
দ্য ওয়াল ব্যুরো: পূর্ব লাদাখের প্যাঙ্গং রেঞ্জ থেকেই কিছুটা সেনা পিছিয়েছে (ডিসএনগেজমেন্ট)চিন। তাই বলে গোটা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর চিনের ফৌজ তাদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা ছেড়ে নিশ্চুপে চলে গেছে তেমনটা একেবারেই নয়। ভারতীয় প্রতিরক্ষা সূত্র জানাচ্ছে, উত্তর ও দক্ষিণ প্যাঙ্গং লেক ও তার সংলগ্ন পাহাড়ি খাঁজ থেকে লাল সেনা সরেছে ঠিকই, তবে অন্যদিকে গোগরা, হট স্প্রিং, দেপসাং ভ্যালিতে নতুন করে সেনা মোতায়েন শুরু করেছে পিপলস লিবারেশন আর্মি। অস্ত্রসস্ত্রও মজুত হচ্ছে। নতুন করে অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে ভারতীয় নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় চিনের ফৌজ যে হামলা চালাতে পারে, সে সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
আগামীকাল, শুক্রবার চুসুল সীমান্তে চিন-ভারত সেনা কম্যান্ডার পর্যায়ের বৈঠক আছে। এই নিয়ে ১১ বার মুখোমুখি আলোচনায় বসতে চলেছে দুই দেশ। সীমান্তে শান্তি ও সুস্থিতি বজায় রাখতে এই বৈঠক। এর আগের ১০টি বৈঠকে যা আলোচনা হয়েছিল তাতে দুই দেশের সেনাই প্যাঙ্গং থেকে তাদের সামরিক সরঞ্জাম সরিয়ে নিয়েছে। সীমান্তে শান্তি বজায় রাখার আশ্বাসও দিয়েছে। কিন্তু ভারতীয় সেনা সূত্র জানাচ্ছে, চিন শুধু মুখেই সেনা সরানোর কথা বলেছে, আদতে তাদের উদ্দেশ্য অন্য। কারণ ইতিমধ্যেই প্যাঙ্গং থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে রুটগ ঘাঁটিতে নতুন করে কাঠামো বানাতে দেখা গেছে লাল ফৌজকে। নতুন উপগ্রহ চিত্র দেখিয়েছে, রুটগ বেসে ছোট ছোট ঘর তুলছে চিনের সেনা। সেখানে সামরিক সরঞ্জাম রাখার ব্যবস্থাও আছে। এই রুটগ ঘাঁটি থেকে প্যাঙ্গংয়ের ওপর নজরদারি করাও যায়। কাজেই প্রয়োজন হলে চিনের বাহিনী যে ফের তাদের সীমা পেরিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাতে পারে, এ ধারণা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না পর্যবেক্ষকরা।
প্রতিরক্ষা সূত্র বলছেন, আন্তর্জাতিক সীমান্ত চুক্তি মাফিক কোনও দেশের সেনাই বেআইনিভাবে সীমান্ত পার হতে পারে না। আঞ্চলিক সীমান্তগুলির সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য চুক্তিবদ্ধ দুই দেশই। কিন্তু চিনের বাহিনী সে চুক্তি বারে বারেই লঙ্ঘণ করেছে। গালওয়ানের সংঘাত তার অন্যতম বড় প্রমাণ। সেনা ঢুকিয়ে জোরজবরদস্তি আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা সম্ভব নয় বুঝেই চিন ঘুরপথে একটু একটু করে সীমান্তে তাদের শক্তি বাড়িয়ে চলেছে। শুধু রুটগ ঘাঁটি নয়, ভারতের সীমান্ত বারবর এমন অনেক জনপদ তৈরি করে রেখেছে চিন, যেখানে সেনাদের বসবাস করা ও যুদ্ধাস্ত্র মোতায়েন রাখার মতো ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি) বরাবর ১৫ নম্বর পেট্রোলিং পয়েন্টকে (পিপি) বলে গোগরা পোস্ট। গত বছর মে মাসে এই গোগরা পোস্ট দিয়েই ভারতীয় সীমায় ঢুকে পড়েছিল চিনের বাহিনী। এখন আবার এই পোস্টের তিন কিলোমিটারের মধ্যে চিনের সেনার তৎপরতা লক্ষ্য করা গিয়েছে। কয়েকটি তাঁবুও ফেলা হয়েছে নতুন করে।

এলএসি-র ১৭ নম্বর পেট্রোলিং পয়েন্ট থেকে পিপি-১৭এ অবধি এলাকাকে বলে হট স্প্রিং। গত বছর চিনের সেনা এই এলাকায় ঢুকে পড়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল। ভারতীয় বাহিনী সজাগ থাকায় হাতাহাতি করেই ফিরে যেতে হয় তাদের। কিন্তু এখন আবার এই হট স্প্রিং রেঞ্জেই নজর পড়েছে লাল ফৌজের।
এখানেই শেষ নয়, চিনের নিশানায় আছে দেপসাং ভ্যালিও। ভৌগোলিক গুরুত্ব তো বটেই সামরিক দিক থেকেও ওই এলাকা কখনও হাতছাড়া করতে চাইবে না ভারত। ১৬ হাজার ৪০০ ফুট উচ্চতায় ৯৭২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দেপসাং ভ্যালি। ২০১৩ সালে এই এলাকার ১৮ কিলোমিটারের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল চিনের সেনা, ২০১৭ সালে ডোকলামে দুই দেশের বাহিনী মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকার সময়েও এই দেপসাং ভ্যালিই চিন্তা বাড়িয়েছিল। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেপসাং ভ্যালিতে আধিপত্য বিস্তার করতে পারলে নীচে ডেমচক অবধি এলাকায় কর্তৃত্ব করতে পারবে লাল সেনা। একদিকে সিয়াচেন গ্লেসিয়ার, অন্যদিকে চিনের নিয়ন্ত্রণে থাকা আকসাই চিন—এই দুইয়ের মাঝে রয়েছে দেপসাং ভ্যালি। ভারতের সাব সেক্টর নর্থ তথা এসএসএনের মধ্যে পড়ে দেপসাং। এই এলাকার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল একদিকে উচ্চতম সিয়াচেনের সীমান্তের নাগাল পাওয়া যাবে, অন্যদিকে আকসাই চিন লাগোয়া দৌলত বেগ ওল্ডি হয়ে ভারতে ঢোকার রাস্তা সহজ। চিনের সেনাকে পেরিয়ে পাঁচটি পেট্রোলিং পয়েন্ট যথা—১০,১১,১১এ,১২ ও ১৩ –তে আর টহল দিতে পারবে না ভারতীয় বাহিনী। ফলে একদিকে গালওয়ান ও অন্যদিকে প্যাঙ্গং হ্রদের পাহাড়ি এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের রাস্তা সহজ হবে চিনের বাহিনীর কাছে।