
কাছের মানুষের নাক ডাকায় তিতিবিরক্ত! ঘুমের দফারফা, রাগ নয় রোগ সারবে এভাবেই
নাক ডাকার অভ্যাসকে (অনেকেই এটিকে অভ্যাস বলতে রাজি নন, আসলে অবচেতনে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনা) খুব একটা নিরাপদ বলে ভাবতে রাজি নন চিকিৎসকরা। শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা তো একটা বড় কারণ, তা ছাড়াও ‘স্লিপ অ্যাপনিয়া’কেও এই অতিরিক্ত নাক ডাকার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করছেন তাঁরা।
দ্য ওয়াল ব্যুরো: নাক ডাকার সমস্যা চিরন্তন, বোধকরি চিরকালের। সুখের ঘুমের শুরুতেই যদি ঠিক আপনার পাশটি থেকে যদি ‘ঘররর ঘররর..’ অথবা ‘ফুরর..ফুররৎ’ হয়, তাহলেই তো ঘুমের দফারফা। ঠেলে, ধাক্কা দিয়ে আবার কখনো সখনো কিল, ঘুঁষিতে নাসিকা গর্জনের বিকট বেগ একটু থামানো গেলেও, মিনিট খানেক বাদে যে কে সেই। ফলস্বরূপ সকাল-বিকেল সংসারে অশান্তি, মৃদুমন্দ গালি, প্রেস্টিজের এক্কেবারে ফালুদা। বাঁশির মতো নাক ফুলিয়ে হোক, বা থ্যাবড়া নাক, তার ক্যাকাফোনির জেরে অতীষ্ট হয়ে প্রিয় মানুষকে দোষারোপ করার বদলে মুক্তির উপায় খোঁজা ঢের বেশি ভাল। ভয়ঙ্কর নাকের গর্জন তো ভয়ঙ্কর কোনও রোগের কারণও হতে পারে তাই না! অথবা আদর করে ডেকে আনতে পারে কোনও দুরারগ্য ব্যধি।
নাক ডাকার অভ্যাসকে (অনেকেই এটিকে অভ্যাস বলতে রাজি নন, আসলে অবচেতনে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনা) খুব একটা নিরাপদ বলে ভাবতে রাজি নন চিকিৎসকরা। শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা তো একটা বড় কারণ, তা ছাড়াও ‘স্লিপ অ্যাপনিয়া’কেও এই অতিরিক্ত নাক ডাকার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করছেন তাঁরা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক হেলথ জার্নালের রিপোর্ট অনুযায়ী, সেখানকার প্রায় ৩ কোটি মানুষ এই স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত। জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের মত, স্লিপিং ডিসঅর্ডারের এই সমস্যা কারণ হতে পারে হৃদরোগের।
নাক কেন ডাকে!
গণ্ডগোলটা শুধু ঘুমে নয়। শরীরেরই নানা কারণ থাকতে পারে। যেমন ধরা যাক, মুখের ভিতরে গলার কাছের নরম মাংসপিণ্ড বা উভুলা যদি বাতাস চলাচলের রাস্তাটা সরু করে দেয়, তাহলে নাকে আর হাওয়াবাতাস খেলতে পারে না। তখনই শ্বাস নিতে সমস্যা হয়। তবে শ্বাস নেওয়ার সমস্যা আরও নানা কারণে হতে পারে। নাক থেকে ভোকাল কর্ড বা স্বরযন্ত্র পর্যন্ত রাস্তা যদি সরু হয় বা কোনওকারণে মেদবৃদ্ধির জন্য চর্বির স্তর জমে যায়, তাহলেও বাতাস চলাচল ঠিক মতো হয় না। আসলে নাক, গলা ও আল-জিভের পিছন দিয়ে বাতাস শ্বাসনালীতে ঢোকে। তাই সে রাস্তা যদি সরু হয় বা কোনওভাবে বাধা পায়, তাহলে শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা হয়। আবার নাকের মধ্যে পলিপ বা টিউমার থাকলেও এই বিপত্তি দেখা দেয়। ডেভিয়েটেড সেপ্টামের (নাকের হাড় বাঁকা) জন্যও অনেক সময় শব্দ হতে পারে।
নাক কতটা ডাকছে বা কীভাবে ডাকছে সেটা কিন্তু শোওয়ার ধরনের ওপরেও নির্ভর করে। মা-ঠাকুমারা বলতেন, চিৎ হয়ে শোওয়া একদম ঠিক নয়। তাতে হঠাৎ করে কাশির দমক এলে বুকে লাগতে পারে, মাথা ব্যথাও হতে পারে। ডাক্তররা বলেন, চিৎ হয়ে শুলে জিভ নাকি গলার কাছে থাকে। যে কারণে বাতাস চলাচল কিছুটা হলেও বাধা পায়। ২০০৯ সালের একটি সমীক্ষা বলছে, স্লিপিং ডিসঅর্ডার রয়েছে যেসব রোগীর তাদের নাক ডাকার প্রবণতা বেশি। এমন হাজার দুয়েক রোগীকে পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল, প্রত্যেকেরই শোওয়ার ধরনে নানা গন্ডগোল ছিল এবং যে কারণে এদের নাক ডাকার আওয়াজও নাকি ছিল শোনার মতো।
রোগ যখন স্লিপ অ্যাপনিয়া
