
ভেঙে পড়তে চলেছে ‘মরুভূমির ম্যানহাটান’! হাজার বছর ধরে মাটির অট্টালিকা বুকে দাঁড়িয়ে এ শহর
গল্পকথার বাইরে এমন শহর যে সত্যিই আছে, এবং হাজার বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে বেঁচে আছে, তা দেখে চমক লেগেছিল। বিখ্যাত হয়েছিল সেই ডকুমেন্টারি। এ শহর যুদ্ধের সাক্ষ্মী বহন করছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সয়েছে। তাও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে হারিয়ে হাজার বছরের পুরনো স্থাপত্য আগলে আছে ‘মরুভূমির ম্যানহাটান’।
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ১৯৯৯ সালে একটি ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্যাটেরিনা বোরেলি। ইংরাজি ও আরবি ভাষায় তৈরি হয়েছিল ছবি। ডকুমেন্টারি ছিল একটি ছোট্ট শহরকে নিয়ে। শুষ্ক মরুভূমির বুকে সারি সারি অট্টালিকা। প্রাসাদের মতো বাড়ি। হলদেটে-কমলা বালির বুকে সেই বাড়িগুলো কংক্রিটের জঞ্জাল নয়। মাটির তৈরি। তার উপর রোদ পড়ে যেন সোনা রঙ পিছলে যাচ্ছে। ঠিক যেন ‘সোনার কেল্লা’ ।
গল্পকথার বাইরে এমন শহর যে সত্যিই আছে, এবং হাজার বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে বেঁচে আছে, তা দেখে চমক লেগেছিল। বিখ্যাত হয়েছিল সেই ডকুমেন্টারি। এ শহর যুদ্ধের সাক্ষ্মী বহন করছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সয়েছে। তাও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে হারিয়ে হাজার বছরের পুরনো স্থাপত্য আগলে আছে ‘মরুভূমির ম্যানহাটান’। ইয়েমেনের এ শহরকে এই নামেই ডাকা হয়। নাম শিবাম।
হাদ্রামাউড সাম্রাজ্যের সময় এ শহর তৈরি হয়েছিল। তাই শিবাম হাদ্রামাউড নামেও ডাকা হয়। শহরটা পুরোপুরি মরুভূমির বুকে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় যেন, শুষ্ক, ঝুরঝুরে বালির ভেতর থেকে বিশাল বিশাল অট্টালিকাগুলো মাথা তুলে উঠেছে। আরব উপদ্বীপের দক্ষিণে রামলাত আল-সাবাতায়ান মরুভূমির মাঝে একটা ছোট্ট শহর। কত ঝড়ঝাপটা সয়েছে। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের বীভৎসতা দেখেছে। তাও মাথা নোয়ায়নি। শহর থেকে রাস্তা চলে গেছে সানা ও ইয়েমেনের পশ্চিমাঞ্চল অবধি। আবার অন্যদিকে, পশ্চিমের আলাজলানিয়া গ্রাম ছাড়িয়ে ভারত মহাসাগরের তীরে আল-মুকাল্লার সঙ্গেও সংযোগ রয়েছে শিবামের। তাই এখানকার বাসিন্দারা শহুরে সভ্যতাতেই অভ্যস্ত। জীবনযাপনের ধরনে আধুনিকতা আছে, তবে শিকড়ের টান ভোলেনি। তাই সিমেন্টের কংক্রিটের বদলে এখন মাটি শুকনো ইট দিয়েই অট্টালিকার ভিত তৈরি হয়।
শিবাম শহরের অন্যতম আকর্ষণ হল এর স্বাতন্ত্র ও আভিজাত্য। মাটির শহর, বালির শহর অথচ আকাশছোঁয়া অট্টালিকা। অনেকটা ম্যানহাটান শহরের গরিমাকেই মনে করিয়ে দেয়। তবে এ ম্যানহাটান শহুরে সভ্যতার গর্ব করে না। মাটির তৈরি বাড়িগুলো তাদের নিজেদের সৌন্দর্য নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কোনও কোনও অট্টালিকার বয়স হাজার বছর। যদিও মাটির তৈরি বাড়িগুলো এখন ঝুঁকির মুখে, সংরক্ষণের তেমন ব্যবস্থাও নেই বেশি। শিবামে বহু প্রাচীন এক মসজিদ এখনও আছে যার বয়স হাজার বছরেরই কাছাকাছি। মাটি শুকিয়ে তৈরি ইট আর কাঠ দিয়ে মসজিদ তৈরি হয়েছে। সামান্য উপকরণে এত আশ্চর্য স্থাপত্য না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
শিবামের আরও নাম আছে। ইতিহাসবিদরা বলেন, পৃথিবীর প্রাচীনতম অট্টালিকার শহর। প্রাচীন শিলালিপি উদ্ধার করে যতটা জানা গেছে, খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে শহরটি তৈরি হয়। ব্রিটিশ পর্যটক ফ্রেয়া স্টার্ক ১৯৩০ সালে এই শহরের নামকরণ করেন ‘দ্য ম্যানহাটান অব দ্য ডেসার্ট’ । ১৯৮২ সালে শিবামকে বিশ্ব ঐতিহ্যশালী শহরের তকমা দেয় ইউনেস্কো।
