
শোভন চক্রবর্তী
চৌত্রিশ বছরের বাম জমানার পর রাইটার্স বিল্ডিংয়ের বারান্দায় পৌঁছেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেকে বলেন, দিদির মহাকরণে যাওয়ার দুটো প্রধান সিঁড়ির নাম সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রাম। একুশের ভোট যখন বাংলার দরজায় কড়া নাড়ছে তখন কি দিদির উত্থানের সেই দুটো সিঁড়িই নড়বড় করছে? খসে পড়ছে চুন, সুড়কি, বালি?
নন্দীগ্রামের শুভেন্দু অধিকারী থেকে সিঙ্গুরের রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (সুব্রত বক্সীর ধমকের পর বেচারাম মান্না শান্ত হয়েছেন)— শাসকদলের অনেকেই অশনি সঙ্কেত দেখেছেন।
নন্দীগ্রামের চেতনায় যেন বিপ্লব রয়েছে। অতীতে সিঙ্গুরের তুলনায় নন্দীগ্রামে অনেক বেশি রক্ত ঝরেছে। এবারও নন্দীগ্রাম দৃশ্যত আন্দোলিত। বিদ্রোহ, অভিমান, অসন্তোষের লাভা দলা পাকিয়ে উঠছে। তার তাপ পাওয়া যাচ্ছে কলকাতা থেকে। সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে কদিন আগে শুভেন্দু অধিকারী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছেন, “লড়াইয়ের মাঠে দেখা হবে।”
আর সিঙ্গুরের মাস্টারমশাই বলছেন, “দুর্নীতিগ্রস্তদের নেতা বানানো হচ্ছে। আমায় অন্য দলে যাওয়ার কথা ভাবতে হবে।” এও বলেছেন, “বেচারাম মান্নার সঙ্গে মিলে ভোট করতে পারব না। এই বলে দিলাম”।
লোকসভা ভোটেই বোঝা গেছে, সিঙ্গুরের মাটি অস্থির। তৃণমূলের পায়ের তলা থেকে সরে যাচ্ছে। গত ১০ নভেম্বর নন্দীগ্রামে দেখা গেল, হলদি নদীর তীরে তৃণমূলের মিটিংয়ে মেরেকেটে হাজার খানেক লোক আর শুভেন্দুর সভায় কুল ছাপানো জমায়েত।
প্রশ্ন উঠতে পারে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম ছাড়া কি তৃণমূল আন্দোলন করেনি? হ্যাঁ করেছে। কিন্তু অনেকের মতে, সেই আন্দোলন সিপিএমের ভিত টলাতে পারেনি। ১৯৯৩-এর একুশে জুলাই পুলিশের গুলিতে কলকাতার বুকে ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মীর মৃত্যুর পরেও শাসক বিরোধী আন্দোলন বাংলায় সেই পর্যায়ে যায়নি।
‘৯৮-এ তৃণমূল তৈরি হওয়ার পর ২০০১-এর বিধানসভা ভোটে সিপিএম চাপে পড়েছিল বটে কিন্তু সেই চাপ কাটিয়ে ড্যাংড্যাং করে ষষ্ঠ বামফ্রন্ট তৈরি হয়েছিল। কত স্লোগান দিয়েছিলেন দিদি। চমকাইতলা চমকে দেবে, কেশপুর সিপিএমের শেষপুর, গ্রাম থেকে কলকাতা-পথ দেখাবে গড়বেতা– মুখে মুখে ঘুরত সেইসব স্লোগান।
পর্যবেক্ষকদের একাংশ বলছেন, মনে রাখতে হবে ‘৭৭ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বামফ্রন্টের ধারাবাহিক জয়ের মধ্যে কেবল একবারই তারা ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল। সেটা ২০০১ সালে। তত্কালীন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস বলেছিলেন, “বাংলায় প্রতি একটা বাড়ি অন্তর একটা করে আমাদের (পড়ুন বামফ্রন্টের ভোটার) বাড়ি।” অর্থাত্ আন্দোলন হলেও সিপিএমের গণভিত্তিতে আঘাত হানা যায়নি। বামেরা মনে করেন, সেই ভিতে সিঙ্গুরও প্রথমে আঘাত হানতে পারেনি। নন্দীগ্রামই টলিয়ে দিয়েছিল। পরে নন্দীগ্রামকে দেখে সিঙ্গুর ফের জেগে ওঠে। তা ছাড়া নেতাই, ভাঙড়ের মতো ঘটনা কাজ করেছিল অনুঘটক হিসেবে।
