
টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঘায়ে নাস্তানাবুদ! রোগ বশে রাখার উপায় কিন্তু আপনারই হাতে
সঞ্জীব আচার্য
কর্ণধার সিরাম অ্যানালিসিস
চুপিসাড়ে আসে। নীরবে বাড়ে। তারপর একেবারে ফণা তুলে ছোবল বসায়। ডায়াবেটিস অতি ভয়ঙ্কর। টাইপ ২ আরও। এর ঘায়ে ঘায়েল প্রাপ্তবয়স্করাই। পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে। এই রোগকে তো সাইলেন্ট প্রোগ্রেসিভ ডিসঅর্ডারও বলেন ডাক্তারবাবুরা।
ডায়াবেটিস নীরবেই আসে, এবং শরীর-স্বাস্থ্যকে তছনছ করে চলে যায়। তাই ডায়াবেটিস মানেই ত্রাস। জীবন থেকে এক ধাক্কায় অনেক কিছু বাদ চলে যাওয়া। ভাবার বিষয় হল, ডায়াবেটিস ক্রমেই তার শিকড় ছড়াচ্ছে বিশ্বে। ভারতে কম করেও ৬ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসের শিকার। সমীক্ষা বলছে, সাত কোটিরও বেশি প্রি-ডায়াবেটিক। আর টাইপ ২ ডায়েবিটস ক্রমেই তার ডালপালা ছড়াচ্ছে। নিদেনপক্ষে ৯০-৯৫ শতাংশ পুরুষ ও মহিলা এই অসুখে ভুগছেন। মধ্যবয়স্করা তো আরও।
একটু সাবধানতা অবলম্বন করলে ও উপসর্গ দেখা দিলেই সচেতন হলেই বশে রাখা যায় এই সাইলেন্ট কিলারকে।এটি আক্রমণের আগে নানা ভাবে জানান দেয় শরীরে। তখনই সাবধান হলে অনেকাংশেই ঠেকিয়ে রাখা যায় বিপদ।
কী থেকে হয় টাইপ ২ ডায়াবেটিস?
ডায়াবেটিস এমন একটা রোগ যেখানে রক্তে শর্করা বা সুগারের মাত্রা বেড়ে যায়। এই অতিরিক্ত শর্করাকে নিয়ন্ত্রণ করে ইনসুলিন নামে একটি হরমোন যা প্যানক্রিয়াসের বিটা সেল থেকে নিঃসৃত হয়। সাধারণত, ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার খেলে সেটি লিভারে গিয়ে গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়। ইসুলিন এই গ্লুকোজকে দেহকোষের মধ্যে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। কোষের ভেতরে গ্লুকোজ অক্সিডাইজড হয়ে অ্যাডিনোসিন ট্রাই ফসফেট (এটিপি) তৈরি করে যার থেকে শক্তি আসে। এই শক্তিই কোষের পুষ্টি জোগায়।
কিন্তু যদি বিটা কোষ নষ্ট হয়ে যায় এবং ইনসুলিন হরমোনের ক্ষরণ কমে যায় তাহলে এই পক্রিয়াটা বাধা পায়। ইনসুলিন কোষের মধ্যে প্রবেশের জন্য যে রিসেপ্টরটি লাগে, সেটি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ইনসুলিন আর ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। ইনসুলিন কোষের মধ্যে গ্লুকোজকে প্রবেশ করাতে পারে না। রক্তের মধ্যে গ্লুকোজের মাত্রা ক্রমশ বেড়ে যায়। একে বলে টাইপ ২ ডায়াবেটিস।
আগে জেনে রাখুন কী কী উপসর্গ দেখলে বুঝবেন আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত
- ঘন ঘন প্রস্রাবের অভ্যাস তৈরি হচ্ছে কি? তা হলে সাবধান হোন। রক্তে শর্করা বাড়লে তা কিডনিতে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে, শরীর থেকে অতিরিক্ত শর্করা বার করে দেওয়ার জন্যই এই চাপ। তাই ঘন ঘন প্রস্রাব হয়। এমন হলে অবশ্যই ব্লাডসুগার পরীক্ষা করান।
