ধীরে গোটা ফুসফুসকেই সংক্রামিত করে ফেলতে পারে এই ভাইরাস।
এখন ফুসফুসে পৌঁছে ভাইরাসের প্রথম কাজ হল কোষের ভেতরে ঢুকে পড়া। তার জন্য ভাইরাসের দরকার বাহক কোষে অর্থাৎ এক্ষেত্রে মানুষের দেহকোষের বিশেষ প্রোটিন যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে রিসেপটর প্রোটিন। ফুসফুসের কোষেও থাকে ভাইরাসের সেই বন্ধু প্রোটিন তথা ACE2 (অ্যাঞ্জিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২)। এর সাহায্যে ফুসফুসের কোষে ঢুকে বিভাজিত হয়ে সংখ্যায় বাড়তে থাকে ভাইরাস। এমনভাবে সংক্রামিত হয় ফুসফুস যে শ্বাসনালীর মাধ্যমে অক্সিজেন ঢোকার রাস্তাটাই বন্ধ হয়ে যায়। সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম দেখা দেয়। শ্বাসের সমস্যা, শুকনো কাশি এমনকি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয় রোগী। অক্সিজেন সরবরাহ কমে গেলে রক্তের স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে, পালমোনারি থ্রম্বোসিসে (Pulmonary Thrombosis)আক্রান্ত হয় রোগী।
![]()
ফুসফুসে রক্ত জমাট বেঁধে তীব্র প্রদাহ তৈরি হয়
ফুসফুসে কব্জা করে মানুষের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর প্রথম জোর ধাক্কা দেয় ভাইরাস। ফুসফুসে প্রদাহ তৈরি করে অর্থাৎ জ্বালাপোড়া শুরু হয় ফুসফুসে। তীব্র শ্বাসকষ্টে ছটফট করেন রোগী। তীব্র প্রদাহের আরও একটা কারণ হল সাইটোকাইন স্টর্ম (Cytokine Storm)। এই সাইটোকাইন প্রোটিন দেহের কোষে কোষে সিগন্যাল পৌঁছে দেয়। যদি দেখা যায়, এই প্রোটিনের ক্ষরণ বেড়ে গেছে তাহলে ক্ষতি হয় কোষেরই। ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। সার্স-কভ-২ ভাইরাল প্রোটিন শরীরে ঢুকলে এই সাইটোকাইন প্রোটিনের নিঃসরণ বেড়ে যাচ্ছে বলেই জানিয়েছেন ডাক্তাররা। সেই কারণে তীব্র প্রদাহজনিত রোগে ভুগছে রোগী। অ্যাকিউট রেসপিরেটারি ডিসট্রেস সিন্ড্রোমে (ARDS) আক্রান্ত হচ্ছে।
আরও একটা বিষয় পর্যবেক্ষণ করেছেন ডাক্তাররা, সেটা হল ভাইরাস ফুসফুসের এন্ডোথেলিয়াল কোষের (Endothelial Cells)মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। যার কারণে ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাচ্ছে। রক্ত জমাট বাঁধছে। ‘সাইলেন্ট নিউমোনিয়া’, ‘সাইলেন্ট হাইপোক্সিয়া’ আক্রান্ত হচ্ছে রোগী। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কতটা কমছে সেটা পরিমাপ করা যায় পালস অক্সিমিটার (Pulse Oxymeter)যন্ত্রে। যদি দেখা যায় অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল ৯৫% তাহলে সেটা স্বাভাবিক, যদি এর চেয়ে কমতে থাকে তাহলে বিপদের কারণ রয়েছে। সেক্ষেত্রে অনেক সময়েই ফুসফুসের অবস্থা, ব্লাড ক্লট হয়ে অক্সিজেন সরবরাহ কমে গেছে কিনা পরীক্ষা করে ডাক্তাররা ব্লাড থিনার দিয়ে থেরাপি শুরু করেন। কম ডোজের হেপারিন (LMWH)দিয়ে চিকিৎসা শুরু হয়।

ভাইরাসের সংক্রমণে রক্ত জমাট বাঁধছে, প্রথম বলেছিলেন আয়ারল্যান্ড, নিউ ইয়র্কের বিজ্ঞানীরা
আয়ারল্যান্ডের রয়্যাল কলেজ অব সার্জেনস ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রথম উঠে এসেছিল এই রক্ত জমাট বাঁধার তথ্য। ‘ব্রিটিশ জার্নাল অব হেমাটোলজি’তে এই গবেষণার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। এই ইউনিভার্সিটির অধীনস্থ আইরিশ সেন্টার অব ভাস্কুলার বায়োলজির গবেষকরা বলেছিলেন, ভাইরাসের সংক্রমণে শরীরে তাপমাত্রা হঠাৎই বেড়ে যায়। সর্দি-শুকনো কাশি, হাঁচি থেকে জ্বর আবার কখনও রোগীর নিউমোনিয়াও ধরা পড়ে। সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হতেও দেখা গেছে রোগীকে। সেই সঙ্গে কিছু রোগীর মধ্যে নতুন উপসর্গ দেখা গেছে যার মধ্যে একটি ব্লাড ক্লট। গবেষকরা বলেছিলেন, ফুসফুসে ‘মাইক্রো-ক্লট’ হচ্ছে, যার কারণে দেখা গেছে সংক্রমণের কিছুদিনের মধ্যেই রোগীর ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। ফলে অক্সিজেন আর ফুসফুসে ঢুকতে পারছে না, যার কারণে তীব্র শ্বাসকষ্টে কিছুদিনের মধ্যেই রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।
আয়ারল্যান্ডের গবেষকদের মতোই এই ব্লাড-ক্লটের তথ্য সামনে এনেছেন নিউ ইয়র্কের বিজ্ঞানীরাও। মাউন্ট সিনাইয়ের নেফ্রোলজিস্টরা বলেছিলেন, করোনা পজিটিভ রোগীর কিডনি ডায়ালিসিস করতে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানেও ব্লাট ক্লট হয়ে রয়েছে। এমনকি হার্টেও রক্ত জমাট বেঁধে হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন করোনা রোগী। প্রবীণরা শুধু নয়, তরুণদের মধ্যেও দেখা গেছে এই উপসর্গ।