সিপিএমকে যে হারানো সম্ভব এটা প্রথম রাজ্যের মানুষ বুঝতে পারে ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে। গ্রামীণ বাংলা ছিল সিপিএমের একচেটিয়া ভোটের জায়গা। সেবারই দেখা গেল, রাজ্যে দুটি জেলা পরিষদ হারাল বামেরা। এক নন্দীগ্রামের জেলা পূর্ব মেদিনীপুর এবং দুই দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পর্যবেক্ষকদের মতে, পূর্ব মেদিনীপুরে সেই সময়ের যাঁরা তৃণমূলকে নেতৃত্ব দিতেন এখনও তাঁরাই দেন। অধিকারী পরিবার। শিশিরবাবু, শুভেন্দুরা। কিন্তু এখন যাঁরা দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে শাসকদলের সাংসদ বা বিধায়ক রয়েছেন তাঁদের অনেকের রাজনীতিতে হাতেখড়িই তখন হয়নি।
সিঙ্গুরে রবীনবাবু বেচারাম মান্নার মতো ডাকাবুকো নেতা না হলেও সৎ হিসেবে তাঁর একটা ভাবমূর্তি রয়েছে। অন্যদিকে বেচারামের বিরুদ্ধে দলের ভিতরেই ক্ষোভ রয়েছে। অনেকে টিপ্পনি কেটে বলেন, তৃণমূলের জমানায় উন্নয়ন কেমন হয়েছে তা বেচারামকে দেখলেই বোঝা যায়। দুর্নীতি নিয়ে যখন শাসকদলের বিরুদ্ধে ভুড়ি ভুড়ি অভিযোগ উঠছে, কয়লা-গরু পাচার নিয়ে যখন রাজ্যে সিবিআই, ইনকাম ট্যাক্স অভিযান শুরু করে দিয়েছে তখন জনমানসে সৎ বলে পরিচিত রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের এহেন বিদ্রোহ শাসকদলের পক্ষে চিন্তার বলেই মনে করছেন অনেকে। কে বলতে পারে রবীনবাবু যদি দল ছাড়েন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে তাঁকে ওই সিঙ্গুরেই বিজেপি প্রার্থী করে দেবে না?
বেচারাম মান্না বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দিয়েছিলেন দুদিন আগে। তাঁকে বকাবকি করে ঠেকিয়েছেন সুব্রত বক্সী। তারপর সিঙ্গুরে পা রেখে তিনি বলেছেন, “রবীনবাবু আমার বিয়ের ঘটক ছিলেন।” প্র্তিক্রিয়ায় বৃদ্ধ মাস্টারমশাই বলেছেন, “দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে দল করা যায় না।”
তাছাড়া সিঙ্গুরের মানুষের অসন্তোষও তীব্র। না হয়েছে কৃষি, না হয়েছে শিল্প। অনেকের মতে, কার্যত আম, ছালা দুই গেছে। এ ব্যাপারে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী তো বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই দেখিয়েছেন কী ভাবে শিল্প ধ্বংস করে নোটে শাক চাষ করতে হয়।” বামেরা বলেন, “আগে সিঙ্গুরের তৃণমূল নেতারা গর্বের সঙ্গে বলতেন, ন্যানো করতে দিইনি। আর এখন আক্ষেপ করেন, কেন করতে দিইনি।”
সব মিলিয়ে যে সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রাম একদিন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছিল আজ তারই যেন পুনরাবৃত্তি কলীঘাটে। অশনিসংকেত নয়?