
গৃহবন্দির জবানবন্দি ১০
বাইরে ‘সুখ’। বাইরেই অসুখ। করোনা এফেক্ট। বাধ্যতামূলক ঘরে অন্তরিন। অমান্য মানে বিপদকে নেমন্তন্ন করে আনা। তাই সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। ঘরে সেই স্বস্তি। ঘরেই অস্বস্তি। তবে উপায়? চিন্তাকে চিন্তামণির ওপর ছেড়ে মন হালকা রাখাই সবচেয়ে ভাল উপায়। এই ‘জরুরি অবস্থা’র দিনে আপনাদের জন্যেই ‘দ্য ওয়াল’ এনেছে একটি বিভাগ ‘হাসো তো দেখি’। সেখানে আছে হাসির ছবি। এবার এল হাসির লেখা ‘বারোয়ারি নকশা’। পড়ুন, মন ভাল রাখুন।
জয়দীপ চক্রবর্তী
ছোটবেলায় আমি যখন ইস্কুলে পড়তাম, তখন থেকেই আমার শুয়ে শুয়ে পড়ার অভ্যাস। পড়ার চেয়ার টেবিল তো ছিল না আমাদের। হয় মাদুর পেতে পড়তে বসা অথবা বিছানার ওপরে। আমি অবশ্য পড়তে বসতাম না। চিরকালই আমার পড়তে শোয়া। বুকের নীচে বালিশ। সামনে খোলা বই। উপুড় হয়ে শুয়েই পড়া। অমন করেই লেখা। আমার মা আমাকে বলত ‘গুড়ের কলসি’। সবসময়েই গড়িয়ে পড়ি।
কথাটা খুব মিথ্যে ছিল না। নিজেও দেখেছি, খুব বেশিক্ষণ আমি বসতে পারি না। আমার পিছনটায় কিছু একটা ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট আছে। যতই বসিয়ে দেবার চেষ্টা করা হোক, নিজের অজান্তেই তেবড়ে যাওয়া বোতল বা কানা ক্ষয়ে যাওয়া মাটির ভাঁড়ের মতো আমি হেলে যাই।
আমাদের ছোটবেলায় মহালয়ার দিন কাকভোরে অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে সম্প্রচারিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শোনাটা একটা মস্ত রোমাঞ্চ ছিল। রেডিও স্টেশন খোলার আগে যখন দীর্ঘ কুউউউউ শব্দ উঠছে তখনই আমার মা আমাদের ঘুম থেকে তুলে দিত। তার মধ্যেই মায়ের হাতমুখ ধুয়ে, কাপড় কেচে, শাঁখ বাজিয়ে, ধূপ জ্বেলে দেওয়া হয়ে গেছে। আমরাও ধড়মড় করে জেগে উঠে চোখেমুখে জল দিয়ে শিরদাঁড়া টানটান করে বসে পড়তাম বিছানার ওপরে। কিন্তু ওই যে বললাম, বেশিক্ষণ বসে থাকা আমার ধাতে নেই। প্রতিবছরেই পুরো অনুষ্ঠান শোনার প্রতিজ্ঞা নিয়ে বসেও দেখতাম গলাটলা কাঁপিয়ে যেই মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ‘তব অচিন্ত্য’ গানটা ধরলেন অমনি সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। অত শ্রোতার মধ্যে একমাত্র আমিই ক্রমশ যেন রিফ্লেক্স অ্যাকশনেই ঝুঁকে পড়তাম বিছানার দিকে। চোখ বুজে আসত। সম্বিত যখন ফিরত ততক্ষণে পঙ্কজ মল্লিক ‘রূপং দেহি, জয়ং দেহি’ শুরু করে দিয়েছেন।
এমন শয়নবিলাসী এবং নিদ্রাপটু মানুষের বরাতে যা হবার আমার ক্ষেত্রেও তাইই হয়েছে। আমার মা প্রায়শই আমাকে একটা প্রবাদ শোনাত, ‘যে শুয়ে থাকে, তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে’। আমার ভাগ্য সত্যিই শুয়ে আছে কিনা কখনও সেভাবে ভেবে দেখিনি। তবে এটা ঠিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, রাজা-উজির কিছুই হতে পারিনি আমি এ জীবনে। হবার সম্ভাবনাও আর নেই। আমি মর্মরপ্রাসাদ বানাতে পারিনি। নিজস্ব গাড়ি বলতে একটা লজঝড়ে সাইকেল। ইওরোপ, আমেরিকা দূরঅস্ত, নেপাল ছাড়া অন্য কোনও বিদেশে বেড়াতে যাবার স্বপ্ন দেখারও মুরোদ নেই আমার। এই অনন্ত আলস্যযাপনে আমার উপার্জন বলতে সরু সরু হাত-পার সঙ্গে একটা মেওয়াপাতি ভুঁড়ি, রক্তে অতিরিক্ত চিনি আর অম্লাধিক্য। আমার এসব নিয়ে কোনও দুঃখু নেই। হীনমন্যতাও নেই। কিন্তু আমার স্ত্রী আমাকে নিয়ে বেজায় বিব্রত। এমন একটা মিনসের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে