
অংশুমান কর

কিন্তু এই অন্তরিন অবস্থায় আমরা কি শুধু “গীতবিতান”ই পড়ছি? বলামাত্র জানি, অনেকেই হাঁ-হাঁ করে উঠবেন! বলবেন, নির্জন দ্বীপে নির্বাসন আর গৃহে অন্তরিন থাকা কি এক হল? এক তো নয়ই। আমি বলব গৃহে অন্তরিন থাকা বরং আরও একটু বেশিই কঠিন। কেননা, নির্জন দ্বীপে করোনা থাকবে না কিন্তু প্রকৃতি থাকবে। চাইলে আপনি বন্ধু করে নিতে পারেন এমনকি পশুপাখি, কীটপতঙ্গকেও। কিন্তু যেভাবে গৃহদ্বীপে আজ আমরা বন্দি তাতে তো সে উপায় নেই। এর চেয়েও বড় কথা হল, সেই দ্বীপে আপনি জানেন যে, নিজেকেই নিজের সব কাজ করতে হবে। কাজের লোক না আসায় কে রান্না করবে, কে বাসন মাজবে, কে ঘর ঝাঁট দেবে আর মুছবে সেসব নিয়ে একদিন দু’দিন খিটিমিটি আর তারপরে একদিন মহাক্ষণে তুলকালাম হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই!

বইটির প্রকাশক ঢাকার নৈঋতা ক্যাফে। বিজয় দে-র কবিতার বই। প্রচ্ছদে হাতে সিগারেট ধরা বিজয়দার প্রোফাইল ছবি। যে ছবি দেখলে যে কোনও তরুণী সত্তর ছুঁই-ছুঁই এই কবির প্রেমে পড়ে যেতে বাধ্য। অন্তরিন এই বইটি আমাকে এক অদ্ভুত মুক্তির স্বাদ দিল। “মুক্তাসুন্দরী” নামে একটি কবিতায় বিজয়দা লিখেছেন “আশ্বিন মাসের আকাশের নীচে যত গাছ ফুল আছে/ তার একটি হচ্ছি আমি”। পড়েই মনে হল, এইরকম ভেবে নিলেই তো অন্তরিন অবস্থা থেকে বেশ খানিকটা মুক্তি পাওয়া যায়। এখন তো মনে করতেই পারি বসন্ত আকাশের নীচে ওই যে অশোকবৃক্ষটি দাঁড়িয়ে ওটিই আমি। কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে। যাহ! আবার রবীন্দ্রনাথ চলে এলেন! সেদিন একটি ভিডিও দেখলাম। হিন্দিভাষী এক বন্ধুর বানানো। তিনি বলছেন যে, এখন তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন নিউজিল্যান্ডে। একটু পরেই যাত্রা শুরু করবেন আমেরিকার উদ্দেশে। না, বিমান চলাচল বন্ধ তাতে কোনও সমস্যা নেই। গুগল ম্যাপ আছে তো। গুগল ম্যাপেও খানিকটা ঘুরে নিলেই হয়। সত্যি বলতে কী, সাধারণ মানুষদের মধ্যেও তো বেশ কিছু কবি এভাবেই ঘাপটি মেরে বসে থাকেন। অন্তরিন হয়ে থাকেন। সংকটের সময়ে চিরকালই এঁরা প্রকাশ্যে আসেন। এখন যেমন আসছেন।
বিজয়দার চমৎকার বইটি পড়তে পড়তেই শুনলাম কে যেন ডাকাডাকি করছে। বইয়ের ডাক। এই বইটি অন্তরিন হয়ে ছিল এনবিএর (মোটা) পলিথিনের প্যাকেটে। মুক্তি দিলাম বইটিকে। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ফ্যাসিজম”। বইটি প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৩৪ সালে। এখন ছাড়পত্র প্রকাশন আবার সেটিকে পুনঃপ্রকাশ করেছে। অনেক বছর আগে আমাকে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের “শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ” উপহার দিয়েছিল শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার। কিন্তু যতদূর মনে পড়ছে তাতে এই বইয়ের কোনও অংশ ছিল না। সৌমেন্দ্রনাথ ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরে জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র। আন্তর্জাতিক রাজনীতির আঙিনায় মানবেন্দ্রনাথ রায়ের পরে তিনিই ছিলেন বাঙালি কমিউনিস্টদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত মুখ। ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে আজীবন তিনি ছিলেন এক নির্ভীক, লড়াকু তাত্ত্বিক ও সৈনিক। জার্মানিতে থাকার সময় এমনকি হিটলারকে হত্যার ষড়যন্ত্রের ভুয়ো অভিযোগে তাঁকে জেলেও পুরে দেওয়া হয়েছিল। পরে অবশ্য তিনি ছাড়া পান। দেশেও ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের তিনি ছিলেন এক প্রধান পুরুষ। রবীন্দ্রনাথকে ফ্যাসিজমের বিপদ সম্পর্কে বিদেশ থেকে লিখেছিলেন চিঠি। রবীন্দ্রনাথকে যুক্তও করতে পেরেছিলেন ফ্যাসিবাদ-বিরোধী কার্যক্রমে।
বইটির বর্তমান সংস্করণের ভূমিকায় দেখি দাবি করা হয়েছে যে, বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম ফ্যাসিবাদ-বিরোধী বই, সম্ভবত, এটিই। বইটির পরিশিষ্ট অংশে রয়েছে ১৯৩৪ সালের প্রথম সংস্করণের জন্য লেখা সৌমেন্দ্রনাথের একটি ছোট্ট ভূমিকা। তাতে উনি লিখেছেন: “ভারতবর্ষের বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের লোকদের যে ফ্যাসিজমের উপর মনের টান আছে, তার পরিচয় আমরা অনেকদিন থেকেই পেয়ে আসছি। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্রীযুক্ত প্রমথ রায় মুসোলিনির কতকগুলি বক্তৃতা চয়ন করে যে-বই বের করেছেন, পলিটিকাল মতবাদের উপর লিখিত বই হিসেবে সে-বইয়ের কোনও মূল্য না-থাকলেও তার প্রতিক্রিয়াশীল উদ্দেশ্যের দরুণ বইটি আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের লোকেদের কাছে অত্যন্ত সমাদর লাভ করেছে। প্রবাসী প্রভৃতি বুর্জোয়া পত্রিকাগুলি বইটির উচ্চ প্রশংসা করছে। অধ্যাপক শ্রীযুক্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বইটি পড়ে যে-প্রশংসাপত্র লিখেছেন তাতে ভারতবর্ষের তরুণ সম্প্রদায়কে ফ্যাসিস্ট প্রণালী অবলম্বন করতে উপদেশ দিয়েছেন। কালে ভারতবর্ষীয় ন্যাশানালিস্টরা যে ফ্যাসিস্ট মূর্তিতে দেখা দেবে, তাতে সন্দেহ নেই”। পড়ে, থামি। মন বিচলিত। বলছেন কী সৌমেন্দ্রনাথ? সুনীতিকুমার তরুণদের ফ্যাসিস্ট প্রণালী অবলম্বন করতে উপদেশ দিয়েছিলেন? প্রমথ রায়ের বইটি আমি পড়িনি। যা বলেছেন সৌমেন্দ্রনাথ, নিশ্চয়ই মিথ্যে নয়, কিন্তু নিজে চোখে না দেখে বিশ্বাস করি কী উপায়ে? নিজে চোখে যে দেখব এখন তো তার উপায় নেই। বন্ধ লাইব্রেরি। কোথায় পাব প্রমথ রায়ের বই আর সুনীতিকুমারের লেখা সেই বইয়ের প্রশংসাপত্র? আবার মনখারাপ হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল, আমি অন্তরিন।
একটু ভারী ভারী কথা লেখা হয়ে গেল বোধহয়। মনও খারাপ হল একটু। নাহ, ওই বিজয়দার বইটার কাছেই ফেরা যাক আবার। আবার ফিরলাম “বৃষ্টিমাতরম”-এর কাছে। দেখি ‘আমার হাওয়া আমার বাতাস’ কবিতায় বিজয়দা লিখেছেন,
“যে-কোনও একটা পূর্বদিক বেছে না নিতে পারলে
লেখালেখি সঠিক পথে এগোয় না
যেমন ঢেউ খেলানো নদীর তীরে ঘুমন্ত প্রসূতি-সদন;
এটাই আমার পূর্বদিক
বাংলায় লেখা, বাংলা ভাষায় লেখা বাংলার
শ্রীশ্রীপ্রজাপতয়ে নমঃ; এটাই আমার পূর্বদিক

