
উত্তম দত্ত
মৃত মানুষের সমাধি ও এপিটাফের প্রতি আমার চিরকালের কৌতূহল ও দুর্বলতা। একসময় অদ্ভুত নেশায় বিভিন্ন মানুষের সমাধি-ফলকে লেখা বিচিত্র এপিটাফ খুঁজে খুঁজে লিখে রাখতাম ডায়েরিতে। অনুভব করতে চাইতাম : জীবিত পৃথিবীর মানুষদের উদ্দেশ্যে মৃত্যুর আগে কিছু মানুষ কোন্ বার্তা লিখে রাখতে চেয়েছিল।
অকালপ্রয়াত কবি কিটসের এপিটাফ পড়লে এখনও মন বিষণ্ণ হয়ে যায় : ‘Here lies One Whose Name was writ in Water.’ এখানে শুয়ে একজন মানুষ যার নাম লেখা হয়েছিল জলের অক্ষরে। কী অসম্ভব অভিমানী পঙক্তি। এটাই যেন পৃথিবীর সমস্ত মানুষের অলিখিত এপিটাফ। এই বিশাল অন্তহীন মহাকালের উদাসীন প্রবাহে মানুষের জীবন তো জলের অক্ষরের মতোই নশ্বর।
এক শীতের দুপুরে একজন সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে অসীম কৌতূহল নিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম কলকাতার সাউথ পার্কস্ট্রিটের বিশাল সমাধি-উদ্যানে।

বড় বড় গাছের ফাঁকে ফাঁকে বিচিত্র গড়নের সমাধিনিবাস। ফলকের গায়ে উৎকীর্ণ তাদের নশ্বর জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। একটা আশ্চর্য আরণ্যক পরিবেশ। জীবিত মানুষেরা এখানে উচ্চকণ্ঠে কথা বলে না, পাছে ঘুমন্ত মানুষদের মায়ানিদ্রা ভেঙে যায়। কবরের বিন্যাসেও যে এত শৃঙ্খলা থাকতে পারে তা এখানে এলেই বোঝা যায়। সমাধি-শৈলীর মধ্যেও যে এত বিচিত্র গথিক সৌন্দর্য ও শিল্পের ছোঁয়া থাকতে পারে তা এখানে না এলে অনুভব করা যাবে না। সারি সারি সাজানো কবর ও বৃক্ষের মাঝখান দিয়ে মানুষের চলাচলের পথ। সেই ছায়াচ্ছন্ন পথ ধরে দুপাশের শায়িত মানুষদের মধ্যে দিয়ে আমরা সন্তর্পণে হেঁটে যেতে থাকি।

প্রথমে মনে হয়েছিল আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই এখানে। কিন্তু অস্পষ্ট ছায়ার মধ্যে হঠাৎ চোখে পড়ল কয়েকটি তরুণ কিন্নর-যুগল আত্মমগ্ন ভঙ্গিতে বসে আছে অরণ্যের আড়ালে আবডালে। বন্ধুটি মৃদু কৌতুকের সুরে বলল : ‘ মৃতের নগরীতে জীবনের স্পন্দন।’
সত্যিই তো মানুষের এই প্রেম প্রীতি ভালোবাসা আত্মার মতোই অবিনাশী। আগুন একে দগ্ধ করতে পারে না। কালের খঞ্জর একে জীর্ণ করতে পারে না। শাণিত তরবারি একে খণ্ড খণ্ড করতে পারে না। কবরের নীচের ঘুমন্ত মানুষেরাও হয়ত এইসব কিন্নরযুগলের অস্ফুট কণ্ঠস্বর শুনে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শোয়।
শুনেছি এখানে ‘গোরস্থানে সাবধান’ ছবির শ্যুটিং হয়েছিল। একবার একটি কবর থেকে মূল্যবান পাথরের পদ্ম চুরি হয়ে যায়। তা নিয়ে কিছুদিন হৈচৈ হয়েছিল। বিকেল পাঁচটায় এই সেমেট্রির প্রবেশদ্বার বন্ধ হয়ে যায়। রাত্রির পরিবেশ হয়ে ওঠে অলৌকিক ও আধিভৌতিক। তখন মৃত মানুষেরা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে। চাঁদের মাটিতে নির্ভার মানুষের মতো অন্ধকারে হেঁটে বেড়ায় তারা। সেই রহস্যময় ভৌতিক তমসার মধ্যেও মানুষের চুরি করতে ইচ্ছে করে? এসব ভেবে মনে মনে বিষণ্ণ ও বিস্ময় বোধ করছিলাম।
