
করোনায় প্রয়াত আইএনএস অরিহন্তের স্থপতি, পদ্মশ্রী পাওয়া পরমাণু বিজ্ঞানী ডক্টর শেখর বসু
করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন দিনকয়েক আগে। কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল তাঁর। সূত্রের খবর, করোনা সংক্রমণের পাশাপাশি কিডনির রোগেও ভুগছিলেন তিনি।
দ্য ওয়াল ব্যুরো: করোনা লড়াইয়ে জিততে পারলেন না। মাত্র ৬৭ বছর বয়সেই চলে যেতে হল পদ্মশ্রী প্রাপ্ত দেশের অন্যতম পরমাণু বিজ্ঞানী ডক্টর শেখর বসুকে। ভারতের প্রথম পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ (নিউক্লিয়ার সাবমেরিন)আইএনএস অরিহন্তের মূল স্থপতি ছিলেন শেখরবাবু। দেশের পরমাণু শক্তি মন্ত্রকের প্রাক্তন সচিব, ভাবা অ্যাটোমিক রিসার্চ সেন্টারের ডিরেক্টরের পদেও ছিলেন। পরমাণু শক্তি বিষয়ক গবেষণায় এবং দেশের প্রতিরক্ষায় তাঁর অবদান অতুলনীয়।
করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন দিনকয়েক আগে। কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল তাঁর। সূত্রের খবর, করোনা সংক্রমণের পাশাপাশি কিডনির রোগেও ভুগছিলেন তিনি। আজ ভোর ৪ টে ৫০ মিনিট নাগাদ মৃত্যু হয় তাঁর। শেখরবাবুর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে টুইট করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
Grieved to hear about the passing away of veteran nuclear scientist and former Atomic Energy Commission chairman, Dr Sekhar Basu. My condolences to his family and colleagues.
— Mamata Banerjee (@MamataOfficial) September 24, 2020
কলকাতায় জন্ম। পড়াশোনাও কলকাতাতেই। বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে পাশ করার পরে মুম্বইয়ের বীরমাতা জিজাবাই টেকনোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করেন শেখরবাবু। সেটা ছিল ১৯৭৪ সাল। এরপরে ভাবা অ্যাটোমিক রিসার্চ সেন্টারে (বার্ক) গবেষণার কাজে যোগ দেন। পরমাণু শক্তি নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু হয়।
মহারাষ্ট্রের তারাপুর ও তামিলনাড়ুর কালপাক্কামের নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টে পরমাণু বর্জ্য নিষ্কাশন বিষয়ে তাঁর গবেষণা ছিল প্রশংসনীয়। নিউক্লিয়ার টেকনোলজিতে আধুনিকতা নিয়ে আসেন শেখরবাবু। তাঁর পরমাণু শক্তি বিষয়ক গবেষণার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। পরে ভাবা অ্যাটোমিক রিসার্চ সেন্টারের অধিকর্তা হয়েছিলেন তিনি।
২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশের অ্যাটোমিক এনার্জি কমিশনের সচিবের পদে ছিলেন শেখবরবাবু। ২০১৭ সালে পরমাণু শক্তি মন্ত্রকের প্রস্তাব মতো দেশে ১০টি প্রেসারাইজড হেভি-ওয়াটার রিঅ্যাকটর (PHWR) ও ২টি প্রেসারাইজড ওয়াটার রিঅ্যাকটর তৈরির কাজে সম্মতি দেয় কেন্দ্র। পরমাণু শক্তি উৎপাদনের এক নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন তিনি।
ভারতের তৈরি প্রথম পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ (নিউক্লিয়ার সাবমেরিন) আইএনএস অরিহন্ত ভারতীয় নৌসেনায় কমিশনড হয়েছে ২০১৬ সালের অগস্টে। ভারতীয় জলসীমার ভিতরে এবং তা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক জলসীমার নানা অংশ ঘুরে অরিহন্ত ফিরে এসেছে নির্দিষ্ট বন্দরে। এই দীর্ঘ মহড়ায় সমুদ্রের তলা থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে প্রতিপক্ষের উপরে পরমাণু হামলা চালানোর মহড়ায় সফল হয়েছিল এই নিউক্লিয়ার সাবমেরিন। আইএনএস অরিহন্তের মূল স্থাপত্য ও প্রযুক্তি ছিল ডক্টর শেখর বসুরই মস্তিষ্ক প্রসূত।
দেশের একাধিক বৃহত্তম বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার কাজেও অবদান ছিল শেখরবাবুর। লেজ়ার ইনটারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ অবজারভেটরি (লাইগো), ইন্টারন্যাশনাল থার্মোনিউক্লিয়ার এক্সপেরিমেন্টাল রিঅ্যাকটর (ITER)-এর নেতৃত্বে ও তত্ত্বাবধানে ছিলেন তিনিই। চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে রেডিয়েশন টেকনোলজির প্রয়োগের ব্যাপারেও তাঁর ভূমিকা ছিল। পরমাণু গবেষণায় অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৪ সালে পদ্মশ্রী পেয়েছিলেন তিনি। তার আগে ২০০২ সালে ইন্ডিয়ান নিউক্লিয়ার সোসাইটি অ্যাওয়ার্ড ও ২০০৬ সালে ডিএই অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিলেন তিনি।
শেখরবাবুর মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের ডিরেক্টর বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী ডক্টর সোমক রায়চৌধুরী। তিনি বলেছেন, “ডক্টর শেখর বসুর মৃত্যু দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। ভারতের প্রথম নিউক্লিয়ার সাবমেরিন আইএনএস অরিহন্তের কারিগর তিনি। পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের সচিব হওয়ার আগে বার্কের ডিরেক্টর ছিলেন। পরমাণু শক্তি সংক্রান্ত গবেষণার মূল ভিত তৈরি করেছিলেন শেখর বসু।” সোমকবাবু বলেন, তাঁর সঙ্গে কিছু সময় কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। যে কোনও প্রযুক্তি বা প্রকল্পকেই সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার ক্ষমতা ছিল তাঁর। লাইগো-গবেষণা সংক্রান্ত কাজেও তাঁর ভূমিকা ভোলার নয়। লাইগো-ইন্ডিয়ার স্ট্রাকচার তৈরির সময় ‘সায়েন্স ম্যানেজমেন্ট বোর্ড’তৈরি করেছিলেন তিনি। লাইগো প্রজেক্টের বেস তৈরি করতে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই বিজ্ঞান প্রকল্পের অন্যতম তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন তিনি। সোমকবাবু বলেছেন, “বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট কলেজে একবার মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়েছিলাম। সেদিন সন্ধ্যাতেই শেখরবাবুর ফোন আসে। আমাকে ধন্যবাদ জানান, স্কুলের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেন। এরপরেও কলকাতায় দেখা হয় তাঁর সঙ্গে। প্রতিবারই দেখেছি তিনি অত্যন্ত মাটির মানুষ, এত বড় বিজ্ঞানী হয়েও কী স্বাভাবিক ও বিনম্র কথাবার্তা। তাঁর মৃত্যু দুঃখজনক, পরিবারের প্রতি আমার শ্রদ্ধা রইল।”