তেপান্তরের মাঠ পেরোলে জোড়-দিঘির চোখ-আঁকা
প্রশান্ত পাঠশালা; এটাই আমার পূব-দিক
যার একটি কথা একমাত্র বাঁশি জানে, অন্য কেউ এখনও
জানতে পারেনি; এটাই আমার পূবদিক”
পড়ে, স্তম্ভিত বসে থাকি। মনে হয়, এই সংকটের মুহূর্তে আমাদেরও একটা পূর্বদিক চাই। মনে হচ্ছে, রাষ্ট্র যদি গরিব মানুষগুলোর প্রতি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে, তাহলে সেটাই হবে একটা পূর্বদিক। একজন বিজ্ঞানী যদি হঠাৎ আবিষ্কার করতে পারেন করোনা প্রতিরোধ করতে পারবে এমন একটা ভ্যাকসিন, তাহলে সেটাই হবে একটা পূর্বদিক। আর সবচেয়ে বড় পূর্বদিক তো সেই দিনটি যেদিন আমরা এই যুদ্ধে জয়ী হব। যেদিন অন্তরিন মানুষ খোলা আকাশের নীচে সত্যি সত্যিই গাছের মতো যতক্ষণ ইচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। পুলিশ লাঠিও মারবে না, বরণও করবে না। সেইদিন কি সত্যিই খুব দূরে?
চিত্রকর: মৃণাল শীল
দূরের পথ দিয়ে ঋতুরা যায়, ডাকলে দরজায় আসে না কেউ