
কোহলি ব্রিগেডের সিরিজ জয়ই কি সেরা? নাকি এগিয়ে থাকবে সৌরভদের লড়াই
দেবার্ক ভট্টাচার্য্য
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ভারতের ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ের পর একটা বিষয় পরিষ্কার, এটাই ভারত তথা কোনও এশীয় দলের সেরা ফল। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, কোহলিবাহিনীর পারফরম্যান্সই কি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সফরকারী কোনও ভারতীয় দলের সেরা পারফরম্যান্স। নাকি এই নিরিখে এগিয়ে রয়েছে ২০০৩-০৪ সফরকারী সৌরভ গঙ্গোপাধায়ের নেতৃত্বে ভারতীয় দলের পারফরম্যান্স।
সিডনিতে ট্রফি জয়ের পর বিরাট কোহলি বলেছেন, এই জয়কে তিনি ২০১১ সালের বিশ্বকাপ জয়েরও উপরে রাখেন। তাঁর কেরিয়ারে সবথেকে স্মরণীয় জয় এটি। একই সুর শোনা গেছে কোচ রবি শাস্ত্রীর গলাতেও। তিনি বলেছেন, এই জয়কে তিনি ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ জয় বা ১৯৮৫ সালের ওয়ার্ল্ড সিরিজ জয়ের থেকেও এগিয়ে রাখবেন। কোহলি-শাস্ত্রীর এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, দুটো ফরম্যাট সম্পূর্ণ আলাদা। তাই দুটো ফরম্যাটের মধ্যে কখনও তুলনা করা সম্ভব নয়। আনন্দের আতিশয্যে হয়তো এমন কথা বলে ফেলেছেন অধিনায়ক ও কোচ।
আরও পড়ুন অস্ট্রেলিয়ায় ইতিহাস তৈরির ‘বিরাট পুরস্কার’ পেল কোহলি অ্যান্ড কোং
ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের একাংশের আরও বক্তব্য, ভারতীয় দলে হয়তো কিছুটা উন্নতি হয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গেই অস্ট্রেলিয়া দলে বিস্তর অবনতি হয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতে এর থেকে খারাপ অস্ট্রেলিয়া দল মনে পড়ছে না। প্রত্যেকটি বিভাগে অবনতি হয়েছে দলের। আর তাই এই সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার হারের পিছনেও উঠে আসছে বেশ কিছু কারণ।
বিশ্বের সেরা ব্যাটিং লাইন-আপ বনাম ক্লাব স্তরের ব্যাটিং : ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৭। এই আট বছর বিশ্ব ক্রিকেটে রাজ করেছে অস্ট্রেলিয়া। এই সময়ের মধ্যে তিনটি বিশ্বকাপ যেমন জিতেছে, তেমনই ওয়ান ডে ও টেস্টে এই সময় এক নম্বর আসন তাঁদেরই ছিল। ২০০৩-০৪ সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইন আপ ছিল এরকম- জাস্টিন ল্যাঙ্গার, ম্যাথু হেডেন, রিকি পন্টিং, ডেমিয়েন মার্টিন, স্টিভ ও, সাইমন ক্যাটিচ ও অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। যে দলে সাত নম্বরে ব্যাট করতে নামেন গিলক্রিস্ট, সেই দলের ব্যাটিং গভীরতা নিয়ে আর কীই বা বলার থাকে।
আরও পড়ুন ‘পূজারার ব্যাটিং সোনার মতই মূল্যবান’, ভিডিও বার্তা ভিভ রিচার্ডসের
