
গৃহবন্দির জবানবন্দি ১২
বাইরে ‘সুখ’। বাইরেই অসুখ। করোনা এফেক্ট। বাধ্যতামূলক ঘরে অন্তরিন। অমান্য মানে বিপদকে নেমন্তন্ন করে আনা। তাই সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। ঘরে সেই স্বস্তি। ঘরেই অস্বস্তি। তবে উপায়? চিন্তাকে চিন্তামণির ওপর ছেড়ে মন হালকা রাখাই সবচেয়ে ভাল উপায়। এই ‘জরুরি অবস্থা’র দিনে আপনাদের জন্যেই ‘দ্য ওয়াল’ এনেছে একটি বিভাগ ‘হাসো তো দেখি’। সেখানে আছে হাসির ছবি। এবার এল হাসির লেখা ‘বারোয়ারি নকশা’। পড়ুন, মন ভাল রাখুন।
জয়দীপ চক্রবর্তী
সভ্যতার এতদিন পরে আমরা আদিম গুহাবাসী মানুষের মতো এখন গৃহবাসী হয়েছি। বাইরের জগৎ শূন্য হয়ে গেছে। কোলাহল নেই, ঝাঁ-চকচক দোকান বাজার, সিনেমা থিয়েটার সবই বন্ধ। আমরা যৌথ আড্ডা ভুলে গেছি। মিটিং মিছিল অবরোধে গলা ফাটানোও আপাতত স্থগিত। আমরা প্রত্যেকে একা। নিজের সঙ্গে নিজে সময় কাটাচ্ছি প্রতিদিন আর চমকে উঠে ভাবছি, এই ‘আমিকে’ আগে তো চিনতে পারিনি কোনওদিন! বহির্জগতের রঙিন হাতছানি উপেক্ষা করতে শিখে গেছি, বাইরে একলা বাউল গাইতে গাইতে ক্লান্ত হয়ে ফিরে যাচ্ছে, ‘ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল…’
আমাদের দ্বার তবু অবরুদ্ধ। দরজার ওপারেই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যুসম্ভাবনা। আমরা তাকে দেখতে পাচ্ছি না। শুধু ভয় পাচ্ছি সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। প্রতি পলে মৃত্যুভয়, ঘরের দরজা খোলবার নামে জীবনের দরজা ঠেলে বেরিয়ে যাবার আশঙ্কা। তবু আমরা মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষ অক্ষরে অক্ষরে হাসি সাজাচ্ছি। সেই হা হা, হো হো, হি হি হাসি ছুড়ে মারছি শত্রুর অদৃশ্য মুখের ওপরে। যেন তার উদ্দেশে এ এক চ্যালেঞ্জ। রোম নগরী বিধ্বস্ত হবার সময় নিরোর বেহালা বাজানোর মতো। তুমি কোভিড হও আর যেই হও পরোয়া করি না তোমাকে। তোমার সামনে দাঁড়িয়ে এই দেখো গুনে গুনে একডজন হি হি বোমা ফাটালাম সশব্দে। নিজেকে নিয়ে, নিজের আত্মজনকে নিয়ে নিরন্তর মজা ওড়ালুম সবার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে। আর অন্যরাও তোমাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভরপুর মজা মেখে নিল এতদিন ধরে দিব্বি তোমার কথা ভুলে থেকে।
সকালবেলা বাড়ির সামনের রাস্তায় একা হাঁটতে হাঁটতে এইসব কথাই ভাবছিলাম। আর ভাবছিলাম, এইবার কলম এবং কলাম দুইই গুটিয়ে ফেলবার সময় এসে গেল। লকডাউনের বারবেলায় বারোয়ারি নকশার বারো নম্বর পর্বে পৌঁছে গেলাম কেমন গড়গড়িয়ে। দক্ষিণ দিক থেকে ফুরফুর করে হাওয়া বইছিল। সেই হাওয়া এসে লাগছে গায়ে। ইচ্ছে করছিল প্রশ্বাসে প্রশ্বাসে সেই শুদ্ধ বাতাস বুকে টেনে নিই। কিন্তু নাকে মুখে মাস্কের আড়াল। নিজেদের দীর্ঘ বেহিসেবি যাপন আর পৃথিবীর সঙ্গে চালিয়ে যাওয়া বর্বরতার শাস্তিস্বরূপ প্রকৃতি আমাদের মুখে এখন মুখ ঢাকবার জন্যে লজ্জার মুখোশ এঁটে দিয়েছেন নিজে হাতে। এই মুখোশের আড়াল কবে ঘুচবে জানি না।
‘কেমন আছ হে? চড়া গলার কুশল সম্ভাষণে চমক ভাঙল। রাস্তায় মানুষের মুখ এখন বিরল। তড়িঘড়ি মুখ তুলে চেয়ে দেখি দীপেন চ্যাটার্জি, এই এলাকার ছেলে বুড়ো সকলের একচেটিয়া দীপেনদা। আড়ালে সকলেই অবশ্য তাঁকে দীপেন পাগলা বলে ডাকে। আমি জানি। চট করে কেউ আজকাল তাঁর সামনে যেতে চায় না। বেমক্কা রাজনৈতিক জ্ঞান শোনবার মতো অবসর সময় কতজনেরই বা থাকে!
