
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বাংলা ছায়াছবিতে চিরঞ্জিতের একটা ডায়লগ একটা সময়ে মুখে মুখে ফিরত। ‘বউ হারালে বউ পাওয়া যায় রে পাগলা! মা হারালে মা পাওয়া যায় না!’
চিরঞ্জিত এখন তৃণমূলের বিধায়ক। অনেক দিন পর রবিবাসরীয় দুপুরে ডায়মন্ডহারবারের সাতগাছিয়ায় জনসভা করলেন যুব তৃণমূল সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন সেই সভাতেই বাংলা ছবির ম্যাটিনির সেই ডায়লগ উঠে এলো অভিষেকের মুখে।
এ কথার মেজাজ যতটা সিনেমার মতো, এদিন অভিষেকের সভার মেজাজ ছিল তার একশ আশি ডিগ্রি বিপরীত। প্রবল আগ্রাসী। এবং সেই সভা থেকে যেমন মোদী-অমিত শাহদের উদ্দেশে খোলা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন অভিষেক। বলেছেন, বুকের পাটা থাকলে তাঁর নাম করে আক্রমণ করুক বিজেপির বড় মেজ সেজ নেতারা। তেমনই ঠারেঠোরে যেন বার্তা ছিল মন্ত্রিসভা থেকে সদ্য পদত্যাগী শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধেও। শুভেন্দু সম্প্রতি বলেছিলেন, তিনি প্যারাশ্যুটে নামেননি বা লিফটে চড়ে ওঠেননি। গণ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তেতেপুড়ে উঠে এসেছেন।
অভিষেক এদিন বলেন, তৃণমূলে প্যারাশ্যুটে নামা যায় না। তিনিও লিফটে ওঠেনি। তা করলে ৩৫ টি পদের অধিকারী হতেন। এও বলেন, তৃণমূল কংগ্রেস হল দলের কর্মীদের কাছে মাতৃতুল্য। মায়ের সঙ্গে কেউ বেইমানি করলে কড়ায়গণ্ডায় জবাব পাবেন।
সাতগাছিয়ার সভায় অভিষেকের বক্তৃতার হাইলাইটস (যতটা সম্ভব হুবহু)-
• একুশের লড়াই আপনাদের আশীর্বাদ নিয়ে শুরু করলাম। লড়াইয়ের ময়দানে লড়াই করে নেওয়া যাবে।
• অনেককে দেখলাম মাস্ক নাকের নীচে নামিয়ে রেখেছেন। এরকম করবেন না। মাস্ক দিয়ে মুখ, নাক ঢেকে রাখুন।
• মচিসা মাঠে এ যাবৎ কালের রেকর্ড ভেঙে গেছে। যে সংখ্যায় মানুষ মাঠে রয়েছেন, তার পাঁচগুণ লোক রাস্তায় রয়েছেন।
• উনিশের ভোটের সময় নরেন্দ্র মোদী ডায়মন্ডহারবারারে লাইটহাউজ ময়দানে এসেছিলেন। কী বলেছিলেন? ভাতিজা কা বাত্তি গুল হোনে বালা হ্যায়।
• এক্ষুণি সওকত (সওকত মোল্লা) বলছিল, বিজেপির ছোট বড় মাঝারি নেতা সবাই একটাই কথা বলে। কী বলে? ভাতিজা। আর বলে ভাইপো। তার কারণ কী? বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম—সবার আক্রমণের কেন্দ্র ভাইপো। কিন্তু মুখে নাম নিতে পারে না। নাম নিয়ে বলতে পারে না। এই বুকের পাটা ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর নেই। আর বিজেপির ছোট বড় মেজ সেজ নেতারও নেই।
• কারণ কী? আপনারা দেখেছেন আমার বিরুদ্ধে যে যখন যতবার আক্রমণ করেছেন, আমি আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছি। ২০১৭ সালে মুকুল রায় দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। তার পর ধর্মতলায় সভা করে বলেছিলেন, বিশ্ব বাংলা কোম্পানির মালিক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। হাইকোর্টে নিয়ে গিয়ে ল্যাজেগোবরে করে পরাজিত করেছি। তার পরবর্তীকালে কখনও বাবুল সুপ্রিয়, কখনও দিলীপ ঘোষ, কখনও অমিত শাহ, কখনও কৈলাস বিজয়বর্গীয় আমাকে নাম ধরে আক্রমণ করেছেন। আমি তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছি। এবং নাক রগড়াতে রগড়াতে সবাই হাইকোর্টে যা জবাব দেওয়ার দিয়েছি।
• বুকের পাটা থাকলে ভাববাচ্যে না বলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নাম নিয়ে দেখান। বাংলার বীর সন্তান যদি না হই, আপনাদের যদি টানতে টানতে কোর্টের দরজায় না নিয়ে আসতে পারি, আমিও এক বাপের বেটা নই।
