
অংশুমান কর
আমাদের বৈঠকখানা-কাম-লাইব্রেরিতে একটা তির-ধনুক রাখা আছে। সেই কবে কিনেছিলাম। ‘কৃষ্ণসায়র উৎসব’ থেকে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আবাসনে থাকি, তার গায়েই কৃষ্ণসায়র। বিশাল এক জলাশয়। সেটিকে দীর্ঘদিন পার্কে রূপ দেওয়া হয়েছে। পার্কটি প্রেমিক-প্রেমিকাদের স্বর্গোদ্যান। তো, সেই পার্কের ভেতরে পরিবেশবিধি যতদূর সম্ভব মেনেই ফি-বছর জানুয়ারির পয়লা তারিখে আয়োজিত হত এক উৎসব। ভারত সরকারের নানা মন্ত্রকের সহযোগিতা থাকত এতে। এর ফলে এই উৎসবটি এক অন্যমাত্রা পেয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন রাজ্য থেকে লোকশিল্পীরা তাঁদের পসরা সাজিয়ে আসতেন এই উৎসবে। আসত লোকনৃত্য আর সংগীতের নানা দল। মৃদুল সেন ছিলেন এই উৎসবের হোতা। রাজ্যে ক্ষমতা পরিবর্তনের পরে এই উৎসবটি বন্ধ হয়ে যায় দু’বছরের মধ্যেই। সে অবশ্য অন্য কথা। এই উৎসব থেকেই একবার এক সাঁওতাল দম্পতির কাছ থেকে কিনেছিলাম ওই তির-ধনুক। বাঁকানো ধনুক। বেতের ছিলা। আর পালক লাগানো চারটি তির। প্রত্যেকটির মাথায় তীক্ষ্ণ লোহার ফলা। চারটির আকৃতি চাররকম। কেনার সময় সাঁওতাল পুরুষটি আমাকে বলেছিলেন, “এ কিন্তু সত্যিকারের তির। শুধু সাজিয়েই রাখবেন। চালাবেন না যেন। আপনারা বাবুলোক, চালাতে পারবেন না। বিপদ হবে”। চালাইনি। বাঁশের তূণের মধ্যে বন্দি হয়ে আছে তিরগুলি। পাশে বছরের পর বছর ধরে ঝুলে রয়েছে ধনুক।
ঝুলে থাকতে থাকতে ওরা এমনই অংশ হয়ে গিয়েছিল ঘরটির যে খেয়ালই করতাম না আগে। এই অন্তরিন অবস্থায় চোখে পড়ছে বারবার। বারবার মনে হচ্ছে যে, তিরগুলি বের করে আনি। নিক্ষেপ দাবি করছে ওরা। কিন্তু ছুড়ব কার দিকে? সে এক মহাপ্রশ্ন তো বটেই। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে যে, এই যে ভুলভালগুলো হচ্ছে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে, সেই ভুলগুলোকে তির মেরে বধ করি। অবশ্য ভুলগুলোকে তির মারলে হবে না। ভুলের কারণগুলোকেও তির মারতে হবে। সেই তিরই মারতে হবে আগে। যেমন এই যে শ্রমিকরা বারবার লকডাউন ভেঙে বেরিয়ে আসছেন বাইরে, এরা যে এভাবে বেরোবেনই সেকথা অনেকেই বলেছেন। বলেছেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বলেছেন যে, এই শ্রমিকদের হাতে যদি সরাসরি অর্থ তুলে না দেওয়া যায়, তাহলে এরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন। তখন দীর্ঘদিন ঘরে বন্দি হয়ে এঁরা থাকবেন না। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে এইরকম একটি পদক্ষেপ দেরিতে হলেও নেওয়া হল। মন্দের ভাল। কাল থেকে অনেকগুলি কাজের ক্ষেত্রও খুলে দেওয়া হচ্ছে। দেখলাম অনেকেই এতে আতঙ্কিত। কিন্তু সত্যি বলতে কী, কাজের এই ক্ষেত্রগুলি আর না খুলে উপায়ও নেই। কারণ, অর্থনীতির অবস্থা এরই মধ্যে খুবই খারাপ। এই রকম চলতেই থাকলে ব্যাঙ্কগুলি হয়তো দেউলিয়াই হয়ে যেতে পারে। কাজ দরকার। বিশেষ করে গরিব মানুষদের কাজ দরকার। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হলে মানুষের হাতে টাকা পৌঁছনো প্রয়োজন। বরং বিমান বোধহয় আরও পরে চালানো যেতে পারত। দেশের যা অবস্থা, তাতে আইটি সেক্টরটিকেও খুলতে হবেই। কিন্তু এটাও ঠিক যে, কাজের এই ক্ষেত্রগুলি খুললে সংক্রমণ ছড়িয়ে যেতে পারে সংক্রমণ ঠেকানোর সব ক’টি প্রোটোকল মেনে কাজ না হলে। ওই সেই আবার উভয়সংকট। শাঁখের করাত অবস্থা। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে তির মারি এই শাঁখের করাতটিকেও। শাঁখেরই তো করাত। তিরের আঘাতে ভাঙবে না?