উল্টোদিকে চলতি সিরিজে একমাত্র উসমান খোয়াজা ছাড়া আর কোনও অজি ব্যাটসম্যানকে দেখে মনে হয়নি ক্রিকেটের সর্বোত্তম পর্যায়ে খেলার জন্য তাঁরা প্রস্তুত। একটা পরিসংখ্যানেই এটা পরিষ্কার। চার টেস্টের সাত ইনিংসে একটাও সেঞ্চুরি আসেনি কোনও অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে। সর্বোচ্চ স্কোর সিডনিতে করা মার্কাস হ্যারিসের ৭৯।
বিশ্বের সেরা বোলিং আক্রমণ বনাম পড়তি ফর্মের অস্ট্রেলিয়ান বোলিং : ব্যাটিং লাইন আপে যতটা পার্থক্য, বোলিংয়ে হয়তো ততটা নেই। ২০০৩-০৪ সিরিজে ম্যাকগ্রা ও শেন ওয়ার্ন খেলেননি। বোলিংয়ের দায়িত্ব ছিল মূলত জেসন গিলেসপি, ব্রেট লি, ন্যাথন ব্র্যাকেন ও ম্যাকগিলের উপর। ম্যাকগ্রা, ওয়ার্ন ছাড়াও এই বোলিং ছিল বিশ্বের অন্যতম সেরা বোলিং।
অন্যদিকে এই দলে অফ স্পিনার লিওঁ ছাড়া পাতে দেওয়ার মতো বোলার কম। হ্যাঁ, প্যাট কামিংস বা হ্যাজলউড কোনও স্পেলে হয়তো দুরন্ত বোলিং করেছেন, কিন্তু একটা বড় সময় ধরে ব্যাটসম্যানদের উপর চাপ রাখতে পারেননি। মিচেল স্টার্ক শুধুমাত্র তিন বছর আগের স্টার্কের ছায়া। না আছে সেই বাউন্স, না সেই বিষাক্ত ইনসুইং।
ওয়ার্নার-স্মিথের অনুপস্থিতি : এই দল নিয়েও অস্ট্রেলিয়া হয়তো লড়াই দিত, যদি দলে ওয়ার্নার ও স্মিথ থাকতেন। কারণ শেষ এক বছরে অস্ট্রেলিয়ার এই দুই ব্যাটসম্যানই বিশ্বমানের। বিশেষ করে ঘরের মাঠে প্রতিপক্ষকে একাই শেষ করে দিতে পারেন তাঁরা। ওপেনে ওয়ার্নার যে শুধুমাত্র দ্রুত রান করতেন তাই নয়, বিপক্ষের হাতের মুঠো থেকে খেলা ছিনিয়ে নিয়ে চলে যেতেন। অন্যদিকে তিন নম্বরে নেমে পার্টনারশিপ গড়ার কাজ করতেন স্মিথ। তাঁকে আউট করা ছিল কঠিন কাজ। বিশেষ করে ভারতের বিরুদ্ধে তাঁদের রেকর্ড ছিল দেখার মতো। তাই এই দুজনের অনুপস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়া ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ডই গিয়েছে ভেঙে।
ভারতের পেস অ্যাটাক : একটা কথা মানতেই হবে, কোহলির সবথেকে বড় অস্ত্র ভারতের সেরা পেস বোলিং অ্যাটাক পেয়েছেন তিনি। সৌরভের নেতৃত্বে ভারতীয় দল যখন সফরে গিয়েছিল তখন ভারতের পেস আক্রমণ বলতে ছিল অজিত আগরকর, মুনাফ পটেল ও ইরফান পাঠান। আর এখন বুমরাহ-শামি-ইশান্তের ত্রিফলা যে কী করতে পারে, তা গোটা বিশ্ব দেখেছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরে সবথেকে বেশি উইকেট তুলেছেন ভারতের এই ত্রয়ী।
এ তো গেল দলের পর্যালোচনা। এ বার আসা যাক, লড়াইয়ের প্রসঙ্গে। চলতি সিরিজে কেবলমাত্র অ্যাডিলেড ছাড়া কোথাও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখা যায়নি। পারথে যেমন একতরফা জিতেছে অস্ট্রেলিয়া, তেমনই মেলবোর্ন ও সিডনিতে একতরফা দাপট দেখিয়েছে ভারত। কিন্তু ২০০৩-০৪-এর সিরিজে ওই শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গেও সৌরভের ভারত কীরকম লড়াই দিয়েছিল, তা একটু ম্যাচের পরিসংখ্যান দেখলেই স্পষ্ট হবে।