গবেষকদের মতে, স্লিপিং ডিজঅর্ডার থাকলে শ্বাসপ্রক্রিয়া বাধা পায়। শ্বাস নিতে ও ছাড়তে সমস্যা হয়। আর ঘুমিয়ে পড়ার পর এমনিতেই ঘাড় ও গলার পেশি শিথিল থাকে, সুতরাং হঠাৎ করে যদি শ্বাস প্রক্রিয়া বাধা পেয়ে শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায় তাহলে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা থাকে। অথবা দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটা কিছুমাত্র আশ্চর্যের নয়।
দেখা যায়, বেশি নাক ডাকলে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের ঘুম ঠিকঠাক হয় না। আচমকাই নাকে বিকট শব্দ করে শ্বাস আটকে জেগে ওঠেন অনেকে। কেউ কেউ আবার মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে শুরু করেন। এই কম ঘুম মানসিক স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। নাক ডাকার কারণে যদি অবসাদ হয় তাহলে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

চিকিৎসকরা বলেন, নাক ডাকার কারণে শুধু শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্য নয়, যৌন জীবনেও তার ছাপ পড়ে। পার্টনারের একটানা ‘ফুররৎ’ ধ্বনিতে যৌন ইচ্ছাও এক্কেবারে ফুড়ুৎ হয়ে যায়।
মাথাব্যথা বা মাইগ্রেন ছাড়াও হাইপারটেনশন আরও একটা মারাত্মক ফল হতে পারে।
সম্প্রতি নাক ডাকাকে ক্যানসারেরও একটা কারণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। মনে করা হয় কম অক্সিজেনের ফলে অক্সিজেনের মাত্রা পূরণ করার জন্য আরও বেশি রক্তজালিকা তৈরি হয়। টিউমার হওয়ার অনেক কারণের মধ্যে এটাও কিন্তু একটা কারণ।
নাক ডাকা থেকে টাইপ টু ডায়াবেটিস হতে পারে। শরীরে অক্সিজেন কমে যাওয়ার ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়, যার থেকে বিশেষত মহিলাদের টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
নাক ডাকছেন মানেই প্রিয় মানুষকে একেবারে বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়াটা মোটেও ঠিক কথা নয়। “আমি কি ইচ্ছা করে নাক ডাকি?” এমন কাকুতি মিনতির উত্তরে, ‘’নাক ডাকলেই ডিভোর্স’’, জাতীয় হুমকি দিতেও দেখা গেছে অনেককে। তবে নাক ডাকাও নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। আর পাঁচটা ব্যধির মতো এটাও সেরকমই, শুধু কিছু নিয়মিত অভ্যাস আর সংযমের জেরে নাক ডাকারূপী দৈত্যকে পুরোপুরি বশে আনা সম্ভব।
নাকের হাঁকডাক বন্ধ হবে, ঘুমও হবে তোফা
নাক ডাকা বন্ধ হবে কিসে, এ প্রশ্ন তো এখন ঘরে ঘরে। টোটকাও ভূরি ভূরি। নাকের যন্ত্র কিনে এনে বৃথা চেষ্টাও চলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু নিয়ম মানলে নাক ডাকার সমস্যা দূর হতে পারে। তার জন্য অতি অবশ্যই জীবনযাত্রার ধরনে বদল আনতে হবে। চট করে দেখে নেওয়া যাক কী কী করলে হাতেনাতে ফল মিলবে–
১) ওজন কমাতে হবে অতি অবশ্যই। ওবেসিটি তো যে কোনও রোগেরই জন্ম দিতে পারে, নাক ডাকাও তার মধ্যে একটি। গোলগাল, মোটা শরীর নিয়ে নাক দিয়ে সিংহের গর্জন করতেই বেশি দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে হেলদি ডায়েট এবং অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে চটপট কমিয়ে ফেলুন ওজন।
২) অ্যালকোহলের নেশা সর্বনাশা। গলা অবধি ঠেসে মদ খেয়ে বিছানায় পড়লেই নাক একেবারে পাল্লা দিয়ে ডাক ছাড়া শুরু করে দেয়। অতএব মদ খেয়ে সুখের নিদ্রা দেবো, এমন ভাবনা থাকলে সেটা ত্যাগ করুন। অ্যালকোহলকে বিদায় জানান অবশ্যই, আর যদি না পারেন তাহলে নেশার মাত্রা কমিয়ে দিন। আর মদ খেয়েই বিছানায় নয়, কিছুক্ষণ হাঁটুন বা বসে থাকুন। তারপর ঘুমের কথা ভাবা যাবে।
৩) সিগারেটের নেশাও বা বাদ যায় কেন। ফুসফুসের দফারফা তো হচ্ছেই, ঘুমের মধ্যে শ্বাস আটকে মৃত্যু অবধি ঘটতে পারে।
৪) চিকিৎসকরা অনেকেই বলেন, চিৎ হয়ে শোওয়ার বদলে পাশ ফিরে, বিশেষত ডান পাশ ফিরে শোওয়ার উপকারিতা রয়েছে। নিয়মিত যোগব্যায়াম ভালো ফল দিতে পারে। ডাক্তারের পরামর্শ সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়।
৫) আর সব শেষে কোনও কিছুতেই কিছু না হলে, তাঁকে তাঁর অবস্থায় ছেড়ে দিন। পারলে রেকর্ড করে কানের কাছে শুনিয়ে দিন, দেখবেন নিজে থেকেই প্রতিকারের উপায় ভেবে নিয়েছে।