তির মারব মারব ভাবছি আর তখনই মনে পড়ছে তির-ধনুকটি বিক্রি করেছিলেন আমাকে যে সাঁওতাল পুরুষ তাঁর কথা। সতর্কবাণী ছিল, আমরা বাবুলোক, তির চালাতে যেন না যাই, বিপদ হবে। বাবুলোকদের সত্যিই বড় অসুবিধে। ইচ্ছে করলেও আমরা তির চালাতে পারি না। আর যদি বা চালাইও, সেই তির লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। হাওয়া তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে বেপথু করে দেয়। লক্ষ্যে বিঁধতে দেয় না। হাওয়া বোঝে মধ্যবিত্ত বাবুদের অসুবিধেটি কোথায়। আমরা শুধু ভার্চুয়াল তির চালাতে পারি। ফেসবুকে আর হোয়াটস অ্যাপে। সত্যিকারের তিরকে ছিলায় কীভাবে আটকাতে হয়, তা আমরা ক’জন জানি?
এই যে এত তির-ধনুকের কথা লিখছি, এতে বেশ একটা যুদ্ধ যুদ্ধ আবহাওয়া তৈরি হচ্ছে না? বেশ একটা উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে না ভিতরে ভিতরে? প্রথমবার লকডাউন ঘোষণার সময়ে প্রধানমন্ত্রীও কিন্তু তাঁর ভাষণে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, যুদ্ধেই অবতীর্ণ আমরা। এবং এই যুদ্ধ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের চেয়েও ভয়ংকর। কেননা, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়েছিল ১৮ দিনে। আর এই যুদ্ধ এখনও চলেছে। অমর্ত্য সেন অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর ব্যবহার করা এই ‘যুদ্ধ’ শব্দটিকে পছন্দ করেননি। কেননা, যুদ্ধ হয় একজন নেতার নেতৃত্বে। তিনিই সর্বময় কর্তা যুদ্ধের। নেপোলিয়ন আর স্ট্যালিনের প্রসঙ্গ টেনেছেন অমর্ত্য সেন। বলেছেন যে, ‘যুদ্ধ’র কথা বললে কি যাঁরা ক্ষুধার্ত, যাঁরা কাজ হারাচ্ছেন, যাঁরা হয়তো মারাই যাবেন খিদের ধাক্কায়, তাঁদের সকলের লড়াইকে বা যন্ত্রণাকে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে এই শব্দটির মধ্যে? তিনি বলেছেন, একে অন্যের সহযোগী হয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করছি আমরা। ঠিক কথা। কিন্তু আমি ভাবছিলাম যে, ‘যুদ্ধ’ এই শব্দটিকেই যদি আমরা একটু বদলে নিতে পারি? প্রধানমন্ত্রী যেভাবে যুদ্ধের কথা বলেছেন, সেইভাবে না বলে যদি অন্যভাবে বলি, তাহলে কি ভুল বলা হবে? এই অদ্ভুত পরিস্থিতি ‘যুদ্ধ’ শব্দটিকেই কি এক নতুন মাত্রা দিচ্ছে না, আমাদের দেখাচ্ছে না এক নতুন যুদ্ধ, যে যুদ্ধে শুধু বিজ্ঞানী, ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ এঁরাই সৈনিক নন, আমরা সকলেই সৈনিক? গরিব মানুষের মুখে, নিজেদের ঝুঁকি নিয়ে খাবার তুলে দিচ্ছেন যাঁরা, তাঁরা যেমন সৈনিক, তেমনই যাঁরা লকডাউনের নিয়মকানুন মেনে অন্তরিন হয়ে আছেন, তাঁরাও সৈনিক? না, এই যুদ্ধ কোনওমতেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ নয়। কেননা, এই যুদ্ধে যে তির ছুটছে, সেই তিরের ফলায় মাখানো নেই বিষ আর ঘৃণা, বরং মাখানো রয়েছে ভালবাসা আর সৌহার্দ্য। শব্দের অর্থ তো চিরকাল একই রকম থাকে না। কত শব্দের অর্থ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পালটে পালটে গেছে। এই অতিমারী কি সেইভাবে ‘যুদ্ধ’ শব্দটিকেও নতুন দ্যোতনায় হাজির করল না আমাদের কাছে?
