
দ্য ওয়াল ব্যুরো: করোনার মধ্যেই বার্ড ফ্লু-র সংক্রমণে নাজেহাল দেশ। পোলট্রি ফার্মগুলিতে বিশেষ নজরদারি চলছে। রাস্তায় পাখি মরে পড়ে থাকতে দেখলেই খবর দেওয়া হচ্ছে প্রশাসনকে। বার্ড ফ্লু ভাইরাস থেকে বাঁচতে মুরগি, ডিমের বদলে মাছের বাজারেই এখন ভিড় বেশি। কিন্তু সেখানেও বিপদ। দেশজুড়ে সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ মাছের বাজারগুলিতেই। যত্রতত্র বর্জ্য, আবর্জনার স্তুপ। মাছের আড়তগুলি আরও অপরিষ্কার। রাসায়নিক সংক্রমণের আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
সমীক্ষা বলছে, দেশের ৯টি রাজ্যে প্রায় ২৪১টি মাছের বাজার রোগজীবাণুর ডিপো হয়ে উঠেছে। নোংরা নিকাশি নালা, মাছের আঁশ, রক্ত জমছে বাজারের চারদিকে। তারমধ্যেই চলছে কেনাবেচা। এইসব বাজারগুলি থেকে লেড, ক্যাডমিয়ামের মতো রাসায়নিক পাওয়া গেছে। এই সমস্ত ভারী ধাতু মানুষের শরীরে ঢুকলে বিষের মতো কাজ করবে। নানারকম জটিল রোগের জন্ম দেবে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর তো বটেই।

তামিলনাড়ু, বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ, পুদুচেরী, পশ্চিমবঙ্গ সহ ৯টি রাজ্যের মাছের বাজারগুলির অবস্থা বিপজ্জনক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লেড ও ক্যাডমিয়াম এত বেশি মাত্রায় পাওয়া যাচ্ছে যে চিন্তার কারণ রয়েছে বইকি। ২০০৬ সালে নরওয়েতে স্যামন মাছের বাজার থেকে এমন টক্সিক পদার্থ পাওয়া গিয়েছিল। সংক্রমণের আশঙ্কায় মাছের বাজারগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ভারতে এখন বেশ কিছু রাজ্যের মাছের বাজারগুলির এমন ভয়ানক অবস্থা। রাসায়নিক বর্জ্য জমেই চলেছে। আর সেগুলি মানুষের শরীরে ঢোকার পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে।
কী থেকে জমছে রাসায়নিক বর্জ্য?
বিশেষজ্ঞ কৌশিক রাঘবন বলেছেন, মাছ তাজা রাখতে রাসায়নিকের ব্যবহার করা হচ্ছে। মাছের থেকে যাতে রোগ না ছড়ায় সেজন্য প্রচুর পরিমাণে প্রোফাইল্যাকটিক অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। এই সমস্ত অ্যান্টিবায়োটিক মাছ টাটকা রাখছে ঠিকই, কিন্তু মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
এরপরেও পুকুরগুলিতে যথেচ্ছ পরিমাণে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হচ্ছে। এখনও দেশের সব পুকুর, মাছের ভেড়িতে জৈব সারের প্রয়োগ খুব বেশি নেই। উপর্যুপরি রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে পুকুরের মাটি ও জলের গুণাবলী নষ্ট হয়। মাছের ভাল ফলন পেতে হলে এক বছরে এক বিঘা পুকুরে ১১ কেজি নাইট্রোজেন ও ৫ কেজি ফসফেট জোগান দিতে হয় অনেকসময়েই। এর বেশি হয়ে গেলে আবার পুকুরের জল দূষিত হয়। মাছের শরীরের ভেতর চাপের সৃষ্টি হয়, জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যায়, মাছের ক্ষুধামান্দ্য হয়। মাছের থেকে রোগ চলে আসে মানুষের শরীরে।
আগাছা পরিষ্কার করতেও রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয় পুকুর, জলাশয়গুলিতে। তা থেকেও মাছের শরীরে রাসায়নিক ঢোকে। রাঘবন বলছেন, মাছ বাজারের বর্জ্যগুলি থেকে প্রচুর পরিমাণ লেড, ক্যাডমিয়াম পাওয়া যাচ্ছে। লেড ও ক্যাডমিয়াম শরীরে ঢুকলে কোষগুলিকে খুব তাড়াতাড়ি সংক্রামিত করে। স্নায়ুর রোগ তৈরি করতে পারে। কিডনির সমস্যা, পেশির দুর্বলতা, মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা হ্রাস ইত্যাদির জন্যও লেড দায়ী। কিডনি ও ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে ক্যাডমিয়াম।
মাছ সতেজ রাখতে ফর্মালিনের ব্যবহার এখনও চলছে বলেও সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এর আগে অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার থেকে আসা রুই-কাতলা মাছে প্রচুর পরিমাণ ফর্মালিন মেলায় মাছ আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন মাছ টাটকা রাখতে ফর্মালিন নামে এই রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি ফর্মালিন শরীরে ঢুকলে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপকে তা প্রভাবিত করতে পারে। দেখা দিতে পারে মারাত্মক সমস্ত রোগভোগও। কোনও দ্রবণে ৩৭ শতাংশ ফর্মালিন থাকলে তা মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে। মাছ ব্যবসায়ীরা এই ফর্মালিনের দ্রবণ তৈরি করে তাতে মাছ চুবিয়ে রাখেন। মাছ সতেজ থাকে বটে, কিন্তু মানুষের পাকস্থলী, যকৃৎ, ক্ষুদ্রান্ত্রে নানাবিধ ক্ষতি করে ওই ফর্মালিন। এমনকী এর থেকে ক্যানসারও হতে পারে। গত বছরই কেরলে দু’হাজার কিলোগ্রাম মাছে ফর্মালিন পাওয়া গিয়েছিল।
ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান অ্যানিমাল প্রোটেকশন অর্গানাইজেশন (FIAPO)-এর একজিকিউটিভ ডিরেক্টর ভার্দা মেহরোত্রা বলেছেন, দেশের বেশিরভাগ মাছের আড়তগুলিরই এমন ভয়ঙ্কর অবস্থা। গাইডলাইন মেনে চলছে না কেউই। বর্জ্য পরিষ্কার করার কাজও হয় না। মশা, মাছি ও অন্যান্য জীবাণু থেকেও রোগ ছড়াবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই এখন থেকেই মাছের আড়ত ও বাজারগুলিতে কড়া নজরদারি চালাতে হবে। হতেই পারে পরবর্তী সংক্রমণ এখান থেকে ছড়িয়ে পড়তে পারে সারা দেশে।