উইলিয়াম জোনস, জর্জ বোগলে, কলিন ম্যাকেঞ্জি, জন ফেন্ডাল, অগস্টাস ক্লিভল্যান্ড, রবার্ট কিড, এডওয়ার্ড কুক… কত অজানা অচেনা মানুষের নাম ও পরিচয় লিপি পড়তে পড়তে হঠাৎ চোখে পড়ে ৩৬৩ নম্বর কবরের ফলকে কোনও নাম নেই। শুধু লেখা আছে : ‘আ ভার্চুয়াস মাদার’। সঙ্গে মৃত্যুর সময় : ১৮২৫… কোন অপরিচিত নামগোত্রহীন মা শুয়ে আছেন এখানে, কে জানে! একটি ফলকে দেখলাম ১৭ বছরের এক সৈনিকের নাম। সাতসমুদ্র পার হয়ে এখানে যুদ্ধ করতে এসে সদ্য তরুণটি আর ফিরে যায়নি স্বদেশে। শুয়ে আছে কলকাতার মাটিতেই। শায়িতদের মধ্যে অনেকেই দেখলাম কোম্পানির আমলের সৈনিক।
একসময় একটি সমাধি দেখিয়ে সাংবাদিক বন্ধুটি বলল : ‘লক্ষ করেছ, এই সমাধির শৈলীতে হিন্দু মন্দির, ঐশ্লামিক মসজিদ আর গির্জার আদল রয়েছে!’
ওটাই ছিল আসলে চার্লস স্টুয়ার্টের কবর। তাঁর হিন্দু-ধর্মপ্রীতির কথা জীবিতকালেই কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিল। লোকে তাঁকে ডাকত ‘হিন্দু স্টুয়ার্ট’ বলে। লেখক ও সৈনিক এই মানুষটির ধর্মীয় উদারতার স্বাক্ষর আজও গৌরবের সঙ্গে বহন করছে তাঁর সাজানো সমাধিগৃহ। এখান থেকেই চোর এসে মধ্যরাতে খুলে নিয়ে গিয়েছিল পদ্মের মোটিফ। তারপর থেকে সি সি টিভির নজরদারি বেড়েছে। রাত্রিতে কুকুর ছেড়ে পাহারা দেবার কথাও ভাবা হয়েছিল। অবশ্য কুকুর কিংবা গোপন ক্যামেরা কোনওটাই আমাদের চোখে পড়েনি। আছে হয়ত।
পথের সংকেত থাকা সত্ত্বেও আমরা খুঁজে পাচ্ছিলাম না ডিরোজিওকে। একসময় বাঁ দিকে আঙুল দেখিয়ে বন্ধুটি একটু উচ্ছ্বাসের সঙ্গেই বলল : ‘ওই তো ওখানে ডিরোজিওর সমাধি।’
একটু দ্রুত পা চালিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম সেদিকে। আহ, এই তো আমার সেই স্বপ্নের পুরুষ, আমার লাইটহাউজ, প্রিয় অধ্যাপক।
মনে পড়ল ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় উৎপল দত্তের ‘ঝড়’ ছবিটি দেখতে যাওয়ার কথা। পানাগড়ের একটি সিনেমাহলে ব্ল্যাকে টিকিট কেটে দেখেছিলাম ডিরোজিওর জীবনের শেষ দুই বছরের ঘটনার উপর আশ্রয় করে বানানো এই ছবিটি।
একটি দৃশ্য আজও মনে পড়ে। রক্ষণশীলদের চক্রান্তে আর কিছু ঈর্ষাকাতর শ্বেতাঙ্গ শিক্ষকের ষড়যন্ত্রে তখন হিন্দু কলেজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে রেনেসাঁসের প্রতিমূর্তি বাইশ বছরের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওকে। নিদারুণ অর্থকষ্টে দুবেলা খাবার জুটছে না তাঁর। প্রাণের চাইতে প্রিয় বইপত্রগুলি একে একে বিক্রি করে দিচ্ছেন তিনি। দুদিনের উপবাসী ডিরোজিওকে সর্বসমক্ষে অপমান করার জন্য নিমন্ত্রণের ছলে বাড়িতে ডেকে পাঠান শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেববাহাদুর। সেখান তাঁর নামে একজন সতীকে ধর্ষণ করার মিথ্যে অভিযোগ আনা হল। ভয় দেখিয়ে নেশাগ্রস্ত সতীকে দিয়ে সেই অভিযোগ বলানো হল। একদিন সহমরণের চিতা থেকে এই মেয়েটিকে উদ্ধার করে এনেছিল ডিরোজিওর ছাত্ররা। তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন অসহায় মেয়েটিকে।…