যার ট্যাঁকে টাকাও নেই, পেটে প্যাকও নেই। সঙ্গত কারণেই আমাকে নিয়ে গর্ব করার মতো উপাদান আমার স্ত্রীর হাতে কিছু নেই। প্রতিবেশী বান্ধবী থেকে ফেসবুকের ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডস কারও কাছেই আমাকে নিয়ে নাইটির কলার তোলার তাঁর উপায় নেই। বাস্তবিক আমাকে নিয়ে বেজায় বিরক্ত তিনি। প্রায়শই আমার কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করেন, ‘কী একখানা গোবরগণেশের মতন চেহারা বানিয়েছ বলো দিকিনি। লোকের কাছে তো এরপর তোমার পরিচয় দিতে গিয়ে প্যাঁক খেয়ে মরতে হবে।’
‘কেন?’ বোকার মতন জিজ্ঞেস করি।
‘আবার জিজ্ঞেস করছ, কেন? বুঝতে পারছ না?’
‘উঁহু।’
‘আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখো একবার।’
‘সে তো রোজই দেখি চুল আঁচড়ানোর সময়।’
‘তার মানে তোমার চোখটাও যেতে বসেছে।’
‘কেন?’
‘বিয়ের পর থেকেই তো দেখছি মনে মনে তুমি আমার জ্যাঠামশাই। রসকষ নেই, শুধু জ্ঞানের বুলি আওড়াচ্ছ সর্বক্ষণ। এখন চেহারাটাও তো তেমনই হয়েছে। পরিচয় না দিলে লোকে বলবে কাকা-ভাইজি। ফেসবুকে একসঙ্গে দু’জনের ছবি পর্যন্ত আপলোড করতে ইয়ে লাগে আজকাল…।’
আমি চুপ করে রইলাম। বিষয়টা সত্যিই ভাববার। ফেসবুকে অসম্মানিত হওয়া মানে জীবনে কিছুই বাকি রইল না আর।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ও বলল, ‘ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে একটু শরীরচর্চা তো করতে পারো। আমার জুম্বা নাচের ক্লাস লকডাউনের জন্যে বন্ধ। ইয়োগা ক্লাসেও যাওয়া হচ্ছে না। কাল পুরনো ব্লাউজগুলো আঁট মনে হচ্ছিল। আমি বাড়িতেই ব্যায়াম-ট্যায়ামগুলো আবার শুরু করব। তুমিও করবে আমার সঙ্গে। কী করতে হবে আমি দেখিয়ে দেব তোমায়…।’
মনে মনে আমি হেবি ঘাবড়ে গেলাম। বিয়ের পর থেকে তিনি অনেক কিছুই দেখিয়েছেন আমায়। এখন এই বয়েসে নতুন কিছু দেখার কথায় ভয় লাগে…।
কাল রাতে বেদম বৃষ্টি হয়েছে। ভোরের দিকটা বেশ সুদিং টেম্পারেচার। ঘুমানোর পক্ষে আদর্শ পরিবেশ। আমি পাশবালিশ আঁকড়ে দিব্বি ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা তীব্র ফোঁসফোঁসানির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। একতলার ঘরে শুই। ঘরের জল বেরনোর আউটলেটটার মুখে লাগানো জালটা ক’দিন হল ভেঙে গেছে। দোকান বন্ধ বলে সারাতে পারছি না। ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল আমার। দীর্ঘদিন রাস্তাঘাটে মানুষজন বেরোচ্ছে না বলে নানান জায়গায় বন্য জন্তুরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ছে খবরে দেখেছি। আমার নিজের পাড়াতেই পরশু সন্ধেবেলা একঝাঁক শেয়াল রাস্তার ওপরে এসে দাঁড়িয়ে বেজায় আনন্দে হইচই করছিল আকাশের চাঁদের দিকে মুখ তুলে। ঘরের মধ্যে সাপ ঢুকে পড়া বিচিত্র নয়। গরম পড়েছে। শীতঘুম ভেঙে ওরা ফর্মে ফিরেছে অনেকদিনই। কাল বৃষ্টির সময় হয়তো আশপাশের কোনও গর্ত-টর্ত থেকে বেরিয়ে…।
আমি সুগারের রোগী। ভয় পেলেই নার্ভাস হয়ে পড়ি। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গলা শুকিয়ে ওঠে। এখন কত সকাল কে জানে! চোখ বুজনো অবস্থাতেই পাশে হাত বাড়িয়ে দেখলাম ও বিছানায় নেই। আরও ভয় পেয়ে গেলাম আমি। ঘরে কি তাহলে এখন আমি আর ওই কালান্তক সাপটা? কাঁপা কাঁপা গলায় হাঁকপাঁক করে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘শুনছ, তুমি কোথায় গেলে?’