- ঘন ঘন খিদে পাওয়াও, ডায়াবেটিসের একটা লক্ষণ হতে পারে। কিন্তু টাইপ-টু ডায়াবেটিসে এই লক্ষণগুলি সব সময় নাও দেখা যেতে পারে। এই প্রকারের ডায়াবেটিস ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনও লক্ষণই দেখতে পাওয়া যায় না।
- হাত-পা বা হাত-পায়ের কোনও আঙুল অবশ হয়ে পড়লে সতর্ক হোন। রক্তে শর্করা বাড়ার এটি অন্যতম লক্ষণ।
- রক্তে শর্করা বাড়লে তা বার করার জন্য কিডনিতে চাপ দেয় বলে যেমন ঘন ঘন প্রস্রাব হয়, তেমনই অতিরিক্ত প্রস্রাবের কারণে শরীরের জল বেরিয়ে যায়। তাই জল তেষ্টাও পায় প্রবল। এমনকি, রাতে ঘুমের মধ্যেও জিভ শুকিয়ে জল তেষ্টা পায় বারবার।
- শরীরে কোনও ঘা অনেক দিন ধরে না শুকোলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
- রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে গেলে তার প্রভাব পড়ে দৃষ্টিশক্তির উপরও। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে কানে কম শোনাও রক্তে শর্করা বাড়ার একটা লক্ষণ।
- সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন? হাঁপিয়ে যাচ্ছেন প্রায়ই? খুব অল্পেই হাঁপিয়ে ওঠা রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধির লক্ষণ। এর ফলে ডিহাইড্রেশনের শিকার হয় শরীর। ফলে দুর্বলতা বাড়ে।
লাইফস্টাইল ম্যানেজমেন্ট, ডায়াবেটিসের ব্রহ্মাস্ত্র—
ডায়েটে থাক ডায়াবেটিস
প্রথমে আসা যাক খাওয়ার কথায়। একটা কথাই এখন চালু হযেছে, ডায়াবেটিক ডায়েট। আসলে এমন কোনও নিয়ম নেই। ডায়াবেটিস হলেও সাধারণ ব্যালেন্সড ডায়েটই মেনে চলতে বলা হয়। সারাদিনে যে খাবার আমরা খাই তাই নিয়ম মেনে ও সময়ে সময়ে খাওয়া। সঠিক পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট খেতে হবে। ভাজাভুজি, তেল জবজবে খাবার এক্কেবারে চলবে না।
অনেকে বলেন ডায়াবেটিসে আলুই হল আতঙ্ক। সেটা কিন্তু মোটেও হয়। আলুতে আছে ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড যা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমিয়ে ডায়াবেটিসের বিস্তর উপকার করে। খোসাসমেত সেদ্ধ আলু, খোসাসমেত রাঙা আলু, মিষ্টি কুমড়ো খাওয়া যেতেই পারে, তবে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, প্রচুর তেল দিয়ে ভাজা আলু নৈব নৈব চ।
ফ্যাট কম খাওয়াই ভাল। অ্যামন্ড, আখরোট, তিসি, সূর্যমুখী–চালকুমড়ো বীজ মাপমতো খেতে পারেন। আমন্ডে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার যা রক্তে শর্করার মাত্রা সঠিক রাখতে সাহায্য করে। খিদে পেলে অল্প করে আমন্ড খেয়ে নিন। এতে খিদে যাবে। কিন্তু ওজনও থাকবে নিয়ন্ত্রণেই। প্রোটিন যুক্ত এই বাদাম খেলে সুগার লেভেলও ঠিক থাকবে।