খাবার তো জুটলই না, বরং সকলের সামনে তাঁর গলায় পরিয়ে দেওয়া হল জুতোর মালা। মাথা নীচু করে বোন এমিলিয়ার হাত ধরে নিঃশব্দে বাসায় ফিরে এলেন ক্ষুধার্ত ও অপমানিত ডিরোজিও। ওই দৃশ্যে চোখে জল এসে গিয়েছিল আমার।
অন্য একটি দৃশ্যে বহিষ্কৃত ডিরোজিও বাড়িতে বসে আছেন। ঘরে এককণা খাদ্যশস্য নেই। তাঁর প্রিয় ছাত্ররা অনেকেই এসেছেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। ততদিনে চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে গেছে তাঁর। সেই অবস্থাতেও ছাত্রদের কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে অন্ধের মতো ছুঁয়ে ছুঁয়ে একে একে প্রত্যেকের নাম বলে যাচ্ছেন নির্ভুলভাবে : ‘কে তুমি রাধানাথ শিকদার?… দিগম্বর? হাউ আর ইউ মাই বয়?… কৃষ্ণমোহন?…রামতনু… রামগোপাল… গোবিন্দ… আমার গোবিন্দ্… আমি জানি, ডিরোজিও চলে গেলেও ডিরোজিয়ানরা থাকবে।’

এই দৃশ্যটি দীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছর পরেও জীবন্ত ছবির মতো মনে গেঁথে আছে। তখনও ভাবিনি ভবিষ্যতে অধ্যাপনা করব। কিন্তু মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম যদি কখনও শিক্ষক হই, ডিরোজিও মতো ভালোবাসব ছাত্রদের। অন্ধকারে এভাবেই আলো জ্বালিয়ে দেব।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে হিন্দু কলেজে শিক্ষকতায় যোগদান করেন তিনি। এবং রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। স্কটিশ কবি ও নাস্তিক যুক্তিবাদী শিক্ষক ডেভিড ড্রামন্ডের ছাত্র ডিরোজিও নিজের ছাত্রদের প্রতিনিয়ত বলতেন : ‘বিনা বিচারে বিনা জিজ্ঞাসায় কোনও প্রচলিত বিশ্বাস, সত্য ও রীতিনীতিকে মেনে নিও না। সত্যকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করো।’
বলতেন : ‘কোনও মানুষ এত বড় নয় যে, তাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে হবে।’
তাঁর এইসব দুঃসাহসী কথা অন্ধ ভক্তিবাদের মূলে চরম কুঠারাঘাত করেছিল সেদিন। সাহিত্য ছাড়াও তিনি দর্শন, ইতিহাস, দেশ বিদেশের সামাজিক সংস্কার ও তার বিবর্তন নিয়েও ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতেন। ক্লাসে, ক্লাসের বাইরে, করিডারে, নিজের বাড়িতে সর্বত্রই তিনি ছিলেন এক চৌম্বক ব্যক্তিত্ব। তাঁর ছাত্রদের নামে নানা নিন্দা প্রচলিত থাকলেও তাঁদের অনেকেই পরবর্তীকালে জীবনের নানা ক্ষেত্রে অপরিসীম মেধা ও মনীষার স্বাক্ষর রেখেছেন।

ডিরোজিওর এই অলোকসামান্য জনপ্রিয়তাই তাঁর শত্রু হয়ে উঠল। তাঁর মুক্তমনের স্বাধীন চিন্তাই তাঁকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। শুরু হল তাঁর নামে নানা অপপ্রচার। তিনি নাকি ছাত্রদের মধ্যে অবিশ্বাস, অধর্ম আর নাস্তিকতার বিষ ছড়াচ্ছেন। তিনি নাকি গুরুজনদের অশ্রদ্ধা করতে শেখাচ্ছেন। তিনি নাকি ভাই বোনের বিবাহকে সমর্থন করেন।