এইসব ভাবতে ভাবতেই রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরীর একটি অতি বিখ্যাত কবিতার কথা মনে পড়ল। কবিতাটির নাম “অলংকৃত তির”। রমেন্দ্রকুমার লিখেছিলেন:
‘এই তির পড়েছিল গোপন রাস্তায়,
আমি তাকে তুলে নিয়ে অলংকৃত করে সাজালুম।
তুমিই তো ছুড়েছিলে নিজের সহজ অহংকারে,
কোন্ পাখি মরে গেল, কোন্ দীপ্ত গাছের বাকলে
সিঁদুর ছড়িয়ে দিল একবার ভেবেও দেখনি,
আমি তাকে মুক্তাখচিত করে তোমাকে দিলুম।
যাকে তুমি ছুড়েছিলে চেয়ে দেখ চিনতে পারো কিনা,
রুহিতন মুখে আজও রক্তের গন্ধ লেগে আছে,
লতা-গুল্মে পড়েছিল পাখা ভেঙে এতদিন একা,
আমি তাকে মন্ত্রজীবিত করে তোমার বুকের কাছে এই রাখলুম,
যদি বেঁধে, যদি মুহূর্তও দুঃখ দেয়; অচেতন অহংকারে
ছুড়েছিলে যাকে
হীরা-মরকত গেঁথে সেই তীব্র আমি আজ ফিরিয়ে দিলুম’।
এই কবিতাটিও সেই তিরের রূপবদলের কথাই বলছে তো! এতদিন ধরে রাষ্ট্রনায়করা কখনও ‘সহজ’ কখনও বা ‘অচেতন’ অহংকারে তির ছুড়ে গিয়েছেন সত্যিকারের যুদ্ধে। সেই তিরে ছোট্ট পাখির মতো সিরিয়ার শিশুরা মারা গেলে, তাঁরা তা নিয়ে মাথাও ঘামাননি। তাঁদের ছোড়া তিরের আঘাতে ইরাকে গাছের মতো একটি মানুষের দীপ্ত বাকল থেকে রক্ত ঝরলে তাঁরা মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়েছেন। রক্তের গন্ধ লেগে থাকা সেই তির আজ সাধারণ মানুষেরাই তাঁদের দিকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন ভালবাসার হীরা-মরকতে গেঁথে। যদি এই ভালবাসামাখা তির রাষ্ট্রনায়কদের বুকে গিয়ে বেঁধে, যদি তাঁদের মুহূর্তের জন্যও দুঃখবোধ জাগে, তাহলে তাও এই যুদ্ধে আমাদের জয় বইকী!
পড়ুন, আগের পর্বগুলি…
দূরের পথ দিয়ে ঋতুরা যায়, ডাকলে দরজায় আসে না কেউ
আমি কি এ হাতে কোনও পাপ করতে পারি?
শিশুদের ভাল রাখার উপায় সম্বন্ধে যে দু-একটি কথা আমি জানি
কেরল পারলে, বাকি দেশ পারবে না কেন?
বান্দ্রার পরে আর শুকনো কথায় চিঁড়ে ভিজবে কি?