
অংশুমান কর
যখন হিমের পরশ হয়ে শরতের মতো প্রেম আসে কিশোর-কিশোরীদের জীবনে, যখন আমলকি গাছের মতো তাদের বুক কাঁপতে থাকে দুরুদুরু, তখন তাদের মনে হয় ‘‘হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়’’। সে বেশ একটা দুঃসাহসী কাজ। এমনটাই মনে করতাম একসময়। কিন্তু এই করোনা দেখিয়ে দিল বুড়ো প্রেমিক-প্রেমিকারাও হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেছেন যে, হাতের উপর হাত রাখা সত্যিই একটা দুঃসাহসী ব্যাপার, বিশেষ করে সে প্রেমিক বা প্রেমিকা যদি প্রবাসী হন, যদি বিদেশ বা ভিন রাজ্য থেকে দেশে ফেরেন। বিরহের অন্তে মিলন— এই তো চিরকালের চেনা গল্প। কিন্তু এখন তো এইসব ক্ষেত্রে বিরহের অন্তে কোয়ারেন্টিন।
হাত নিয়ে সত্যিই বড় সমস্যায় পড়েছেন আমার মতো অনেকে। কী যে করা যায় হাতদু’টি নিয়ে, ভেবেই উঠতে পারছেন না। আমিই যেমন। বারবার হাত ধুচ্ছি লিকুইড সোপ দিয়ে। বাজার করতে দু’দিন আর ওষুধ আনতে দু’দিন বেরোতেই হয়েছিল বাইরে। বাড়ি ফিরেই হাত ধোওয়া। সঙ্গে সঙ্গে। যে সে হাত ধোওয়া নয়। একেবারে হু-এর দেখানো পথে ইউ টিউব দেখে হাত ধোওয়ার কায়দা-কানুন রপ্ত করে
নিয়ে হাত ধোওয়া। অবশ্য একবার হাত ধুয়েই শান্তি নেই। সকালে ব্রাশ করার আগে একবার হাত ধুচ্ছি। চা-বিস্কুট খাওয়ার আগে আর একপ্রস্থ। ন’টা নাগাদ ব্রেকফাস্ট করার আগে আরও একবার। দুপুরে ভাত খাওয়ার আগে আরও একবার। বিকেলের চা আর টিফিনের আগে দু’বার। রাতে ভাত খাওয়ার আগে আরও একবার। এ ছাড়াও যখনই মন খুঁতখুঁত করছে, আরও একবার হাত ধুয়ে নিচ্ছি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে ধুস, ধোব না হাত, কিন্তু তারপরেই আবার হাত ধুচ্ছি। কেননা মা দুর্গার ওই মিম চোখের সামনে ভাসছে। দেবী ধমক দিচ্ছেন, এত এত বছর ধরে আমার দশটি হাত আমি ধুয়ে এলাম আর দু’টি হাত ধুতে এত কষ্ট!
হাত ধুতে ধুতে একটি জিনিস অবশ্য আমি বুঝতে পেরেছি। আমি বাঁচতে চাই। কেন বললাম কথাটা? মধ্য-চল্লিশে পৌঁছে গিয়েছি। মৃত্যুচিন্তা এখন বড্ড বেশি করে আসে। আরও আসে কারণ, কোথাও কিছু নেই দিব্যি মাউথ অর্গান বাজাচ্ছিল যে ছেলেটা, সেই আমার চেয়ে দু’বছরের ছোট আমার ভাই অনির্বাণ, হঠাৎ করে সেই যে জুলাইয়ের গোড়ায় ঘুমোতে শুরু করল এখনও উঠলই না! আমার
বাবাও মারা গিয়েছিলেন মাত্র তিপান্ন বছর বয়সে। এইসব ভাবতাম মাঝে মাঝে আর মৃত্যুচিন্তা আরও গভীর হত। মনে হত কে জানে, আমারও হয়তো আর বেশিদিন নেই। মনে হত, মরে গেলেই বা ক্ষতি কী! অনেকদিন তো বাঁচলাম। কিছু কবিতা-গল্প-উপন্যাস-গদ্য লিখলাম। কেউ কেউ পড়ল। ভাললাগা-মন্দলাগা জানাল। ব্যাস আর কী চাই? পৃথিবীকে টা-টা করে দেওয়াটা নেহাত মন্দ না। কিন্তু এখন
হাত ধুতে ধুতে মনে হচ্ছে যে, না, আমি বাঁচতে চাই। মনে হচ্ছে যে, শুধু আমি না, আমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে ওই “মেঘে ঢাকা তারা”-র নীতার মতো গোটা পৃথিবী যেন বলছে, “দাদা, আমি বাঁচতে চাই”। আমার মনে হয় এই করোনার দিনগুলি আমরা পেরিয়ে যাওয়ার পরে পৃথিবীটাকে আবার নতুন করে ভালবাসতে পারবে অনেকে। আত্মহত্যা কমে যাবে।