হাদ্রামাউত সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল এই শহর। কুড়ি শতকে কুয়াতি সুলতানদের তিনটি বড় শহরের মধ্যে একটি ছিল শিবাম। শোনা যায়, মরুভূমির বুকে এই জায়গায় নিজেদের বসতি গড়ে তোলে এক আদিবাসী গোষ্ঠী। ছোট্ট একটা জনপদ তৈরি হয়। এখানেই একসময় হানা দেয় বেদুইনরা। ছাড়খাড় করতে শুরু করে জনপদ। বারে বারেই তারা আক্রমণ চালাত এবং লুঠপাট করে ফিরে যেত। তখন বেদুইনদের থেকে বাঁচতে দুর্গের মতো বড় বড় অট্টালিকা বানাতে শুরু করে এখানকার আদিবাসীরা।
পাঁচ থেকে দশ তলা, এগারো তলা বাড়ি তৈরি হয়। পাথরের দুর্গ বানাবার ক্ষমতা ছিল না আদিবাসীদের। তাছাড়া মরু শহরে পাথর খণ্ড বয়ে আনে গেলে যে লোকবল দরকার হত তাও এদের ছিল না। কাজেই মাটি দিয়েই ইট বানিয়ে দুর্গ বানানো শুরু হয়। রোদে ভাল করে মাটি শুকিয়ে তাই দিয়ে শক্ত ইট তৈরি করেন বাসিন্দারা। ইটের সঙ্গে কাঠ জুড়ে বাড়ির ভিত তৈরি হয়। দেওয়াল হয় মসৃণ, তার গায়ে ছোট ছোট জানলা। বাড়িতে একটাই প্রবেশপথ। ঠিক দুর্গের মতো গঠন। একটা আস্ত শহর বড় বড় দুর্গে ঘিরে বর্মের মতো মুড়ে ফেলা হয়। এরপরেও বহুবার শত্রুদের আক্রমণ সয়েছে এ শহর। কিন্তু ততদিনে নিজেদের মতো করে প্রতিরক্ষার ভাষা শিখে নিয়েছিল তারা।
ইতিহাসবিদরা বলেন, শিবামের বেশিরভাগ উঁচু অট্টালিকা ষোড়শ শতাব্দী বা তার পরে তৈরি হয়েছে। গত কয়েক শতাব্দীতে অনেক বাড়িই ভেঙে পড়েছিল। সেগুলো পুনর্নিমাণও করা হয়েছে। পাঁচশোর বেশি মাটির অট্টালিকা আছে এ শহরে। নগর পরিকল্পনায় প্রাচীন আদিবাসীদের শৈল্পিক সত্তার জবাব নেই। প্রতিটি বাড়ি একে অপরের থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে তৈরি। শহরের নিকাশি ব্যবস্থাও উন্নত। ১০০ ফুট উচ্চতার বাড়িও আছে। বিশাল উঁচু টাওয়ার আছ। সবই মাটির ইট দিয়ে তৈরি। ক্ষয় রুখতে বাড়ির পরিচর্চা করেন বাসিন্দারা।
একটা সময় বন্যা থেকে বাঁচতে গোটা শহর পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছিল। রুক্ষ মাটিতে চাষবাসের ব্যবস্থাও করেছিলেন বাসিন্দারা। তবে এখন পরিস্থিতি বদলেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধের ভয়ঙ্কর প্রভাব ছাপ ফেলেছে শহরে। বেশিরভাগ অট্টালিকাই ভেঙে পড়ার মুখে। রক্ষণাবেক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থাও করা হয়নি।
২০০৮ সালের সাইক্লোন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে শিবামের। অনেক বাড়ি বেঙে পড়ে। পুরনো স্থাপত্য জলের তোড়ে ভেসে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলে ওঠার পরেই যুদ্ধের দুন্দুভি বেজে ওঠে। ২০১৪ সালে ইয়েমেনের যুদ্ধের রেশ ছড়ায় শিবামেও। আরও ক্ষতি হয় শহরের। সানাতে বিস্ফোরণের কারণে বহু মাটির বাড়ি ভেঙে পড়ে। ২০১৫ সালে ইউনেস্কোর ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ইন ডেঞ্জার’ শহরগুলির তালিকায় নাম ওঠে শিবামের।
ইউনেস্কোর ডিরেক্টর জেনারেল ইরিনা বোকোভা বলেছেন, নানা উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে এ শহরের জীবন বয়ে যাচ্ছে। ভগ্নপ্রায় একটা সভ্যতাকে বাঁচানোর জন্য লড়াই শুরু হয়েছে। এখনও অবধি ৪০টি বাড়ি পুনর্নিমাণ করা হয়েছে। প্রতিটি বাড়ি, মসজিদ, টাওয়ার নতুন করে মেরামত করা হবে। ধ্বংসের মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা হবে ঐতিহ্যের অট্টালিকা শহরকে।