
অংশুমান পাল
আজকে যেখানে কলেজ স্ট্রিট সেইখানে পনেরাে-কুড়ি হাজার বছর আগেও কি মানুষের বসতি ছিল? যদি না থাকে, পৃথিবীর অন্য কোনও প্রান্তে তাে মানুষের বসতি ছিলই। সেই সব মানুষেরা বৃষ্টি কিংবা তুষারপাতের সময় গুহার মধ্যে বসে সময় কাটাবার জন্য ছবি এঁকেছেন। বই অবশ্য তার অনেক পরের কথা। তার আগে সে গল্প বলতে শিখেছে; আরব বেদুইনদের মধ্যে অবশ্য এখনও আড্ডায় গল্প বলার প্রথা প্রচলিত আছে। কিন্তু এখন মানুষ গৃহবন্দি হয় না, অতিমারীর জন্য গৃহবন্দি হলেও ভারচুয়ালি সে সমস্ত পৃথিবীর সাথেই যুক্ত ছিল। আড্ডাও খুব সংক্ষিপ্ত সংলাপে সারা হয়ে যায় ভারচুয়ালি, সেখানে গল্প বলার প্রশ্নই ওঠে না।
এই ভারচুয়াল জগতের প্রকোপে মানুষ কি হারিয়ে ফেলেছে বই পড়ার অভ্যাস ? থেকে থেকেই এই প্রশ্ন উঠেছে, তারপর এক সময় সেই বাদানুবাদ ঠান্ডাও হয়ে গেছে। কিন্তু যিনি পাঠক বা যিনি বই পড়তে ভালােবাসেন, তিনি অবিচল থেকেছেন তাঁর বই পড়া নিয়ে। নয়তাে ভাবুন না, দেশের সব থেকে বৃহত্তম বই-এর বাজার কলেজ স্ট্রিট বা বইপাড়া যখন গত বছরের অতিমারী ও আমফানের ছােবলে বিপর্যস্ত তখন পাঠকেরাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ছােট ছােট বইয়ের দোকানগুলি ও ক্ষুদ্র প্রকাশকদের আর্থিকভাবে সহায়তা করার জন্য। তাই বলছিলাম, কোনও কিছুই প্রকৃত পাঠকের ব্যাঘাত করতে পারে না।আর অতিমারীর মধ্যেও কলেজ স্ট্রিটের সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের দোকানে এখনও পাঠক পাবেন। বােধহয় এদের সৌজন্যেই কলেজ স্ট্রিট হয়ে উঠেছে সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের বিশ্বের বৃহত্তম বাজার। সেই সমস্ত পাঠকদের জন্য, এই সরস্বতী পূজায় ‘দ্য ওয়াল’এর পাতায় একজন অর্বাচীন পাঠক শােনাচ্ছে বই পড়ার কিছু অভিনব পরিবেশের কথা, যেখানে বইটা যাই হােক না কেন, পরিবেশটা আপনাকে বইটির প্রেমে পড়তে সাহায্য করবেই। আর সরস্বতী পুজো মানেই তাে বাঙালির ভ্যালান্টাইনস ডে, আমরা না হয় বইপ্রেমিদের বইয়ের সাথে রােম্যান্টিক হওয়ার পরিবেশে নিয়ে যাব।
ঘুরতে ঘুরতে বই পড়া
কলেজ স্ট্রিট বই-পাড়া হলেও নিরিবিলিতে বই পড়ার জায়গা খুঁজতে গিয়ে বিমর্ষ হতে হয়। তাই কলেজ স্ট্রিটকে এখানেই বিদায় জানাতে হল। শুনেছি সম্প্রতি কলকাতায় লঞ্চে লাইব্রেরি খােলা হয়েছে। তার সন্ধান নিতে হাজির হলাম পশ্চিমবঙ্গ পরিবহন নিগমের অফিসে। সেখানে জানতে পারলাম বােট লাইব্রেরির কথা, আর গত বছর সেপ্টেম্বর ও নভেম্বর মাসে শুরু হওয়া যথাক্রমে ‘বেঙ্গলি ট্রাম লাইব্রেরি ও ‘ইয়ং রিডার্স ট্রাম কার’ নামে আখ্যায়িত তিন তিনটি ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগারের কথা।
ঘুরতে বের হলে বই আমরা অনেকেই পড়ি, এমনকি পরিচালক তপন সিংহও উপভোগ করতেন ভ্রমণরত অবস্থায় পড়তে। কিন্তু ঘােরার সাথে সাথে যদি একটি সম্পূর্ণ বইয়ের জগৎও ঘােরে, তাহলে তার অভিজ্ঞতা কেমন হতে পারে? সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে মিলিনিয়াম পার্ক জেটি থেকে টিকিট করে উঠে বসলাম ‘ইয়ং রিডার্স বােট লাইব্রেরিতে।