সাড়া নেই। আবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, ‘আমাকে আর দেখতে পাবে না তুমি। এই লকডাউনের মধ্যেই বিধবা হয়ে গেলে বোধহয়…।’
‘আদিখ্যেতা’, চাপা স্বরের শব্দটা চাবুকের মতো আমার কানের মধ্যে আছড়ে পড়ল ঘরের মধ্যে থেকেই, ‘কী হয়েছে? বুকে ব্যথা? ফোঁটা চারেক কার্বোভেজ খেয়ে না ঘুমিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে বসে থাকো খানিক…।’
‘না না, তা নয়’, ভয় পাওয়া গলায় আমি বলি, ‘ঘরে সাপ ঢুকেছে। লাঠি নিয়ে এসো। কার্বোলিক অ্যাসিডের শিশিটা কোথায় আছে দেখো। পাশের বাড়ির পল্টনদাকে খবর দাও এক্ষুনি…।’
‘কী ঢুকেছে?’
‘সাপ।’
‘মরণদশা’ গিন্নি ঝাঁজিয়ে উঠলেন, ‘দিনরাত্তির গুচ্ছের গেলন আর কুমড়োর মতন বিছানায় গড়ানো। পেট গরম হয়ে দুঃস্বপ্ন দেখছ শুয়ে শুয়ে।’
‘বিশ্বাস করো, স্পষ্ট ফোঁস ফোঁস আওয়াজ শুনলাম…।’
‘সে আওয়াজ সাপের হতে যাবে কোন দুঃখে?’
‘তবে?’
‘আমি প্রাণায়াম করছিলাম। কপালভাতি। পেটের চর্বি কমানোর জন্যে। তাড়াতাড়ি ওঠো তো। তৈরি হয়ে এসো। তুমিও করবে আমার সঙ্গে।’
‘ঠিক আছে। করব।’
‘উঠে পড়ো তাহলে।’
‘কাল থেকে।’
‘না আজ থেকেই। কাল বলে কিছু নেই। এক্ষুনি শুরু করতে হবে।’
প্রমাদ গুনলাম। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। এই কঠিন সময়ে মাথা ঠান্ডা রাখতে না পারলে ভোরবেলার সুন্দর ঘুমটা চটকে সিন্নি হয়ে যাবে একেবারে। কাজেই খুব মোলায়েম করে বললাম, ‘তুমি তো নারায়ণের খুব ভক্ত। মাঝেমাঝেই প্যানপ্যান করে হরিনাম করো শুনি। তা তাঁর থেকে কী শিখলে?’
‘মানে?’ গিন্নি অবাক।
আরও মোলায়েম করে বললাম, ‘বলছিলাম কী, দেবতাকে ভক্তি করা মানে আসলে তাঁর নির্দেশিত পথে নির্বিচারে চলা। তাই তো?’
‘কী বলতে চাইছ স্পষ্ট করে বলো তো বাপু, আমি ঘোরপ্যাঁচ বুঝি না…’ ও একটু সন্দিগ্ধ চোখে আমার দিকে চাইল।
‘না মানে বলতে চাচ্ছি, নারায়ণের বেজায় ভক্ত আমিও’, কষ্ট করে চোখ খুলি আমি আরও একবার, ‘তিনি যেমন অনন্তশয্যায় শুয়ে জগৎসংসারের চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছেন, আমিও চোখ বুজে শুয়ে শুয়ে তোমার এই সংসারের চিন্তা করছি দিনভর। দেবী, তুমিও বরং আমার যোগনিদ্রা ভঙ্গ করার চেষ্টা না করে আমার পদসেবা করো…।’
‘বয়ে গেছে’, বলে মুখব্যাদান করে এই উপদেশ মুহূর্তে নস্যাৎ করে দিয়ে আমার লক্ষ্মী পুনরায় প্রাণায়ামে মনোযোগী হলেন।
আমিও পুনর্বার বাম পাশ ফিরে যোগনিদ্রায় মগ্ন হলাম।
চিত্রকর: রাজ রায়
জয়দীপ চক্রবর্তীর ‘বারোয়ারি নকশা’র আগের পর্বগুলি…