ক্লাসে মিশরের ইতিহাস পড়াতে গিয়ে তিনি একদিন বলেছিলেন : রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য প্রাচীন কোনও কোনও জাতি ভাই ও বোনের মধ্যে বিবাহ দিত। এই ক্লাস লেকচারও তার বিরুদ্ধে ধারালো অস্ত্র হয়ে উঠল। সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বলে গোঁড়া হিন্দু মৌলবাদীরা তাঁর বিরুদ্ধে বহুদিন ধরেই বিষ উগরে দিচ্ছিল। তাঁর ‘দ্য ফকির অব জঙ্ঘিরা’ নামের কবিতার বইটিও ছিল সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে একটা জ্বলন্ত প্রতিবাদ। কলেজের পরিচালন সমিতিও অভিযোগ করতে শুরু করল, ডিরোজিওর জন্যই হিন্দু কলেজে ছেলেদের পাঠাতে চাইছেন না অভিভাবকেরা। কলেজ ক্রমশ ছাত্রশূন্য হয়ে যাচ্ছে। শো কজ করা হল তাঁকে। বিচারের নামে প্রহসন হল। ভোটের নামে মস্করা করা হল।
নাস্তিকতা প্রচারের অভিযোগে প্রায় সমকালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কবি শেলিকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। যুক্তিবাদী ও নির্ভীক সত্যের উপাসক ডিরোজিওকেও নির্মমভাবে বহিষ্কার করা হল। এর অল্প কিছুকাল পরেই দুরারোগ্য কলেরায় মারা যান তিনি। মৃত্যুর পরেও প্রতিপক্ষ স্তব্ধ হয়নি। খ্রিস্টান সমাধিক্ষেত্রে তাঁর মতো নাস্তিকের মৃতদেহ সমাধিস্থ করতে গেলে প্রবল বাধা দেওয়া হয়। অবশেষে মূল সমাধিক্ষেত্রের বাইরে একপ্রান্তে মাটির নীচে শায়িত করা হয় তাঁকে। সমস্ত জীবন যিনি অন্ধকারে আলো জ্বালাতে চেয়েছেন মৃত্যুর পরে তাঁর ঠাঁই হল অবজ্ঞা আর অবহেলার অন্ধকারে। মৃত্যুর পরেও তিনি প্রান্তিক মানুষ হয়েই রয়ে গেলেন।
কলকাতার এংলো ইন্ডিয়ান সোসাইটি এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখন তাঁর সমাধির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তদারকিতে চলে পুরো সমাধিক্ষেত্রটি। ২৬ শে ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যুদিনে অনেকেই দেখলাম প্রচুর ফুল দিয়ে গেছেন তাঁর কবরে। আমার বন্ধুটি সেসব দেখে বিমর্ষ কণ্ঠে বলল : ‘বেঁচে থাকতে যাঁকে নিত্য অপমান ও ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে, আজ তাঁর কবরে কত ফুল!’
১৮০৯ থেকে ১৮৩১ মাত্র ২২ বছরের জীবনেই জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর এই তরুণ অধ্যাপক। এই আলোর রথের সারথি। মনে মনে তাঁকে সহস্র প্রণাম জানিয়ে শীতের সমাধিক্ষেত্র থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসি আমরা। আমাদের সেই প্রণামের মধ্যে ছিল একটি ব্যাকুল প্রার্থনা : এই যুক্তিহীন হিংস্র ধর্মান্ধতার দেশে আবার জন্ম নিক হেনরি ডিরোজিও।
লেখক কোচবিহার নিবাসী উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষার অধ্যাপক, কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। কবিতা ও গদ্যের জন্য পেয়েছেন একাধিক সম্মান ও স্বীকৃতি।