দীপেনদা মানুষটা ভারী অদ্ভুত। তিনি উচ্চশিক্ষিত। ব্যাংকে চাকরি করছেন দীর্ঘদিন। রাজনীতি করছেন তারও আগে থেকে। কিন্তু নিজের জন্যে গুছিয়ে নিতে পারেননি কিচ্ছুটি। মাইনের এক অংশ নিয়ম করে বিলিয়ে দেন অভাবিদের। এইসব বোকা মানুষ পার্টিতে কখনওই কদর পান না। ভোটে দাঁড়ানোর টিকিটও পান না কোনওদিন। দীপেনদাও পাননি। তাঁর ছেলের বয়েসি ছেলেপুলে তাঁরই হাত ধরে পার্টি করতে এসে বিস্তর গুছিয়ে নিয়ে হাওয়া বুঝে দলবদল করে ফেলেছে ঠিক সময়ে। এখন সভাসমিতিতে গলার শিরা ফুলিয়ে তারা নিয়মিত দীপেনদার নিন্দেমন্দ করে। তাতে দীপেনদার কিছু গেছে-এসেছে বলে অবশ্য মনে হয়নি। তিনি তাঁরই মতো রয়ে গেছেন এখনও। একা। খেয়ালি।
আমি রাজনীতি করা লোকজনের থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করি। কিন্তু চাইলেও রাজনৈতিক জগতের এই ধরনের লুপ্তপ্রায় মানুষজনকে চট করে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আমি বুঝি সঠিক সংরক্ষণের মাধ্যমে এইসব বোকা রাজনৈতিক ব্যক্তির সংখ্যা বাড়াতে পারলে আদপে দেশেরই মঙ্গল। অবশ্য এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। দেশ থাকে কি না থাকে সেই প্রশ্নই বড় হয়ে উঠছে ক্রমাগত।
আমি দাঁড়ালাম। মাস্কের মধ্যে থেকে জিগ্যেস করলাম, ‘এদিকে কোথায় দীপেনদা?’
‘নাচের পা, বোঝোই তো হে’, বলতে বলতে আমার থেকে বেশ খানিক তফাতে সরে গেলেন তিনি, ‘কী এক মিটার হল? সরকারি নির্দেশ, অন্তত এক মিটার দূরে দাঁড়িয়ে কথা কইতে হবে। কিছুতেই মানুষ মানুষের কাছে আসতে পারবে না আর…’
আমি চিরকাল অংকে কাঁচা। এক মিটার মানে ঠিক কতটা ভাবতে গিয়ে তিনবার হেঁচকি তুলে ফেললাম।
দীপেনদাই কথা শুরু করলেন আবার, ‘তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়ে ভালই হল বুঝলে। একটা ইম্পরট্যান্ট কাজ করিয়ে নেওয়া যাবে তোমায় দিয়ে…’
আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। চমকে উঠে বললাম, ‘কী কাজ দীপেনদা?’
‘তুমি নাকি আজকাল লিখছ-টিখছ?’ আমার প্রশ্নটাকে থোড়াই কেয়ার করে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘ওই আর কী’, মাস্কের মধ্যেই খানিক বিনয়ী হেঁ হেঁ করি আমি।
‘বেশ বেশ। ছাপে-টাপে কেউ?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। বেশ কয়েকখানা বই-টইও বেরিয়েছে…’
‘কত খরচ পড়ল?’
‘আজ্ঞে?’ অবাক হয়ে বলি, ‘খরচ পড়বে কেন? খরচ তো প্রকাশকের। আমি রয়্যালটি পাই।’
‘মাস্কের মধ্যে থেকেই উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন দীপেনদা, ‘তুমিও কি ডিপ্রেশনের শিকার হলে নাকি হে?’
‘মানে?’ আমি অবাক হয়ে বলি।
‘তোমার দোষ নয় এটা’, দীপেনদা হাসলেন, ‘অনেকদিন কাজকম্মো ছাড়া বসে থাকলে এমন হয়। আইডেনটিটি ক্রাইসিস। তখন নিজের সম্পর্কে মানুষ এমন বাড়িয়ে ভাবতে ভালোবাসে।’
‘আমি সত্যিই বলছি’, মরিয়া হয়ে বলি।
‘আমাকে বলেছ ভাল কথা, পাঁচজনকে বোলো না। তোমার এলাকায় একটা ইয়ে আছে, ইস্কুলে পড়াও-টড়াও তো। এসব মিথ্যে কথা শুনলে সেটা ঘেঁটে যাবে…’
আমার মনে মনে বেশ রাগ হচ্ছিল। আমার দিকে চেয়ে দীপেনদা খুব সহজভাবে বললেন, ‘আচ্ছা বাদ দাও। কাজের কথায় আসি বরং।’
‘আপনার সঙ্গে আমার কী কাজ দীপেনদা?’ একটু বিরক্ত হয়েই বলি আমি।
‘আহা রাগ করছ কেন?’ দীপেনদা মোলায়েম করে বলেন, ‘তোমার ভালই লাগবে। কাজটা লেখালেখি সংক্রান্তই। তুমিও খানিকটা লেখার স্কোপ পাবে। আমিও পড়ে-টড়ে ভাল লাগলে সেগুলো পাবলিকের সামনে আনব। বিস্তর পাঠক পাবে লেখাগুলো দেখে নিও। নিজের পয়সায় বই ছেপে সত্যি বলতে কী ক’জনকেই বা বিলোতে পারো? আমার কথা শুনলে দেখবে কাতারে কাতারে লোক তোমার লেখা পড়ার জন্যে দাঁড়িয়ে পড়বে…’
‘কী রকম?’