প্রথম টেস্ট ( ব্রিসবেন ) : প্রথম ইনিংসে ব্যাট করে জাস্টিন ল্যাঙ্গারের ১২১ রানের দৌলতে অস্ট্রেলিয়া করেছিল ৩২৩ রান। জবাবে প্রথম ইনিংসে অধিনায়ক সৌরভের ১৪৪ রানের দৌলতে ভারত করেছিল ৪০৯। দ্বিতীয় ইনিংসে ৩ উইকেটে ২৮৪ রান করে ডিক্লেয়ার দেয় অস্ট্রেলিয়া। ভারত ২ উইকেটের বিনিময়ে ৭৩ রান করলে ম্যাচ ড্র হয়।
দ্বিতীয় টেস্ট ( অ্যাডিলেড ) : প্রথম ইনিংসে ব্যাট করে রিকি পন্টিংয়ের ২৪২ রানের সৌজন্যে অস্ট্রেলিয়া করে ৫৫৬ রান। ভারতও জবাব দেয়। প্রথম ইনিংসে ৫২৩ রান করে ভারত। মূলত রাহুল দ্রাবিড়ের ২২৩ ও লক্ষ্মণের ১৪৮ রানের দৌলতে এই রান ওঠে। দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১৯৬ রানে অলআউট হয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। অজিত আগরকর নেন ৬ উইকেট। চতুর্থ ইনিংসে ৬ উইকেটে ২৩৩ রান করে টেস্ট জিতে যায় ভারত। রাহুল দ্রাবিড় ৭২ করে নট আউট থাকেন।
তৃতীয় টেস্ট ( মেলবোর্ন ) : এই টেস্টে ফিরে আসেন অজিরা। ভারত প্রথম ইনিংসে সেহওয়াগের ঝোড়ো ১৯৫ রানের দৌলতে ৩৬৬ রান করে। জবাবে অস্ট্রেলিয়া করে ৫৫৮ রান। পন্টিং ২৫৭ ও হেডেন ১৩৬ রান করেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ২৮৬ রান করে অলআউট হয়ে যায় ভারত। মাত্র ১ উইকেট হারিয়ে ৯৭ রান করে টেস্ট জিতে সিরিজে সমতা ফেরায় অজিরা।
চতুর্থ টেস্ট ( সিডনি ) : এই টেস্টে প্রথমে ব্যাট করে ৭ উইকেটে ৭০৫ রানের বিশাল পাহাড় খাড়া করে ভারত। শচীন তেণ্ডুলকর ২৪১ ও লক্ষ্মণ ১৭৮ রান করেন। জবাবে প্রথম ইনিংসে ক্যাটিচের ১২৮ রানের দৌলতে ৪৭৪ করে অস্ট্রেলিয়া। ফলো-অনের সুযোগ থাকলেও তা করাননি সৌরভ। দ্বিতীয় ইনিংসে ভারত করে ২ উইকেটে ২১১। অস্ট্রেলিয়া শেষ পর্যন্ত ৬ উইকেটে ৩৫৭ করে ম্যাচ ড্র করে। ষষ্ঠ উইকেটে অধিনায়ক স্টিভ ও ৮০ এবং ক্যাটিচ ৭৭ করে ১৫৮ রানের পার্টনারশিপ গড়ে ম্যাচ বাঁচান।
এই পরিসংখ্যান দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিশ্বমানের সেই দলের বিরুদ্ধেও কীরকম লড়াই করেছিলেন সৌরভ, দ্রাবিড়, লক্ষ্মণরা। সিরিজ সেরার পুরস্কার পেয়েছিলেন তৎকালীন তিন নম্বর রাহুল দ্রাবিড়। সিডনি টেস্টে অধিনায়ক সৌরভ সাহস দেখিয়ে যদি ফলো-অন করাতেন, হয়তো ম্যাচের ফল অন্য হতো। অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজ জয়ী প্রথম অধিনায়ক হিসেবে হয়তো তাঁর নামই লেখা থাকত।
কিন্তু তাই বলে কোহলি অ্যান্ড কোং যা করেছেন, তাঁদের কৃতিত্ব একটুও কম নয়। দলের যে অবস্থায় থাকুক না কেন, ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া সব সময় কঠিন প্রতিপক্ষ। এই দল নিয়েও পারথে তাঁরা কোহলিদের হারিয়েছেন। তাই কোহলির নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে যে বিরাট মাইলস্টোন ভারতীয় দল রাখল, সেই আনন্দ প্রত্যেক ভারতীয়র অনেকদিন মনে থাকবে। তবে তার সঙ্গে বিশ্বের সেরা দলের বিরুদ্ধে তাদের ঘরের মাঠে সৌরভের নেতৃত্বে টিম ইন্ডিয়ার লড়াইটাও যেন ভারতীয় সমর্থকরা না ভোলেন।