প্রোটিন খেতে হবে মাপমতো, সারা দিনে ১০০ গ্রামের মতো মাছ খেতে পারেন। চিকেন চলবে ভালমতোই। রেড মিট একেবারে বাদ দিতে হবে না। কম চর্বির (লিন) মাংস মাসে দু’ মাসে এক–আধ বার খাওয়া যেতেই পারে।
মেদ কমান, ধূমপান তো একেবারেই নয়
ডায়াবেটিসও লাইফস্টাইল ডিজিজ। রোজকার জীবনে অনিয়ম অনেক বিপদ ডেকে আনে। এখন কায়িক পরিশ্রম অনেক কম হয়, বিশেষত করোনা কালে বাড়ি বসেই কাজ বা ওয়ার্ক ফ্রম হোম বেড়ে গেছে। কাজেই আলস্য বেড়েছে। এক্সারসাইজে ইতি দিয়েছেন অনেকেই। তার ওপর অনিয়মিত ডায়েট তো রয়েছেই। স্থূলত্ব বা ওবেসিটি কিন্তু ডায়াবেটিসের অন্যতম রিস্ক ফ্যাক্টর। নিয়মিত শরীরচর্চা ও খাদ্যাভাসে সামান্য অদলবদল করলেই রক্তে বাড়তি শর্করা বশে রাখা যায়।
ডায়াবেটিস থেকে বাঁচতে অন্তত দিনের এক ঘণ্টা সময় নিজের জন্য রাখতে হবে। ওষুধের থেকেও বেশি কার্যকরী হাঁটা। ডায়াবেটিস আক্রান্তদের প্রতিদিন নিয়মিত হাঁটতে হবে। ডায়াবেটিস না থাকলেও এই অভ্যাস রাখতে হবে। ডায়াবেটিস যাতে না হয় সেই জন্যও কিছু নিয়ম মেনে চলা উচিৎ। দিনের এক ঘণ্টা সময়ের কিছুক্ষণ যোগাসন করা যেতে পারে। পরিমিত খাবার খেতে হবে। একসঙ্গে বেশি খাবার খেলে প্যানক্রিয়াসের উপর চাপ পরে। সেই জন্য ডায়াবেটিস রোগীদের অল্প অল্প করে দিনে ছ’বার খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গেই ধূমপানের নেশা ছাড়তে হবে। একবারে হবে না, ধীরে ধীরে কমিয়ে দিতে হবে। সিগারেট এবং অ্যালকোহল পাল্লা দিয়ে চললে, মাঝ বয়সে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের কুনজরে পড়তেই হবে।
স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট জরুরি, রাতে টানা ঘুমোন
আজকের এই গতিময় জীবনে কর্মক্ষেত্রের টেনশন, বাতানুকূল পরিবেশে বসে কাজ করার অভ্যাস, কম পরিশ্রম, অতিরিক্ত ফাস্টফুড খাওয়া এবং ধূমপান, পুরুষ ও মহিলা নির্বিশেষে সকলকেই ঠেলে দিচ্ছে বিপদের মুখে। বিশেষত কমবয়সি মহিলাদের ডায়াবেটিস ধরে গেলে হার্টের রোগের ঝুঁকি চড়চড় করে বেড়ে যাচ্ছে।
মানসিক চাপ কমানো দরকার, রাতে টানা সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুম দরকার। মনের ওপর বেশি চাপ পড়লে তার ছাপ পড়বে শরীরেও। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা কাটিয়ে যত মন ও মাথা ফুরফুরে রাখা যাবে, শরীর ততই সতেজ ও নীরোগ থাকবে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে ও নিয়ম মেনে না চললে পরবর্তীকালে কিডনি, নার্ভের সমস্যাও দেখা দিতে পারে। চোখের ক্ষেত্রে রেটিনোপ্যাথি কিংবা অন্ধত্বও আসতে পারে। অনেক সময় পায়ের নার্ভ অ্যাফেক্টেড হলে নিউরোপ্যাথি হতে পারে যার ফলে পায়ে অসাড়তা আসে। ডায়াবেটিক ফুট বা ডায়াবেটিক আলসারের ঝুঁকিও বাড়ে। তাই নিয়ম মানুন এখন থেকেই।