
শোভন চক্রবর্তী
উনিশ সালে লোকসভা ভোটের ফল সবে বেরিয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা পর কালীঘাটে সাংবাদিক বৈঠক করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘টোটালটাই হিন্দু মুসলমান হয়ে গিয়েছে।’ ধর্মীয় মেরুকরণের দিকে ইঙ্গিত করতে চেয়েছিলেন দিদি।
একুশের ভোটের আগেও সেই সম্ভাবনার কথা অনেকে বলছেন। সেই সঙ্গে দশ বছরের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ফ্যাক্টর অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। এখন দুয়ারে সরকার পৌঁছলেও তা নেই। ভোটটা যে ‘টোটালটাই’ তৃণমূল বনাম বিজেপিতে হতে পারে সেটা অনেকের মতো খোলাখুলি বলছেন, দিদির ক্ষুদ্র সহযোগী (স্মল টাইম এইড) প্রশান্ত কিশোরও। বাকিরা যে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে সে ব্যাপারেও বহুজনের সঙ্গে সহমত তিনি।
এখন আরও একটি বৃহৎ প্রশ্ন ঝুলছে। বা এও বলা যেতে পারে অনেকের মনে সেই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। তা হল—একুশের ভোটটা কি মমতা বনাম শুভেন্দুতে পরিণত হতে পারে?
কেন সেই কৌতূহল তৈরি হয়েছে, কী কী সূচক বা ইন্ডিকেটর দেখে তা মনে হচ্ছে সেটাই চোখ খুলে দেখার বিষয়।
এ কথা অনস্বীকার্য যে বাংলার রাজনীতিতে দল নির্বিশেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো রাজনৈতিক উচ্চতা কারও নেই। সাত বারের সাংসদ, নরসিংহ রাও জমানায় কেন্দ্রে ক্রীড়া ও যুব কল্যণ মন্ত্রী পরে বাজপেয়ী জমানায় রেলমন্ত্রী, কয়লা মন্ত্রী, মনমোহন জমানায় ফের রেলমন্ত্রী এবং গত সাড়ে ৯ বছর ধরে বাংলার মতো বড় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
তৃণমূলের বড় এবং অন্যতম পুঁজি দিদির মুখটাই। সেই মুখ মুখ্যমন্ত্রী পদে তাঁর মেয়াদে উজ্জ্বল হয়েছে না প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায় রিক্ত—তার জবাব মিলবে ভোটে। বিপরীতে বাংলায় বিজেপি শিবিরে এতদিন দিদির সমতুল বা প্রায় কাছাকাছি কোনও মুখ ছিল না। তবে শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর ছবিতে একটা বদল অবশ্যই দেখা যাচ্ছে। গোড়া থেকে ইন্ডিকেটর বা সূচকগুলোয় চোখ বোলানো যাক।
এক, ভোটের আগে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ার ঝোঁক অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছে। কিন্তু শুভেন্দুর দলত্যাগ আটকাতে তৃণমূলের যে মরিয়া চেষ্টা দেখা গিয়েছে তা বিরল। প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রশান্ত কিশোর তাঁর সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই বৈঠকের মধ্যে স্পিকার ফোনে কথা বলছেন। ইত্যাদি প্রভৃতি।
দুই, বিজেপিতে এর আগে যাঁরা যোগ দিয়েছেন, শুভেন্দুর যোগদানের মতো কাউকে নিয়ে এতো আড়ম্বর হয়নি। অমিত শাহ নিজে গিয়েছেন মেদিনীপুরে। সূর্যকান্ত মিশ্র দিদি তাঁর দলের যত সমালোচনা করুন তৃণমূল প্রতিক্রিয়া জানাতে তাড়াহুড়ো করে না। কিন্তু শুভেন্দু কিছু বললেই সৌগত রায়, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়রা ঝাঁপিয়ে পড়ছেন।
চার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রোড শো ও তাঁর বক্তৃতা যে ভাবে অধিকাংশ বৈদ্যুতিন ও ডিজিটাল মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার হয়, শুভেন্দুর ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। এমনকি সম্প্রতি কাঁথিতে শুভেন্দুর রোড শো-র দিন দেখা যায়, তখন নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করছেন মুখ্যমন্ত্রী। বহু চ্যানেলে তখন টুইন উইন্ডো করে দুজনকেই দোখানো হয়। অর্থাৎ ভারসাম্য রেখে তুল্যমূল্য দুজনকেই দেখানো হয়েছে। বিরোধী দলের আর কোনও নেতা সেই গুরুত্ব পাচ্ছেন না। বাণিজ্যিক সংবাদমাধ্যম তাঁদের খবরই বেশি দেখায় যাঁকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেশি।
