
সবুজ আলোতে কমবে মাথার দপদপানি! মাইগ্রেনের ব্যথা সারানোর থেরাপি আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের
দ্য ওয়াল ব্যুরো: সকালে ঘুম থেকে উঠেই অসহ্য মাথার যন্ত্রণা। যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে মাথার একদিক। সে সঙ্গেই বমি বমি ভাব। শরীর কাহিল। মেজাজ যেন তুঙ্গে। এ দিকে সারাদিনে প্রচুর জমা কাজ। এ সমস্যা কি প্রায়ই হয় আপনার? মাথার একদিকে বাঁ দিক বা ডান দিকে ব্যথা, যাকে বলে ‘আধ কপালি’, ডাক্তাররা বলেন মাইগ্রেন। ডিহাইড্রেশন, অতিরিক্ত রোদ লাগা, ক্লান্তি, হ্যাংওভার, হজমের সমস্যা, স্ট্রেস, যে কোনও কারণেই হতে পারে মাইগ্রেন অ্যাটাক। এর থেকে বাঁচতে নানা টোটকা হাতড়ে, ওষুধ খেয়েও কাজ হয় না অনেক সময়। গবেষকরা বলছেন, মাইগ্রেনের ব্যথা কমানোর বা যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার একটা উপায় আছে—‘গ্রিন লাইট থেরাপি’।
সবুজ আলোতে সারবে মাইগ্রেন? পুরোপুরি সারবে কিনা তা নিশ্চিত করে বলেননি গবেষকরা। তবে সবুজ আলো মাইগ্রেনের একটানা তীব্র যন্ত্রণা থেকে রেহাই দেবে এটা নিশ্চিত। মাথার ভেতর তুমুল দপদপানি কমবে অনেকটাই। সেই সঙ্গে কমবে স্ট্রেস। মন ও মাথায় চিন্তাভাবনার জালগুলো জট পাকিয়ে যে অসহ্য যন্ত্রণা তৈরি করে তার থেকেও সাময়িক মুক্তি পাওয়া যাবে।
![Image result for Green light therapy shown to reduce migraine frequency]()
যুদ্ধ চলছে মাথার ভেতর, দপদপ করছে শিরা
মাইগ্রেন হয়েছে বলে এখন অনেকের মুখেই শোনা যায়। তবে সেটা কী তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন থাকতে পারে। আসলে, মাইগ্রেন এক ধরনের মাথা ব্যথা। কপালের একদিকে ব্যথা হয়। মাথার ডান দিকে বা বাঁ দিকের অর্ধেক অংশে ব্যথা হতে পারে। একবার ব্যথা শুরু হলে মনে হয় যেন মাথার ভেতরে একশো হাতুড়ির ঘা বসাচ্ছে কেউ। চোখের সামনে দুলে ওঠে সব। অনেকের মাথা ঘোড়া শুরু হয়, বমি বমি ভাব থাকে। মাইগ্রেন থেকে চোখের ব্যথাও হতে পারে।
মাইগ্রেন মোটেও মামুলি মাথাব্যথা নয়, যা একবার হল আর সেরে গেল। এ ব্যথা আজীবন সঙ্গী হতে পারে। আচমকাই এর আগমন ঘটে, বিশ্ব-সংসার দুলিয়ে দিয়ে চলে যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘প্রাইমারি হেডেক ডিসঅর্ডার’ । একটানা ৪ ঘণ্টা থেকে ৭২ ঘণ্টা অবধি থাকতে পারে মাথাব্যথা। সিঁড়ি ভাঙতে গেলে মাথা ব্যথা হয়, কাজকর্ম করতে গেলে মনে হয় মাথার ভেতর শিরাগুলো দপদপ করছে।
গবেষকরা বলেন, মাইগ্রেনের ব্যথা দুরকম হতে পারে–‘মাইগ্রেন উইথ অরা’ এবং ‘মাইগ্রেন উইদাউট অরা’। লক্ষণ থেকে বোঝা যায় ব্যথা কোন পর্যায়ে রয়েছে। যেমন কারও চোখের সামনে নানা আলো ঘুরতে থাকে, অনেক সময় সাদা-কালো আলোর রেখা চলে যেতে দেখা যায়। বেশিরভাগ রোগীরই এমন লক্ষণ দেখা যায়। এটা রোগের প্রাথমিক ধাপ। পরের পর্যায়ে তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয় মাথায়। সারা মাথা জুড়ে ব্যথা হতে থাকে।
মাইগ্রেন কি জেনেটিক?
ডাক্তাররা বলেন, মাইগ্রেনের কারণ অনেক। এই রোগ মূলত জেনেটিক। বংশগতভাবে হতে পারে। পরিবারের কারও মাইগ্রেন থাকলে পরের প্রজন্মের মধ্যে রোগ ছড়াতে পারে।
কারণ আরও আছে। মাইগ্রেনের কারণ স্নায়বিক উত্তেজনা। মস্তিষ্কের ট্রাইজেমিনাল নার্ভ উত্তেজিত হলে প্রদাহ বা ইনফ্ল্যামেশন শুরু হয়, যার কারণেই তীব্র মাথাব্যথা হতে থাকে। সেরেটোনিন নামক রাসায়নিকের ভারসাম্য বিগড়ে গেলেও মাইগ্রেনের ব্যথা হয়। হরমোনঘটিত কারণও আছে।
মহিলারা বেশি ভোগেন মাইগ্রেনে!
