
অংশুমান কর
আজ আমাদের ছুটি। এই একটা দিন আমরা ছুটি নেব। নেবই নেব। কেউ আমাদের গান গাইতে দেখবে না, কিন্তু আজ আমরা গান গাইব। কেউ আমাদের নাচতে দেখবে না, কিন্তু আজ আমরা নাচব। কেউ আমাদের কবিতা বলতে দেখবে না, কিন্তু আজ আমরা কবিতা বলব। মৃত, নিরন্ন, অসহায় মানুষদের সম্মুখে আজ সঙ্গীত, নৃত্য, কবিতা সবই বড় অশ্লীল দেখাবে। তাই আজ কিচ্ছুটি করব না আমরা। কিন্তু, কিচ্ছুটি না করেও, ঘরের মধ্যে চুপটি করে বসে থেকেই আমরা গাইব, নাচব, কবিতা বলব। আজ কেউ আর আমাদের রুখতে পারবে না। এই একটা দিন আমরা ছুটি নেব।
বলছি বটে দিন, কিন্তু এ তো আসলে সন্ধ্যা। দিন তো লুকিয়ে পড়েছে দিগন্তের আঁচলের তলায়। ভ্রম নয়, ধরিত্রী প্রতিশোধ নিয়ে সত্যিই দিনকে বানিয়ে দিয়েছে সন্ধ্যা। আর অন্তরিন থেকে আমরা আজ কত কত দিন ধরে পাহাড়ের কোলে পাথর ভেঙে চলেছি। ভেঙেই চলেছি। আমাদের মুঠি এবার শ্রান্ত হয়ে এসেছে। আজ আর আমরা ভাঙব না পাথর। অন্যায় হবে না যদি আজ আমরা একটা ছুটি নিই। অন্যায় হবে না কেননা কবি তো সেই কবেই লিখে গিয়েছেন:
‘এবার হয়েছে সন্ধ্যা। সারাদিন ভেঙেছ পাথর
পাহাড়ের কোলে
আষাঢ়ের বৃষ্টি শেষ হয়ে গেল শালের জঙ্গলে
তোমারো তো শ্রান্ত হল মুঠি
অন্যায় হবে না–নাও ছুটি
বিদেশেই চলো
যে-কথা বলোনি আগে, এ-বছর সেই কথা বলো’।
সত্যিই এই অন্তরিনে পাথর ভেঙে ভেঙে শ্রান্ত হয়ে পড়েছে আমাদের মুঠি। আমাদের অশ্রু বৃষ্টি হয়ে ঝরে ঝরে থেমে গেছে শক্ত-সমর্থ কাজ-হারানো জোয়ান মানুষের শালের জঙ্গলে। অন্যায় হবে না তাই আজ একটা ছুটি নিলে। অন্যায় হবে না আজ বিদেশে গেলে।
বিদেশ? এই অসময়ে? বিদেশই তো। যে দেশে আগে যাইনি, সেই তো আমাদের বিদেশ। আজ যাব সেই বিদেশে। বলব সেই কথা যে কথা আগে বলিনি কোনওদিন। কিন্তু, আছে কি এমন কথা, যেকথা আমরা বলিনি আগে? যুবক বাতাস বলল, আছে, আছে, আছে। যুবতী নদীটি বলল, আছে, আছে, আছে। প্রৌঢ় সমুদ্র বলল, আছে, আছে, আছে। শিশু পুষ্করিণী বলল, আছে গো, আছে। বৃদ্ধ পর্বত বজ্রনিনাদে বলল, আছে।
শুনতে শুনতে, ভাবতে ভাবতে, আমাদের না গাওয়া গানের মধ্যে থেকে উঠে দাঁড়াল গান, আমাদের মুদ্রাহীন শরীরী মুদ্রার মধ্যে থেকে উঠে দাঁড়াল নাচ, আমাদের না বলা কবিতার মধ্যে থেকে তালগাছের মতো মাথা উঁচু করে একপায়ে দাঁড়িয়ে পড়ল কবিতা আর তারা সবাই মিলে খুঁজে পেল যে কথাটি বলা হয়নি আগে, সেই কথা।
কিন্তু সেই কথা বলতে গেলে তো যেতে হবে বিদেশে। কোথায় বিদেশ? কোথায়? কেন, আমাদের মনের গহীনে যে দেশ, সেই দেশে আমরা ক’জন গেছি? সেই দেশে যাওয়ার ভিসা মেলে বড় কষ্টে। কিন্তু আজ যদি চাও, এই সীমান্তবিহীন পৃথিবীতে যেতে পারো সেই দেশে। আজ আর কারও ভিসা লাগবে না।
চলো, চলো, যাই ওই বিদেশে। আজ আমাদের ছুটি। আজ আমরা আর ভাঙব না এই অন্তরিনের পাথর। আজ আমাদের অশ্রু আর আমরা ঝরাব না শালের জঙ্গলে, বরং বলব সেই কথা, যেকথা বললে আর কোনওদিন অশ্রু ঝরাতে হবে না আমাদের, যেকথা বললে, আর কোনওদিন পাহাড়ের কোলে ভাঙতে হবে না পাথর, যেকথা বললে, দিন দিগন্তের আঁচলের তলা থেকে আবার বেরিয়ে এসে কোষমুক্ত অসির মতো একফালি নবীন ঊষা হয়ে আলোকবর্তিকা বয়ে আনবে আমাদের এই অন্তরিন জীবনে।
আজ পয়লা বৈশাখ। আজ আমরা একটা ছুটি নেব। নেবই নেব। আজ আমরা যাব মনের গহীনে সেই বিদেশে, বলব সেই কথা, যেকথা বলিনি আগে। করজোড়ে বলব, হে ধরিত্রী, হে বসুধা, তুমি আমাদের ক্ষমা করো।
আগের পর্বগুলি…
দূরের পথ দিয়ে ঋতুরা যায়, ডাকলে দরজায় আসে না কেউ
আমি কি এ হাতে কোনও পাপ করতে পারি?
শিশুদের ভাল রাখার উপায় সম্বন্ধে যে দু-একটি কথা আমি জানি