চার, শুধু বৈদ্যুতিন বা ডিজিটাল মাধ্যম নয়, খবরের কাগজেও শুভেন্দু সম্পর্কে খবর যে রকম গুরুত্ব দিয়ে প্রথম পাতায় প্রকাশ করা হচ্ছে, তাও লক্ষ্য করার বিষয়।
পাঁচ, শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন মাত্র ১৪ দিন আগে। এর মধ্যেই তাঁকে একটি সরকারি পদ দেওয়ার তৎপরতা শুরু হয়েছে কেন্দ্রের তরফে। তাঁর বায়োডেটা নেওয়া হয়েছে। বাংলা কেন, জাতীয় স্তরে বিজেপিতে যোগ দিয়েই এমন মর্যাদা আর ক’জন পেয়েছেন? এর অর্থ, কলকাতায় শুভেন্দুর একটা সরকারি দফতর হবে। জেলা সফরে গেলে বিএসএফ, সেনা বা বায়ুসেনার গেস্ট হাউজে বিশ্রাম নিতে পারবেন ইত্যাদি।
ছয়, বিজেপি সূত্রে খবর, শুভেন্দুকে খুব শিগগির একটি সাংগঠনিক পদও দেওয়া হবে। দলে যোগ দেওয়ার চোদ্দ দিনের মধ্যে এমন ভাবনা ও পদক্ষেপও বিরল।
সাত, নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় থেকেই শুভেন্দু হাইকোর্টের নির্দেশে নিরাপত্তা পান। প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার ঠিক আগে মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির সদস্য থাকার সুবাদে শুভেন্দুর নিরাপত্তা নিয়ে কেন্দ্রের তরফে রাজ্যের কাছে পরামর্শ তথা নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। সুতরাং বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর শুভেন্দু যে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা পাবেন তা স্বাভাবিক ছিল। তা না পেলে বরং বড় খবর হত।
সে যাক। লক্ষ্য করার বিষয় হল, শুভেন্দুর সঙ্গে এখন দুই নিরাপত্তা কর্মী কোট টাই পরে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁরা আধা সামরিক বাহিনীর কম্যান্ডো। তিনি ও দিলীপ ঘোষ দুজনেই জেড ক্যাটাগরির নিরাপত্তা পান। কিন্তু বহরের ফারাকটা নজর করলেই স্পষ্ট হবে।
তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল?
দু’ভাবে তা দেখা যেতে পারে। যেমন, তৃণমূলের কেউ কেউ বলছেন, একান্নবর্তী বাড়িতে নতুন বউ এলে শুরুতে এমন হয়। অন্যভাবেও দেখা যেতে পারে, তা হল দিদির প্রতিপক্ষ হিসাবে একটি মজবুত মুখ উঠে আসছে। তাঁর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। আপাতত ওই টুকুই।
এখনও পর্যন্ত দেখা গিয়েছে, মোটামুটি ভাবে পশ্চিম মেদিনীপুর ও পূর্ব মেদিনীপুর তথা নিজের হোম গ্রাউন্ডেই বল নিয়ে ছোটাছুটি করছেন শুভেন্দু। তাতে যে বিপুল সাড়া পাচ্ছেন তা ভিড়ের স্বতঃস্ফূর্ততায় আন্দাজ করা যাচ্ছে। মেদিনীপুর ছাড়া পূর্বস্থলীতে সভা ও খড়দহে রোড শো করেছেন শুভেন্দু। এই দুই সভাতেও ভিড় ও উন্মাদনা দেখা গিয়েছে।
পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, এগুলো হয় প্রাথমিক সূচক। শুভেন্দু নিজেও বলেছেন, ব্যাপারটা এখনও শুরুই হয়নি। বসন্তে রাম নবমী আসতে আসতে শত সহস্র পদ্ম ফোটানোর অঙ্গীকার করেছেন তিনি। এই চ্যালেঞ্জটা এখন শুভেন্দুরই। যে রেসপন্স তিনি পাচ্ছেন বা যে ‘ লজিস্টিক সাপোর্ট’ তাঁকে দিচ্ছেন অমিত শাহরা তাকে পুঁজি করে আরও রাজনৈতিক উচ্চতা পাওয়ার লক্ষ্যে ধারাবাহিক পরীক্ষা দিতে হবে তাঁকে।
সেই পরিশ্রম শুভেন্দু অবশ্য করছেন, বছরের প্রথম দিনে কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা যখন বড় কর্মসূচি নিয়ে রাস্তায় নেই, তখন শুভেন্দু সকালে নন্দীগ্রামে সভা, বিকেলে কাঁথি, রাতে তমলুকে মিটিং সেরে করে দিনের কাজ গুটিয়েছেন রাত ১ টায়।