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইস্ট্রোজেন হরমোনের সঙ্গে এই মাইগ্রেনের ব্যথার একটা যোগসূত্র আছে। তাই সাধারণত মহিলারাই এই সমস্যায় বেশি জেরবার। বয়ঃসন্ধিতে ঋতুস্রাবের সময় অনেকেরই মাইগ্রেনের সমস্যা শুরু হতে দেখা যায়, আবার মেনোপজের পরে মাইগ্রেন সেরে গেছে এমন উদাহরণও আছে।
যৌন সমস্যার জন্য যে সমস্ত ওষুধ খেতে হয় তা থেকে অনেক সময় মাইগ্রেন হতে পারে। গর্ভনিরোধক পিল দীর্ঘদিন খেলে তা থেকেও মাইগ্রেনের ব্যথা হতে পারে। আসলে ওই সমস্ত ওষুধগুলো শরীরে রাসায়নিকের ভারসাম্য বিগড়ে দেয়, যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে মস্তিষ্কে। আবার মহিলাদের জরায়ুতে অস্ত্রোপচার হলে, অনেক সময় হরমোন থেরাপির কিছু ওষুধ দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রেও তাঁদের মাইগ্রেনের সমস্যা নতুন করে দেখা দেয়। আবার পর্যাপ্ত ঘুম বা বিশ্রাম না হলেও মাইগ্রেনের ব্যথা চাগাড় দিতে পারে।
মাইগ্রেনের ব্যথা কমাতে সবুজ আলোর থেরাপি
অ্যারিজোনা হেলথ সায়েন্স ইউনিভার্সিটির গবেষকরা বলছেন, যে কোনও আলোই মস্তিষ্কে ইলকট্রিকাল সিগন্যাল পাঠায়। এই সিগন্যাল রেটিনা ও মস্তিষ্কের কর্টেক্সে পৌঁছয়। লাল ও নীল আলো বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সিগন্যাল পাঠায়। তাই তীব্র লাল বা নীল আলো চোখে পড়লে অস্বস্তি হয়। কিন্তু সবুজ আলো কম দৈর্ঘ্যের সিগন্যাল পাঠায়। এই আলো অনেক বেশি নরম এবং রেটিনার ক্ষতি করে না। সাধারণত এলইডি বা ল্যাম্পের হাল্কা সবুজ আলোতে চোখের আরাম হয়। তবে তীব্র বা বেশি পাওয়ারের সবুজ আলো মোটেই উপকারি নয়। তীব্র বা চড়া আলোয় চোখের ব্যথা হয়, মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়, একে ফোটোফোবিয়া বলে।
গবেষকরা বলছেন, নিভু নিভু সবুজ আলোতে মস্তিষ্কের কোষগুলোর অনেক রিলিফ হয়। বিশেষত ব্যথার জন্য দায়ী যে কোষগুলো সেগুলোর উদ্দীপনা কমে। ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহ কমতে থাকে। ফলে মাথার ব্যথা ধীরে ধীরে কমে যায়।
২০১৬ সালে এই ব্যাপারে একটি গবেষণাপত্র সামনে এসেছিল। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলেছিলেন, সবুজ আলোতে প্রায় ৮০ শতাংশ মাইগ্রেনের ব্যথা কমতে দেখা গিয়েছে। ২০১৭ সালেও এমনই একটি গবেষণার খবর সামনে এনেছিলেন বিজ্ঞানীরা। ইঁদুরের নিউরোপ্যাথিক ব্যথা কমানো হয়েছিল গ্রিন লাইট থেরাপি করে। ইধুঁরদের তিনটি দলে ভাগ করে একটি দলকে সবুজ এলইডি আলোয় রাখা হয়েছিল। অন্য দলটিকে ঘরের সাধারণ আলোয় রেখে এমন লেন্স পরানো হয়েছিল যাতে সবুজ আলোর রশ্মি চোখ ও মাথার ভেতর প্রবেশ করে। তৃতীয় দলটিকে এমন লেন্স পরানো হয়েছিল যাতে সবুজ আলো চোখে পড়তে না পারে।
দিনকয়েক বাদে দেখা যায়, প্রথম দুটি দলের ইঁদুরদের নিউরোপ্যাথিক পেন কমের দিকে। স্নায়ুর উত্তেজনাও কম। কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
গবেষকরা বলছেন, মনে করা হচ্ছে সবুজ আলোয় মস্তিষ্কের ভেতরে ব্যথানাশক রাসায়নিকের ক্ষরণ হয়। যে কারণেই স্নায়ুর উত্তেজনা ও প্রদাহও কমতে থাকে। কী ধরনের রাসায়নিকের ক্ষরণ হয় তার খোঁজ এখনও পাননি বিজ্ঞানীরা। সে বিষয়ে গবেষণা চলছে।