• আমি তো নাম করে বলছি কৈলাস বিজয়বর্গীয় বহিরাগত, আমি নাম করে বলছি পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সভাপতি গুণ্ডা-মাফিয়া। আমি তো নাম করে বলছি, অমিত শাহ বহিরাগত, আমি তো নাম করে বলছি কৈলাস বিজয়বর্গীয়র ছেলে গুণ্ডা। আপনার ক্ষমতা থাকলে আমার বিরুদ্ধে মামলা করে দেখুন।
• লকডাউনের সময়ে ক’বার অমিত শাহ বাংলায় এসেছেন। ক’বার নরেন্দ্র মোদী বাংলায় এসেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাস্তায় নেমেছেন। প্রধানমন্ত্রী লোক দেখানোর জন্য একবার হেলিকপ্টারে ঘুরে গেছেন। আর ১ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের জন্য দিয়েছেন।
• আমফানের ক্ষতিপূরণের জন্য ৭ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। তা হলে বাকি টাকা কে দিয়েছেন? বাকি টাকা কালীঘাটে টালির চালের নীচে থাকা হাওয়াই চপ্পল পরা মহিলাটা দিয়েছেন বাংলার মানুষের স্বার্থে।
• আমি এক কথার ছেলে। যা বলি তাই করি। সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপির মতো ভাঁওতাবাজ নই। যে ১৫ লাখ দেব, ওমুক দেব, তোষুক দেব, এই করব তাই করব, আচ্ছে দিন আয়েগা—এ সব বলে কেটে পড়ব।
• তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীরা না থাকলে আমাদের কোনও গুরুত্ব নেই। তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের দল।
• মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃতীয় বার আবার মুখ্যমন্ত্রী হবেন, সময়ের অপেক্ষা। যতই নাড়ো কলকাঠি, নবান্নে আবার হাওয়াই চটি। এটা মাথায় রেখো।
• এ সব করে লাভ নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাতারাতি তৈরি হননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দুটো আক্রমণ করে বা তাঁর বিরুদ্ধে একে তাঁকে দিয়ে মন্তব্য করিয়ে কোনও লাভ নেই। সূর্যের সঙ্গে লড়াই করতে গেলে আপনার হাত পুড়বে।
• শুভাশিস দা বলল আকাশে যেমন একটা সূর্য। ৩৪ বছরের তমোসাচ্ছন্ন বাংলায় যদি কেউ মুক্তির সূর্যোদয় ঘটিয়ে থাকেন তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সূর্যের সঙ্গে লড়াই করতে গেলে ঝলসে যাবেন।
• রাতারাতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৈরি হননি। কত সংগ্রামের মাধ্যমে তৃণমূল তৈরি হয়েছে। তৃণমূল যাঁরা করেন কেউ রাতারাতি নেতা হননি। কেউ প্যারাশুটে নামেননি, কেউ লিফটে ওঠেননি।
• লিফটে উঠলে ৩৫ টি পদের অধিকারী আমিও হতাম। আর প্যারাশুটে নামলে দক্ষিণ কলকাতায় নির্বাচনে লড়তাম।
• দক্ষিণ কলকাতায় আমার বাড়ি। ২০১৪ সালে আমাকে ডায়মণ্ডহারবারে প্রার্থী করল দল। আমি মাথা পেতে নিয়েছি।
• আপনারা যাঁরা এসেছেন কজন প্যারাশুটে নেমেছেন, কজন লিফটে উঠেছেন। তৃণমূল কংগ্রেস বুথ স্তরের দল। তাতে কেউ লিফটে ওঠেননি। যদি ওঠেন পতন অনিবার্য।
• দল আমাদের সবার কাছে মায়ের মতো। রাজনৈতিক ভাবে আমাকে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিয়েছেন সেই মায়ের নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল কংগ্রেস আপনাদের মা নয়? আপনারা মানবেন যদি কেউ মায়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন? আপনারা মানবেন যদি নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে কেউ মায়ের সঙ্গে বেইমানি করেন? আপনারা ছেড়ে কথা বলবেন? যদি অন্য দলের হয়ে কেউ তাঁবেদারি করেন, ছেড়ে কথা বলবেন?
• বাংলা ছবিতে একটা কথা ছিল না! বউ হারালে বউ পাওয়া যায়, মা হারালে মা পাওয়া যায় না! সুতরাং মায়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা যারা করবে, আগামী দিন তারা কড়ায়গণ্ডায় জবাব পাবে।