একটু অপরাধবোধও হচ্ছে কিন্তু। কেন? বলছি। বারবার হাত ধুতে ধুতে হাত হয়ে পড়ছে খসখসে। ভয় লাগছে হাতে আবার ঘা-টা হয়ে যাবে না তো! শীত এই সবে গিয়েছে। বাড়িতে রয়ে গেছে তরল ভেসলিনের শিশি। ওই ভেসলিন খসখসে হাতে লাগাচ্ছি। যাতে হাত মোলায়েম থাকে। চামড়া খসখসে না হয়। হাতে এই ভেসলিন ডলতে ডলতেই মনে পড়ছে, আমাদের এই পোড়া দেশে কতজনের হাত থেকে তো সারাবছরই রক্ত ঝরে! কোথায় পাবে তারা ভেসলিন? শুধু হাত নয়। চোখের সামনে ভাসছে মহারাষ্ট্রের লং মার্চে অংশ নেওয়া সেই বৃদ্ধার রক্ত ঝরতে থাকা পা-দুটি। ওই পায়ের নিরাময় কি কোনওদিন সম্ভব? এই যে এখনও হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরলেন এতজন মানুষ, কোথায় পাবেন তারা ভেসলিন? তবে কি লাগাব না ভেসলিন? তাও পারি না। কেমন অসহায়ের মতো হাতে ভেসলিন ডলছি। এ হল মধ্যবিত্তের নিরাময়হীন অসহায়তা। মনকে মাঝে মাঝে প্রবোধ দিচ্ছি এই ভেবে যে, ওই মানুষগুলিকে নিয়ে দু-একটি কথা লিখেছি। মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দিয়েছি একদিনের মাইনে। বর্ধমান শহরে দুঃস্থ মানুষদের জন্য কাজ করছে যে সংস্থা তাদের দিয়েছি সাহায্য, যেটুকু পারি। কিন্তু তা সত্যিই তো কতটুকু? তারপরে ভাবছি, আমার মতো অনেকেই তো দিচ্ছেন। বিন্দু বিন্দু থেকেই তো সিন্ধু হয়।
মাঝে মাঝে পাগলের মতো হাত ধুতে ধুতে নিজেকে মনে হচ্ছে লেডি ম্যাকবেথ। এত হাত ধুচ্ছি, তাও যেন রক্তের গন্ধ যাচ্ছে না! রক্ত? আছেই তো। সভ্যতার হাতেই তো লেগে রয়েছে রক্ত। করোনা যেন আমাদের মনে করিয়ে দিতে এসেছে যতই তোমরা হাত ধোও, কিছুতেই এই রক্তের দাগ, গন্ধ যাবে না!
শুধু কি রক্ত? পাপের চিহ্ন লেগে নেই আমাদের হাতে? মনে পড়ছে সুব্রত চেলের একটি কবিতা। “হাত”। সুব্রতদা লিখেছিলেন:
‘‘একই হাত কিন্তু দেখা হলে কেউ কারোকে চিনতেই পারে না
এই হাত থেকেই কালো হাত
একজন মানুষের কটা হাত? দুটোই তো।
তাহলে কালো হাত এল কোথা থেকে?
আসলে তোমার ওপর নির্ভর করছে হাত কালো হবে কি হবে না।
কালোতে ডুবিয়ে নিলেই কালো…”
তাই তো! আমাদের ওপরই তো নির্ভর করছে হাত কালো হবে কিনা। শুধু এটুকুই অবশ্য লেখেননি সুব্রতদা। আরও লিখেছিলেন:
“বাবা-মা যে হাত দিয়ে যান তাই কি থাকে কোনও মানুষের
সেই কচি হাত-দুটো কবে কোথায় বিদায় জানিয়েছে তাও মনে পড়ে না”
কী মর্মান্তিক কথা! সত্যিই তো আমরা বড় হলাম আর সেই কচি হাতদুটো বিদায় জানাল আমাদের। তাই আজ এই হাত ধোওয়ার করুণ উৎসব। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে যে, লেডি ম্যাকবেথের মতো আমরা সকলেও কি উন্মাদ হয়ে যাব শেষমেশ? তারপর ঢলে পড়ব মৃত্যুর কোলে? পাপ কি আমাদের ছেড়ে কথা বলবে না?
তারপরে মনে হচ্ছে আমাদেরই পাপে অনেকে প্রাণ দেবে। দিয়েছে ইতিমধ্যেই। কিন্তু সকলে আমরা নিশ্চিত ঢলে পড়ব না মৃত্যুর কোলে। যারা আমরা রয়ে যাব সেই করোনা-মুক্ত পৃথিবীতে তারা যেন এই হাত ধোওয়ার শিক্ষাটুকু না ভুলি। আক্ষরিক আর প্রতীকী— এই দুই অর্থেই। না। ঠিক লিখলাম না। প্রতীকী অর্থে আমাদের হাত ধুতে হবেই বা কেন? হাত কালো হলে, হাতে পাপ লাগলে, তবে তো হাত ধোওয়ার কথা আসবে। যারা আমরা বেঁচে রইব, তারা যেন এরপর হাতকে কালো হতে কিছুতেই না দিই। তারা যেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো বলে উঠতে পারি, ‘‘এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ/আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি?’’
আরও পড়ুন…