এমন দু–একটা জিনিস ওখানে বই পড়ার মধ্যে আছে যা সত্যিই বিরল। এক, গঙ্গাবক্ষের নিরিবিলিতে একটি স্নিগ্ধ হাওয়ার মধ্যে বই পড়া, দুই, বই এর সংগ্রহ। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম রবীন্দ্রনাথ থেকে সুনীল ছাড়াও আছে বর্তমান কালের লেখকদের প্রবন্ধ সংকলনও।
বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা রেখেই বলতে হয়, প্রবন্ধের পাঠক এখন কম আর প্রচলিত বই এর দোকানে প্রবন্ধের বই পেতেও বিশেষ প্রয়াস করতে হয়। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, আর বই পড়ার পরিবেশের কথা যদি বলতেই হয়, তাহলে উল্লেখ করতে হয় যদুবাবুর বাজারে ‘খালসা বুক হাউস’-এর কথা। পাঞ্জাবি এই বইয়ের দোকানে বাংলা প্রবন্ধের বই খুবই কম, তবু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে বই পড়াে, বই না কিনলেও সর্দারজি দোকানদার কিছুটি মনে করবেন না।
এবার বরং কলকাতা ছেড়ে চলে যাই রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে, যেতে যেতে ইচ্ছে হলে ট্রেনেও বই পড়ে নিতে পারেন। তবে আগেই বলে রাখি শান্তিনিকেতনে গেলেও বিশ্বভারতীর গ্রন্থনবিভাগ আমাদের গন্তব্য নয়, কারণ এ লেখার উপপাদ্য কোন চিরাচরিত গ্রন্থাগার নয়। আমি বরং গিয়েছিলাম বিশ্বভারতীর ক্যাম্পাস সংলগ্ন ‘সুবর্ণরেখা’ বইয়ের দোকানটিতে। এখানে বই কেনা বা পড়ার থেকে ভালাে লাগে, দোকানে আসা পাঠকদের বই বিষয়ে কথপােকথন। তার জন্য কোনও অধ্যাপক বা ডিগ্রীর প্রয়াজেন নেই, শুধুমাত্র বই প্রেমের যােগ্যতাই এখানে যথেষ্ট।

এই প্রসঙ্গে আমেরিকার ‘বানর্স এ্যান্ড নবেল’ (Barnes & Noble) এর বইয়ের দোকানগুলির কথা সেরে নিই, বিখ্যাত এই বই বিক্রেতাদের দোকানে কেবল বই বিষয়ে কথােপকথনের ব্যবস্থা নয়, আছে হাল আমলের প্রযুক্তি প্রয়ােগ করে বুক রিডিং–এর ব্যবস্থাও। কিন্তু সে তাে আমেরিকা, আমাদের মতন একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশে যেখানে করােনার ছােবলে অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা, সেখানে বই কেনাও এখন অনেকের কাছে সাধ্যাতীত আর বুকরিডিং সেশন আয়ােজন করা বইয়ের দোকানের কাছে এখন বিলাসিতা। সত্যিই কি তাই? চলুন উত্তর খুঁজতে আমরা যাই উত্তরবঙ্গে।
বইমেলাতে বুক-রিডিং
গত মাসেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল জলপাইগুড়ি জেলা বইমেলা মালবাজার শহরে। মেলা প্রাঙ্গনটিও সাজানাে হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত বইয়ের রেপ্লিকা দিয়ে আর এইভাবে বইয়ের বড় আকারের রেপ্লিকা দিয়ে বইমেলা সাজানাে যা উত্তরবঙ্গের অন্য কোন জেলা বইমেলায় দেখিনি। তবে হ্যাঁ কলকাতা ‘ইয়ং রিডার্স ড্রাম কার’ এর অন্তরসজ্জায় ব্যবহৃত হয়েছে বই এবং বই সংক্রান্ত শিশু–কিশােরদের আঁকা ছবি নিয়ে। বইকেন্দ্রিক কিছু দিয়ে কোন পরিবেশ সাজানাে থাকলে তা বই পড়তে আরাে ভালাে লা্গে। শুনেছি, বই–এর মাঝে নিরিবিলিতে বই পড়তে বনফুল নিয়মিত সকালে হাজিরা দিতেন ভাগলপুর স্টেশনের হুইলার স্টলে। সেখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বই পড়তেন তিনি।