‘শোনো’, পোক্ত শিক্ষকের মতো দীপেনদা আমাকে বোঝাতে থাকেন, ‘আমাদের বসে থাকলে চলবে না। আমাদের সংগ্রাম এক্কেবারে শেষ নিশ্বাসটি পর্যন্ত। লকডাউন উঠে গেলেই মিউনিসিপ্যালিটি ইলেকশন। তারপরেই রাজ্য বিধানসভা একুশে…’
‘তাতে কী হল?’
‘আমাদের তৈরি থাকতে হবে। পোস্টারের ম্যাটার হাতে রেডি রাখতে চাই এখন থেকে।’
‘রাখুন না, বারণ কে করছে?’ আমি এখন বাস্তবিক পালাতে চাইছি দীপেনদার খপ্পর থেকে।
‘সেইখানেই তোমার কবিতাগুলোকে কাজে লাগাতে চাইছি।’
‘মানে?’ আকাশ থেকে পড়লাম আমি।
‘মাথা খাটিয়ে বিরোধীদের ঠুসে জম্পেশ কিছু কবিতা লিখে ফেলো দেখি ভায়া। জানবে এও একধরনের শ্রেণিসংগ্রাম। তোমার মতন যারা পিছিয়েপড়া কবি, তাদের জোর করে অধিকার ছিনিয়ে নেবার লড়াই এটা। কবিতার আড়তদারদের হটিয়ে ফ্রন্টলাইনার হবার ক্ষেত্রে তোমারও তো কিছু ইন্টেলেকচুয়াল কন্ট্রিবিউশন থাকা দরকার।’
‘আপনি কি খেপেচেন?’
‘খ্যাপামির কী দেখলে?’ দীপেনদাও মরিয়া, ‘ওই লেখাগুলো নিয়ে পোস্টারিং করে যখন দেওয়ালে সাঁটব, কত লোকে পড়বে বুঝতে পারছ? কী মারাত্মক প্রচার তোমার? এই সুযোগ হেলায় হারাবে নাকি?’
‘আমার দরকার নেই দীপেনদা। এখন সারা পৃথিবী একজোট হয়ে একটা অন্য লড়াই লড়ছে। এই লড়াইটায় বিজয়ী হওয়াই এই মুহূর্তে আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। এখন অন্য দিকে ফিরে তাকানোর সময় নেই…’
‘এটা ভাই একধরনের পেসিমিস্টিক আউটলুক। ফাঁকতালে সাম্রাজ্যবাদী দলগুলো তোমাদের মতন অপগণ্ডদের বদান্যতায় শক্তিসঞ্চয় করে নিচ্ছে সারা বিশ্বে…’
‘যে যা পারে করুক’, আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, ‘আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি নই দীপেনদা। ওভাবে প্রচার দেওয়া বা নেওয়া কোনওটারই আমার দরকার নেই। বিশ্বাস করুন…’
‘তালে লিখবে না?’
‘উঁহু।’
‘ওই জন্যেই বড় বড় দার্শনিকরা আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থায় কবিদের রাখেননি’, দীপেনদা হতাশ হয়ে মাথা নাড়লেন, ‘তাহলে আজ চলি। ন’টা বাজতে চলল। এরপর বাইরে থাকলে আবার পুলিশে হুড়কো দেবে। সাবধানে থেকো। পরে কথা হবে আবার। পারলে ঠান্ডামাথায় প্রস্তাবটা আর একবার ভেবো। সত্যিই যদি একটা আদর্শ সমাজ বানাতে চাও সবাই মিলে, তো সামনের ইলেকশনে…’
আমি মাথা নাড়লাম। দীপেনদা এগিয়ে যাচ্ছেন। সামনে ঝুঁকে পড়েছেন খানিক। সেদিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বললাম, স্কুলে এখনও পাবলিশারদের কাছ থেকে ‘আদর্শ গণিত’, ‘আদর্শ জীববিজ্ঞান’, ‘আদর্শ ভূ-বিদ্যা’ এইসব বইগুলো আসে ঠিকই, কিন্তু বুকলিস্টে তাদের রাখা যায় না। এখন সব বইই সরকারি। বিনামূল্যে বিতরিত। অন্য কোনও ‘আদর্শের’ প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
চিত্রকর: রাজ রায়
জয়দীপ চক্রবর্তীর ‘বারোয়ারি নকশা’র আগের পর্বগুলি…