দেখুন তো, কথায় কথায় কোথায় চলে এসেছি। কী যেন বলছিলাম! ও হ্যাঁ জলপাইগুড়ি জেলা বইমেলার কথা যেখানে মালবাজার পৌরসভার উদ্যোগে আয়ােজন করা হয়েছিল বিভূতিভূষণকে কেন্দ্র করে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এক বুক রিডিং সেশন। সমগ্র মঞ্চটিকেই বড় সুন্দর করে প্রযুক্তি দিয়ে সাজানাে হয়েছিল বিভূতিভূষণের নানান ছবি ও তাঁর বই–এর প্রচ্ছদ দিয়ে। পড়া হচ্ছিল বিভূতিভূষণের ‘অনুবর্তনও ‘কিন্নর দল’ আর পড়ার ফাঁকে ফাঁকেই মঞ্চে উপস্থত শ্রোতারা জানাচ্ছিলেন পাঠ্যাংশের সাথে তাদের অভিব্যক্তি এবং তাদের সেই উচ্চারণের জন্য তাদের উপহার দেওয়া হচ্ছিল বিভূতিভূষণের লেখা বই।

কোচবিহার বইমেলাতেও শুনেছি বুকরিডিং এবং বুক রিডিংকে শ্রোতাদের মর্মে পৌঁছানােটা অকেটাই নির্ভর করে বুক রিডার–এর বাচনভঙ্গির ওপর। তপন সিংহ তার আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন, যে কৈশােরে তার শরৎচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তরুণ মাষ্টারমশাই ও সুললিত কণ্ঠের অধিকারী বিনুদা স্যারের গলায় ‘শ্রীকান্ত’ এর পাঠ শুনে। তবে বুকরিডার ছাড়াও পরিবেশ ও সময় এবং স্থানও অনেকটা নান্দনিক করতে পারে বই পড়ার অভিজ্ঞতাকে। যেমন কোচবিহার শহরেই, ঐতিহাসিক সাহিত্যসভা ভবনটিতে গায়ত্রী দেবীর জন্মদিনে আয়ােজন করা হয়েছিল গায়ত্রীদেবীর আত্মজীবনীকে কেন্দ্র করে বুক রিডিং সেশন।রবীন্দ্রনাথ যেখানে যেতেন তাঁর সাথে বইপত্রও যেতাে প্রচুর এবং ভ্রাম্যমান অবস্থায় তাঁর বইপড়ার কথা শুনিয়েছেন রথীন্দ্রনাথ ‘পিতৃস্মৃতিতে। এহেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য–এর বই ‘রেল ভ্রমণে রবীন্দ্রনাথ’ নিয়ে এক বুক রিডিং সেশন এর ব্যবস্থা করেছিল পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন বিভাগ আর বই পড়ার স্থানটি ছিল দার্জিলিং-গামী টয়ট্রেন।
রবীন্দ্রনাথের মতন বহুবিদ্যার চর্চা ও পাঠক অতি বিরল। আর এখন তাে সাধারণ পাঠক ও গল্প বলার লােকেরও অভাব। সেক্ষেত্রে বইমেলাগুলি নতুন পাঠক তৈরী করার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন ফ্রাঙ্কফুটের বিশ্ববইমেলার কথা ধরা যাক। সেখানে শ্রেষ্ঠ পাঠক থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট টাকার বই কিনলে পুরস্কার থেকে বুকরিডিং সেশন, বই ও লেখক নিয়ে প্রযুক্তির সাহায্যে আবহ তৈরী ; দারুণ সব অভিনব ব্যাপারের আয়ােজন করা থাকে।

প্রসঙ্গত বলি ফ্রাঙ্কফুটের এই ‘বিশ্ববইমেলা’তেই ১৯৮৬ সালে ভারতে বিশেষ আকর্ষণ আর সে মেলায় আমন্ত্রিত লেখক হিসেবে যােগ দিয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তবে যা ফ্রাঙ্কফুটে তথা জার্মানিতে সম্ভব, তা কি আমাদের মতন একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশে সম্ভব? অন্য রাজ্যের কথা জানা নেই, তবে এ রাজ্যের মালবাজার শহরের যে বইমেলার কথা বলেছিলাম সেখানে প্রতি ৫০০টাকার বই কিনলে একটি উপহার পাওয়া যাচ্ছিল। কী ছিল তা জানার জন্য চলে আসুন আগামী বছরের জলপাইগুড়ি জেলার বই মেলায়। বই কিনুন। বই পড়ুন, এমনকি সরস্বতী পূজার দিনেও বই পড়ুন।
ফটোক্রেডিট: নীলদিগন্ত সাহা